তুমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করবে, তখন দুনিয়া আর আগের মতো থাকবে না

ফল যা–ই হোক, অভিভাবক যেন সন্তানের পাশে থাকেন
ছবি: দিপু মালাকার

প্রিয় এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা, তোমাদের জীবনের অনেক বড় একটি অধ্যায় শেষ হলো। বন্যা, আন্দোলন, স্কুলের মধ্যে বিমান আছড়ে পড়াসহ আকস্মিক ও অবিশ্বাস্য নানা ঘটনা পেরিয়ে তোমরা পরীক্ষায় বসেছ; এটাই বড় সাহসিকতার ব্যাপার। এত দিনের পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফল তোমরা পেয়েছ।

যারা ভালো ফল করেছ, তাদের অভিনন্দন! সামনের লড়াইটা কিন্তু আরও অনেক বড়। সেখানে ভালো না করতে পারলে আজকের কথা কেউ মনে রাখবে না। যারা ভালো ফল পাওনি, তাদের জন্যও একই কথা। যদি সামনের দিনগুলোতে ভালো করতে পারো, হোক তা পড়ালেখা বা অন্য কোনো ক্ষেত্র, তোমার আজকের দিনের খারাপ রেজাল্টও কিন্তু কেউ মনে রাখবে না। তাই মাথা ঠান্ডা রেখে আগামী দিনের প্রস্তুতি চালিয়ে যাও।

অল্পের জন্য যাদের এ প্লাস হাতছাড়া হয়েছে, মনে রেখো, নম্বর একটু কম হলেও ভর্তি পরীক্ষায় সেটি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। মেডিকেল, প্রকৌশল বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানেই পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছ, এখন থেকেই ‘গেম প্ল্যান’ বানাও। সময় কম, তাই কৌশল সাজিয়ে এগোও।

আরও পড়ুন

যাদের জিপিএ কম, তারা হাল ছেড়ো না। প্রয়োজনে পরিকল্পনা বদলাও। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যদি না-ও পারো, আগামী বছরের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাও। ভর্তি পরীক্ষার জন্য তিন মাস ঠিকঠাক পড়লেও কিন্তু অনেক সময় জীবনের মোড় ঘুরে যায়। মনে রেখো, রেজাল্ট খারাপ হওয়া সমস্যা না। মন খারাপ করে হাল ছেড়ে দেওয়াটাই আসল সমস্যা।

অভিভাবকদের বলি

যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন হতাশ হয়ে, শাসন করে, বিরক্ত হয়ে বা কটূক্তি করে কোনোভাবেই রেজাল্ট বদলানোর সুযোগ নেই। একটি কথা সব সময় মাথায় রাখা আমাদের বড়দের দায়িত্ব, কোনো সন্তানই মা-বাবা ও অভিভাবককে হতাশ করতে চায় না। মনমতো ফল না পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট আদতে আপনার সন্তানই পাচ্ছে। ক্ষতিটা তারই হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সে-ই এখন অনেক বড় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সামনের লড়াইটায় ও যদি আপনাকে পাশে না পায়, তাহলে ওর জন্য সেই লড়াইয়ে অংশ নেওয়া অনেক কঠিন হবে। তাই এই সময়টায় সাহস দিয়ে ওর পাশে থাকুন। ওর সবচেয়ে বড় শক্তি, সাহস আর অনুপ্রেরণার জায়গা হয়ে উঠুন আপনি।

রেজাল্ট ভালো বা খারাপ, এরপর?

রেজাল্ট ভালোর খুশিতে উড়ে সময় নষ্ট করা কিংবা এ প্লাস হাতছাড়া হওয়ার কষ্টে হাল ছেড়ে হার মেনে নেওয়া—কোনোটাই উচিত হবে না। দৃষ্টি রাখতে হবে সামনে। শিক্ষার্থীদের বলব, ভর্তি প্রস্তুতিতে কোনো ফাঁক রেখো না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা হয়ে গেছে। নির্বাচনের জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই ভর্তি পরীক্ষা এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে নিয়েছে বা সামনে নেবে। তাই মেডিকেল, প্রকৌশল কিংবা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়—যেখানে পড়ার প্রস্তুতিই নাও না কেন, খুব স্ট্র্যাটেজিক্যালি বা কৌশলগতভাবে পরিকল্পনা করো। সময় অনেক কম। এ সময়ে যারা মাথা ঠান্ডা রেখে বুদ্ধিদীপ্ত প্রস্তুতি নেবে, জিতবে তারাই।

আরও পড়ুন

বিকল্প পরিকল্পনা রাখো

অবশ্যই লক্ষ্য সামনে রেখে এগোও কিন্তু বিকল্প পরিকল্পনাও (ব্যাকআপ প্ল্যান) গুছিয়ে রেখো। কারণ, আমাদের দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে আসনসংখ্যা সীমিত। প্রতি আসনের বিপরীতে লড়ে অনেক মেধাবী। এ জন্যই বিকল্প ভাবাও জরুরি। বিকল্প ভাবা থাকলে মূল লক্ষ্য যদি ফসকেও যায়, তা-ও ঝুঁকি কমবে।

