সড়ক দুর্ঘটনা, কুকুরের কামড় কিছুই রাজেশকে দমাতে পারেনি

সাঁতার, সাইক্লিং আর দৌড়—এই তিনের সমন্বয় হলো ট্রায়াথলন। সেই খেলারই কঠিনতম প্রতিযোগিতা আয়রনম্যান। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থাইল্যান্ডে হলো ‘আয়রনম্যান ৭০.৩ ব্যাংস্যান’ প্রতিযোগিতা। এতে বাংলাদেশের ছয়জন অংশ নিয়ে সফল হন। যাঁদের একজন রাজেশ চাকমা। পাহাড়ি এই তরুণের গল্প শুনেছেন পল্লব মোহাইমেন

থাইল্যান্ডে ‘আয়রনম্যান ৭০.৩ ব্যাংস্যান’ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের রাজেশ চাকমাছবি: রাজেশের সৌজন্যে

আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাইল্যান্ড গেছেন রাজেশ চাকমা। এক দিন পরই মূল প্রতিযোগিতা। তার আগে ১৭ ফেব্রুয়ারি সাইকেল নিয়ে অনুশীলন করতে বের হয়েছেন চারজন। ফেরার সময় পথ হারিয়ে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে পড়লেন রাজেশ। একটি গলিতে ঢুকে পথ খোঁজ করছেন, আচমকা একটা কুকুর এসে কামড়ে দিল রাজেশের পা। তাৎক্ষণিক অতটা গা করেননি রাজেশ। কারণ ব্যথাও বেশি বোধ করেননি। কিন্তু একসময় নিচে তাকিয়ে দেখেন পায়ের মোজা রক্তে ভিজে লাল। ততক্ষণে অবশ্য পথ খুঁজে পেয়েছেন। সাইকেল চালিয়েই হোটেলে ফিরে আসেন রাজেশ। পাশের এক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে ব্যান্ডেজ-ড্রেসিং নেন, সঙ্গে দুই ডোজ টিকা। বিদায়বেলায় চিকিৎসকেরা বলেন, ব্যান্ডেজে এক দিন কোনো পানি লাগানো যাবে না।

রাজেশ বললেন, ‘কিন্তু কাল তো আমার আয়রনম্যান। সাঁতরাতে তো হবেই।’

রাজেশের জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকেরা রফা করলেন, অন্তত রাতের কয়েক ঘণ্টা পানি লাগানো যাবে না!

আরও পড়ুন
প্রথম আলো কার্যালয়ে রাজেশ চাকমা
ছবি: কবির হোসেন

পরদিন কুকুরের কামড়ের ক্ষত নিয়েই শুরু হলো রাজেশের আয়রনম্যান। ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার সাঁতারের পর ৯০ কিলোমিটার সাইক্লিং। রাজেশের প্রথম আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ, অভিজ্ঞদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখলেও খুঁটিনাটি অনেক কিছুই এখনো অজানা। পাহাড়ি উঁচু–নিচু রাস্তায় ৩৫ কিলোমিটার পার হওয়ার পর তাঁর সাইকেলের বটল হোল্ডারের স্ক্রু খুলে গেল। একসময় পুরো হোল্ডারটাই খুলে গেল। তখন হোল্ডার ও পানির বোতল এক হাতে ধরে, আরেক হাতে সাইকেল চালাতে থাকেন। একটা স্টপেজে এসে বোতল হোল্ডার রেখে দেন। আবার সাইক্লিং শুরুর পর পানির তেষ্টা প্রবল হয়ে ওঠে। আরেক স্টপেজে গিয়ে ইলেকট্রোলাইট পানীয়ের বোতল নেন রাজেশ। আবারও এক হাতে সাইকেল চালাতে শুরু করেন। এভাবেই পাড়ি দেন ৯০ কিলোমিটার। ২২.১ কিলোমিটার দৌড়ও শেষ করেন নির্দিষ্ট সময়ে। অর্জন করেন আয়রনম্যান ৭০.৩ ফিনিশার পদক। রাজেশের সময় লেগেছে ৭ ঘণ্টা ৮ মিনিট ৪০ সেকেন্ড। নিজের ৪০ থেকে ৪৪ বছর বয়স গ্রুপে ২২৩ প্রতিযোগীর মধ্যে তাঁর অবস্থান ১৩৯। রাজেশ চাকমা বলছিলেন, ‘চাকমা সম্প্রদায় থেকে আমি প্রথম আয়রনম্যানে অংশ নিয়েছি।’

