ঘাম ঝরে একজনের, নম্বর জোটে সবার

গ্রুপ ওয়ার্কে অনেক সময়ই সব কাজের দায়িত্ব পড়ে যায় একজনের কাঁধে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ঘড়ির কাঁটায় রাত তখন প্রায় তিনটা। হলের রিডিংরুমের নিস্তব্ধতা ভেঙে মাঝেমধ্যে শুধু কি-বোর্ডের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ল্যাপটপের পর্দার দিকে তাকিয়ে জেবা আনিকার চোখ জ্বালা করছে, পিঠের ব্যথাটাও অসহ্য হয়ে উঠছে। পরদিন সকাল ১০টায় ‘এডুকেশনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ কোর্সের ফাইনাল প্রেজেন্টেশন। পাঁচজনের গ্রুপের কাজটা একাই করছেন জেবা। মেসেঞ্জার গ্রুপে গত চার ঘণ্টায় কেউ একটা মেসেজেরও রিপ্লাই দেয়নি। অথচ তাদেরই কেউ কেউ হয়তো ফেসবুকে মিম শেয়ার করছে, অন্য কারও পোস্টে গিয়ে মন্তব্য লিখছে। সবাই নির্ভার, শুধু জেবা ছাড়া।

বিভিন্ন ক্যাম্পাসে এই দৃশ্য মোটামুটি চেনা। এমনকি এ প্রবণতার একটা নামও আছে—‘ফ্রি রাইডিং’।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে দলগত কাজ বা গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্টের মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘টিমওয়ার্ক’ বা সহযোগিতার মানসিকতা গড়ে তোলা। কিন্তু অনেকের কাছে ‘গ্রুপ ওয়ার্ক’ হয়ে ওঠে আতঙ্কের নাম। দেখা যায় প্রতি সেমিস্টারেই ক্লাসের গুটিকয়েক শিক্ষার্থী বা পড়ালেখায় ‘সিরিয়াস’ যাঁরা, তাঁরাই বাকি সবার কাজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। এটাই যেন ক্যাম্পাসের ‘অলিখিত সংস্কৃতি’। ফ্রি রাইডার বা অন্যের ঘাড়ে চড়ে পার পেয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কিন্তু কম নয়।

আরও পড়ুন

‘দোস্ত, তুই–ই তো আছিস’

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফ্রি রাইডারদের ধরন বা কৌশলগুলো বেশ বিচিত্র। এর শুরুটা হয় ‘দোস্ত, তুই–ই তো আছিস’ ধরনের কথা দিয়ে। আরেক দল আছে—‘নিখোঁজ সদস্য’। অ্যাসাইনমেন্টের বিষয় নির্ধারণের পর থেকে জমা দেওয়ার আগের রাত পর্যন্ত তাঁদের কোনো হদিস থাকে না। আরও এক দল আছে, ‘অজুহাত মাস্টার’। কাজ ভাগ করে দেওয়ার সময় তাঁরা এমন সব অসুখ-বিসুখ বা ব্যক্তিগত ঝামেলার কথা শোনান যে মানবিক কারণেই তাঁদের আর কোনো কাজের ভাগ দেওয়া হয় না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সারওয়ার জাহান বলেন, ‘গত সেমিস্টারে আমার এক গ্রুপমেট তার অসুস্থতার কথা বলে পুরো কাজ আমাকে দিয়ে করাল। অথচ প্রেজেন্টেশনের দিন দেখলাম সে দিব্যি ফিটফাট হয়ে এসেছে এবং স্যারের সামনে এমন ভাব নিচ্ছে যেন পুরো প্রজেক্টের সে–ই মাস্টারমাইন্ড। বন্ধুত্বের খাতিরে তখন কিছু বলাও যায় না, আবার সহ্য করাও কঠিন।’

মনস্তত্ত্ব কী বলে

কেন শিক্ষার্থীরা এমন আচরণ করেন? সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানে একে বলা হয় ‘সোশ্যাল লোফিং’। ১৯১৩ সালে ফরাসি কৃষি প্রকৌশলী ম্যাক্স রিংগেলম্যান এক গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, মানুষ যখন একা কাজ করে তখন সে নিজের শতভাগ দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু যখনই সে দলের অংশ হয়, অবচেতনভাবেই তার প্রচেষ্টার মাত্রা কমে যায়। সে ভাবে, ‘আমি কম কাজ করলেও কেউ টের পাবে না, দলের অন্য কেউ তো কাজটা সামলে নেবেই।’ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এই মানসিকতা আরও জেঁকে বসেছে। ফাঁকিবাজেরা জানে, দিন শেষে নম্বরটা সবাই সমানই পাবে। যে শিক্ষার্থী সাত রাত জেগে তথ্য সংগ্রহ করে রিপোর্ট লিখল, আর যে কেবল কভার পেজ প্রিন্ট করে নিয়ে এল—দুজনের ট্রান্সক্রিপ্টেই যোগ হচ্ছে একই গ্রেড পয়েন্ট। যে চর্চার মধ্য দিয়ে দলীয় কাজ শেখার কথা, সেটাই হয়ে যায় ফাঁকিবাজি চর্চার প্ল্যাটফর্ম। আখেরে ক্ষতিটা কিন্তু ফ্রি রাইডারদেরই হয়।

সম্পর্ক ফাটলের কারণ

ফ্রি রাইডিংয়ের সবচেয়ে বড় নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর পড়ে। বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে দিনের পর দিন কাজ চাপিয়ে দেওয়া হলে একসময় সহ্যের বাঁধ ভাঙে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মুয়াজ বিন জাহিদ বলেন, ‘একটা বড় প্রজেক্টের পর এক বন্ধুর সঙ্গে আমার মনোমালিন্য হয়েছিল। এ ধরনের কাজে আসলে সবার সমান এফোর্ট (প্রচেষ্টা) নিশ্চিত করাটা কঠিন। যেহেতু শিক্ষকেরা সরাসরি যুক্ত থাকেন না, যারা একটু ফাঁকি দিতে চায়, তাদের জন্য খুবই সহজ হয়ে যায় বিষয়টা। আবার গ্রুপে একজন অন্তত এমন থাকেই, যার নম্বর কম হলে চলবে না। বাধ্য হয়ে হলেও তারই কাজটা করতে হয়। অনেক সময় গ্রুপ ওয়ার্কই বন্ধুত্ব নষ্টের কারণ হয়ে যায়।’

মুয়াজের মতে, এমন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েন। তাঁদের মধ্যে একধরনের বঞ্চনাবোধ তৈরি হয়। তাঁরা ভাবতে শুরু করেন, সততা বা পরিশ্রমের আদতে বিশেষ কোনো মূল্য নেই।

শিক্ষক কী বলছেন

গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্টে অনেক সময় সব শিক্ষার্থীকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না, স্বীকার করেন শিক্ষকেরাও। তবে নানাভাবে তাঁরা শিক্ষার্থীদের পুনর্মূল্যায়নের চেষ্টা করেন। সিলেটের মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সিনিয়র লেকচারার শাদমান শাকিব বলেন, ‘এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমি অ্যাসাইনমেন্টের পর গ্রুপের প্রত্যেকের একটা ছোট ভাইভা নিই, এবং সেটার ওপর ভিত্তি করে নম্বর দিই। এতে করে যে আসলেই কাজ করছে সে ভালো নম্বর পায়, আর যে কাজ করেনি, সে তার ঘাটতিটা বুঝতে পারে।’

তবে শিক্ষকদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয় হলো কর্মজীবনের প্রস্তুতিপর্ব। প্রস্তুতিতেই ঘাটতি থেকে গেলে দলবেঁধে কাজটা আর শেখা হয়ে ওঠে না, পেশাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। নিজের স্বার্থেই তাই দলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ।

আরও পড়ুন