বুঝিয়ে বলি। যারা মেডিকেলকে মূল ফোকাসে রেখে পড়ছ, গণিতের চর্চাটাও কোরো। তাহলে ‘এ ইউনিট’-এর জন্যও একটি পোক্ত প্রস্তুতি হয়ে যাবে। যারা প্রকৌশলে পড়তে চাও, তারা একটু ফাঁকে ফাঁকে জীববিজ্ঞান, সাধারণ জ্ঞানটা পড়ে রাখলে মেডিকেল আর ‘এ ইউনিট’–এর জন্যও প্রস্তুতি হয়ে যাবে। এভাবেই ভর্তি প্রস্তুতির কৌশল সাজাও। দেখবে স্বপ্নপূরণ হবেই।

আমি বুয়েটের জন্য পড়ার পাশাপাশি আইবিএর (ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট) জন্যও পড়তাম। শেষমেশ আইবিএ থেকেই পড়াশোনা করে বের হলাম। বিকল্প পরিকল্পনাও মূল পরিকল্পনা হয়ে যেতে পারে সময়, সুযোগ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী।

অনেকেই দেশের বাইরে পড়তে যেতে চাও। এখন থেকেই প্রস্তুতি নাও। আইইএলটিএসের প্রস্তুতিটা ভালোমতো নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে ফেলো। এসওপিটা (স্টেটমেন্ট অব পারপাস) লেখো। বৃত্তির জন্য ঘাঁটাঘাঁটি করে আবেদন করতে থাকো।

পরীক্ষার ফল দেখছেন শিক্ষার্থীরা
ছবি: সাইয়ান

দক্ষতা গড়ে তোলো

তুমি যেই বিষয়েই সনদপ্রাপ্ত বা বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠো না কেন, ভবিষ্যতের দুনিয়া শুধু পরীক্ষার ফল দিয়ে বিচার করবে না। তোমরা যত দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে চাকরির দুনিয়ায় প্রবেশ করবে, তখনকার সঙ্গে এখনকার অনেক কিছুরই কোনো মিল থাকবে না। এখনকার অনেক দক্ষতা, চাকরি, কাজ তখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। নতুন কাজ আসবে। চাকরি, ব্যবসা, পেশাজীবন—সব বদলে দেবে প্রযুক্তি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), মেশিন লার্নিং, ডেটা অ্যানালাইসিস, ডিজিটাল কমিউনিকেশন—এই দক্ষতাগুলো হবে আগামীর পৃথিবীতে চাকরির দুনিয়ায় টিকে থাকার রসদ।

শিখতে শেখো

আমরা অনেক কিছু শিখলেও অনেকেই এখনো কীভাবে শিখতে হয়, সেটাই শিখতে পারিনি। কারণ ‘শেখা’-নিজেই যে একটা দক্ষতা, এভাবে অনেকেই আমরা চিন্তা করি না। আজ তুমি যেই বিষয়টা পড়ছ, কয়েক বছর পর সেটা হয়তো বদলে যাবে। আর প্রাসঙ্গিক থাকবে না। তখন তোমাকে আবার নতুন করে যেটা প্রাসঙ্গিক, সেটা শিখতে হবে। তাই এখন থেকেই কীভাবে শিখতে হয়, সেটা শিখে রাখো। এখন এআই-এর যুগ। সবাই সব শিখতে পারে। আমাদের প্রত্যেকের হাতে সব শেখার সুযোগ আছে। ক্ষমতা আছে। বিনা মূল্যের প্রচুর এআই টুল আছে। আমরা স্বপ্নের মতো চমৎকার একটা সময়ে আছি এখন। শেখার এই সুন্দর-সহজ সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করো না।

আরও পড়ুন

পৃথিবী বদলাচ্ছে, তুমিও বদলাও

আগেও বলেছি, আবার বলছি, তুমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করবে, তখন দুনিয়া আর আগের মতো থাকবে না। অনেক কাজ হয়তো আর থাকবে না, অনেক নতুন কাজ তৈরি হবে; কিন্তু একটা জিনিস একই থাকবে—যারা শেখার প্রতি আগ্রহী, যারা সাহস করে নতুন কিছু চেষ্টা করে, তারাই এগিয়ে যাবে।

তাই আজ যদি ফল ভালো হয়ে থাকে, তাহলে খুশিমনে পরের ধাপের জন্য প্রস্তুতি নাও। আর যদি ফল মনমতো না–ও হয়, কষ্ট পেতে পারো; কিন্তু হতাশ হয়ে হাল ছেড়ো না। একদিন এই সময়টার দিকেই ফিরে তাকিয়ে হাসিমুখে বলবে, ‘এই ফলটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট।’ তখন তুমি বিশ্বাস করবে, যা হয় ভালোর জন্যই হয়।

আয়মান সাদিক
ছবি: আয়মান সাদিকের সৌজন্যে

শেষ কথা

এইচএসসির রেজাল্ট তোমার জীবনের গল্পের একটা পাতা মাত্র। পুরো গল্প এখনো অনেকটা লেখা বাকি। আজ থেকে ১৪ বছর আগে এই সময়টা আমার জীবনেও এসেছিল। হাল না ছেড়ে লেগে থাকলে জিতে যাবে তুমিও। তাই হাল ছেড়ো না, পরিশ্রম চালিয়ে যাও, আর মনে রেখো, তোমার ভবিষ্যৎ ঠিক তোমার হাতেই লেখা হচ্ছে এখন থেকেই। সব ভালো হোক। দেখা হবে বিজয়ে।

লেখক: টেন মিনিট স্কুলের সহপ্রতিষ্ঠাতা