ফিরে আসা

ঢাকায় রাজেশের বাসার কাছেই চন্দ্রিমা উদ্যান। প্রতিদিন সেখানে দৌড়াতেন। ২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন ম্যারাথনে অংশ নিতে থাকেন। ম্যারাথনে অংশ নিতে নিতেই আয়রনম্যান প্রতিযোগিতার কথা জেনে যান রাজেশ। শুরু হয় প্রস্তুতি। ২০২৩ সালে কারিগরি নিয়ম (স্ট্রাকচারড ট্রেনিং) মেনে শুরু করেন দৌড়ের চর্চা। প্রতিদিন কখনো ৫ থেকে ৬, কখনোবা ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার দৌড়াতেন। শারীরিক মানসিক প্রস্তুতি যখন তুঙ্গে তখনই আসে বাধা।

সেটা গত বছরের ৩০ জুনের কথা। স্ত্রী শ্যামলী চাকমা আর ১২ বছরের মেয়ে কেকো চাকমাকে নিয়ে মোটরবাইকে করে খাগড়াছড়ি যাচ্ছিলেন রাজেশ। শহরেও পৌঁছে গেছেন। এরই মধ্যে নিশানাবিহীন এক গতিরোধকে দুর্ঘটনায় পড়েন। স্ত্রী ও মেয়ে তেমন আহত না হলেও রাজেশের পায়ের আঙুলের হাড় ভেঙে যায়। জখম হয় লিগামেন্ট।

দুর্ঘটনার পর চার মাস বিছানাতেই কেটে যায়। নভেম্বরে মনোবল ফিরে পান। ফিজিওথেরাপি নেওয়া শুরু করেন। আবার চন্দ্রিমা উদ্যানে দৌড়াতে শুরু করেন। তারপরও সংশয় ছিল, ব্যয়বহুল এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের খরচ কোত্থেকে আসবে? এগিয়ে আসে সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানেরই গ্রাহকসেবা বিভাগের প্রধান রাজেশ। প্রতিযোগিতার এক সপ্তাহ আগে অর্ধেক খরচ দিয়ে তারা পৃষ্ঠপোষকতা করে। স্বল্প সময়েই পেয়ে যান ভিসা।

নিজের ৪০ থেকে ৪৪ বছর বয়স গ্রুপে ২২৩ প্রতিযোগীর মধ্যে রাজেশ চাকমার অবস্থান ১৩৯
ছবি: রাজেশের সৌজন্যে

রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে রাজেশ চাকমার জন্ম ১৯৭৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। শিক্ষক দয়ালকৃষ্ণ চাকমা ও গৃহিণী পূর্ণিমা চাকমার দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে রাজেশ বড়। স্কুলজীবন থেকেই খেলার দিকে রাজেশের ঝোঁক। প্রাথমিক পেরিয়ে কাচালং সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ৬০০-৭০০ মিটার উঁচুতে ছিল এই স্কুল। প্রতিদিন পাহাড় বেয়ে চার–পাঁচ কিলোমিটার যাতায়াত করতে হতো। রাজেশ বলেন, ‘এগুলো আমার শরীরের সক্ষমতা তৈরি করে।’

১৯৮৮-৮৯ সাল, পাহাড় তখন অশান্ত। বাবা রাজেশকে বিলাইছড়িতে তাঁর মাসির বাড়ি পাঠিয়ে দেন। রাজেশ বলেন, ‘কাপ্তাই হ্রদের পাশেই মাসির বাড়ি। দিনের বেশির ভাগ সময়ই পানিতে থাকতাম। সাঁতারের অভ্যাস এভাবেই শুরু।’

২০০৫ সালে ঢাকায় চলে আসেন রাজেশ। প্রথম দিকে কম্পিউটারের কয়েকট স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স করেন। ২০০৭ সালে সিঙ্গারে চাকরি নেন। ঢাকায় এলেও মনটা পাহাড়ে পড়ে থাকে। নিজে রাঙামাটি রানারস গ্রুপ খুলেছেন। দূরপাল্লার দৌড়ে অংশ নিতে সেখানে তরুণদের উৎসাহ দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে আশা করেন, পাহাড়ের আরও তরুণ আয়রনম্যান হবেন। এখন রাজেশের লক্ষ্য পূর্ণ দূরত্বের আয়রনম্যান আর আয়রনম্যানের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ।