সোমালিয়ার জলদস্যুদের কাছ থেকে যেভাবে মুক্তি পেয়েছিলেন বাংলাদেশি দুই নাবিক

২০১০ সালের ৮ মে আরব সাগরের গালফ অব এডেনে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়ে জার্মান অয়েল ট্যাংকার মারিডা মারগারিটা। জাহাজের ২২ ক্রুর দুজন ছিলেন বাংলাদেশি। তাঁদের একজন সে সময়ের প্রধান কর্মকর্তা জাফর ইকবাল, অন্যজন দ্বিতীয় প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন আজম খান। প্রায় সাড়ে সাত মাস জিম্মি থাকার পর ওই বছর ২৮ ডিসেম্বর তাঁরা মুক্তি পান। ২০১১ সালের ১৫ জানুয়ারি তাঁদের জিম্মি-জীবনের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে ‘ছুটির দিনে’। প্রথম আলোর রজতজয়ন্তী উপলক্ষে লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

নিরাপদ নোঙর: সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবল থেকে ফেরা দুই বাংলাদেশি নাবিক জাফর ইকবাল ও গিয়াস উদ্দিন, ২০১০
আলোকচিত্র: অনুরূপ কান্তি

এমনিতেই কবি কবি চেহারা, জাহাজে ওঠার পর চুল কাটানো হয়নি, তাই সারেং গিয়াস উদ্দিনকে অনেকে বাউল ডাকেন। স্বদেশি সহকর্মী জাফর ইকবাল তাঁকে নিয়ে কাব্য করেন, ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো...’।

অকূল সাগরের মাতাল হাওয়া গিয়াসের মনটাকে সত্যি ব্যাকুল করে দেয়। ভাবেন, কত দিন পরিবার থেকে দূরে! মনের আয়নায় বারবার ভেসে ওঠে মমতাময়ী মা আর প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখটি। কানে বাজে মুঠোফোনে স্ত্রীর আকুল করা শেষ কথাটি, ‘কবে ফিরবে তুমি?’

এবার হিসাব কষেন গিয়াস, ১৫ জানুয়ারি জাহাজে উঠেছেন, চার মাসের ট্যুর শেষ হবে ১৫ মে। আর মাত্র সাত দিন পর ছুটি! পাটিগণিতের সহজ এই হিসাব আনন্দের ঝড় তোলে গিয়াসের মনে। দূর সমুদ্রে হঠাৎ গলা ছাড়েন গিয়াস; গেয়ে ওঠেন, ‘ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া...’।

সুরে সুরে সারেং বৌর বাকি কথা বয়ানের আগেই জাহাজের জরুরি সতর্ক সংকেত (ইমার্জেন্সি অ্যালার্ম) বেজে ওঠে। মারিডা মারগারিটা নামের জাহাজটির দ্বিতীয় প্রকৌশলী গিয়াসের ভালোই জানা আছে, এই সংকেতের মানে কী? ঘড়িতে সময় তখন দুইটা ৩০ মিনিট। গিয়াস জাহাজের অবস্থান দেখে নিলেন। তাঁরা এখন আছেন আরব সাগরের গালফ অব এডেনের প্রবেশমুখে, ইন্টারন্যাশনাল ট্রানজিট করিডরে।

মুহূর্ত ব্যয় না করে তিনি কেবিন থেকে দৌড় দেন ডেকের দিকে। রাডারের পাশে ছিলেন যে অর্ডিনারি সিম্যান, তাঁর সঙ্গে এক পলক দেখা হলো। তিনি গিয়াসের উদ্দেশে চেঁচিয়ে কী যেন বলতে চাইলেন, কিন্তু গলা দিয়ে কথা বের হলো না!

ডেকে ওঠার পর দৃশ্যটা দেখে কেঁপে উঠল গিয়াসের প্রাণের খাঁচা। তিনি পরিষ্কার দেখলেন জাহাজের পেছন দিক থেকে একটি স্পিডবোট ঝড়ের গতিতে এগিয়ে আসছে জাহাজের দিকে। এরই মধ্যে ওই রুটে চলাচলকারী জাহাজগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা জাতিসংঘ, ন্যাটো ও আমেরিকার যুদ্ধজাহাজে সাহায্যের জন্য বার্তা পাঠানো হয়েছে। ক্রুরা সম্ভাব্য শত্রুদের প্রতিরোধের জন্য তৈরি হলেন—সম্বল কেবল গরম পানি।

ছুটির দিনের মূল রচনায় জিম্মিজীবনের গল্প

দেখতে দেখতেই স্পিডবোটটি জাহাজের খুব কাছে চলে এল। সমানে ফায়ার শুরু করেছে ওরা। তাদের লক্ষ্য করে জাহাজ থেকে গরম পানি ছুড়লেন ক্রুরা। কোনো কাজ হলো না, একপর্যায়ে জাহাজের গা-ঘেঁষে থিতু হলো স্পিডবোট। বোটের কাণ্ডারি ছয়জন, লিকলিকে কালো মানুষগুলোর উচ্চতা ছয় ফুটের বেশি ছাড়া কম হবে না। খালি গা, হাফপ্যান্ট পরা। কিন্তু সবার হাতে অস্ত্র। মুহূর্তের মধ্যে অ্যালুমিনিয়ামের মই বেয়ে ছয়জনই উঠে গেল জাহাজে। জাহাজের ক্রুরা সবাই ব্রিজে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। এক মিনিটের মধ্যে দরজায় করাঘাত—একটি শব্দই শোনা যাচ্ছে বারবার ‘ওপেন’।

গিয়াসদের জাহাজটা অয়েল ট্যাংকার, শত্রুদের কাছে আছে ভারী অস্ত্র, এমনকি রকেট লঞ্চার। বাধ্য হয়ে দরজা খুলতে হলো। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র লোকেরা ক্রুদের ব্রিজের এক কোণায় নিয়ে গেল। ওরা ‘ওপেন, মুভ, সেভ ইউরসেলফ’—এই তিনটি শব্দ উচ্চারণ করছে কেবল। দুজন একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে সোজা চলে গেল ক্যাপ্টেনের কাছে এবং তাঁকে বলল, ‘মাস্টার, জাহাজ দক্ষিণে ঘোরাও।’

দক্ষিণে মানে সোমালিয়া উপকূলের দিকে। নাবিকদের আর বোঝার বাকি রইল না তাঁরা জলদস্যুদের কবলে পড়েছেন।

এরই মধ্যে ঘটল আরেক ঘটনা। বিপৎসংকেত পেয়ে কাছে চলে এল উদ্ধারকারী যুদ্ধজাহাজ হানজিন আমস্টার্ডাম। জাহাজটি মারিডা মারগারিটার চারদিকে ঘুরতে লাগল, কাছে আসার চেষ্টা করল। আর তখনই জলদস্যুদের অস্ত্র গর্জন করে উঠল। তারা ক্যাপ্টেন মাখানের বুকে অস্ত্র ধরে বলল, ‘ভিএইচএফের (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি) মাধ্যমে ওই জাহাজকে চলে যেতে বলো। নইলে তোমাদের সবাইকে শেষ করে দেব।’ ক্যাপ্টেন মাখানে তাই করলেন; বললেন, ‘আমরা এখন অপহৃত, তোমরা চলে যাও।’ এরই মধ্যে এল একটি হেলিকপ্টার। তারা সাহার্য্য করার জন্য জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করল, কিন্তু মারিডা মারগারিটা থেকে প্রত্যুত্তর না পেয়ে ফিরে গেল সেটিও।

অবশেষে জলদস্যুদের নির্দেশে জাহাজ চলতে লাগল দক্ষিণে, সোমালিয়ার দিকে।

জিম্মি-জীবনের প্রথম অধ্যায় বর্ণনা করে একটু দম নেন গিয়াস উদ্দিন। এই ফাঁকে প্রশ্নটা করা হয় তাঁর জ্যেষ্ঠ সহকর্মী জাফর ইকবালকে, ‘প্রথম দর্শনে কেমন মনে হয়েছিল জলদস্যুদের?’ সে কথা বলতে গিয়ে চেহারাটা কেমন যেন হয়ে যায় জাফরের। তারপর শুরু করেন, ‘আমরা তো ধরে নিয়েছিলাম ভয়ংকর ওই মানুষগুলোর হাতে যেকোনো মুহূর্তে প্রাণ যাবে। আল্লাহর রহমত সে রকম কিছু হয়নি।’

গত বছরের (২০১০ সাল) ৮ মে আরব সাগরের গালফ অব এডেনে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়ে জার্মান অয়েল ট্যাংকার মারিডা মারগারিটা। জাহাজের ২২ ক্রুর দুজন বাংলাদেশি। তাঁদের একজন প্রধান কর্মকর্তা জাফর ইকবাল, অন্যজন দ্বিতীয় প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন আজম খান। তাঁদের দুজনের বাড়ি চট্টগ্রামে। প্রায় সাড়ে সাত মাস জিম্মি থাকার পর গত ২৮ ডিসেম্বর (২০১০ সাল) তাঁরা মুক্তি পান। গত শনিবার গিয়াস ও সোমবার জাফর চট্টগ্রামের বাড়িতে ফেরেন। সাড়ে পাঁচ লাখ মিলিয়ন ডলার (সে সময় বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ৩৮ কোটি টাকা) মুক্তিপণ নিয়ে মারিডা মারগারিটা জাহাজটি মুক্ত করে দেয় জলদস্যুর দল।

জার্মান অয়েল ট্যাংকার মারিডা মারগারিটা
ছবি: সংগৃহীত

অনিশ্চিত যাত্রা, নিশ্চিত দুর্ভোগ

ছিনতাই হওয়ার আড়াই দিন পর সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুদের আস্তানা ‘বাজহাকুন’ পৌঁছায় জাহাজটি। নোঙর করার পরপরই আরও ৫০-৬০ সশস্ত্র লোক জাহাজে উঠে গেল।

এর পরের কাহিনি শোনা যাক জাফর ইকবালের মুখেই, ‘বাজহাকুন থেকে আবার জাহাজ ছুটল গারাকার উদ্দেশে। জলদস্যুদের শেষ আস্তানায় পৌঁছানোর তিন দিন পর একজন এলেন, জানতে পারলাম তিনি মধ্যস্থতাকারী। লোকটি শিক্ষিত, ভালো ইংরেজি জানেন। নাম আলী জামান। তিনি সবার উদ্দেশে বললেন, “জলদস্যুরা কারও কোনো ক্ষতি করবে না। চাহিদা অনুযায়ী টাকা পেলে সবাইকে ছেড়ে দেবে।” তাতে আমাদের উদ্বেগ একটু কমে।’

জাফর ইকবাল জানান, ছিনতাই হওয়া প্রতিটি জাহাজে এ রকম একজন মধ্যস্থতাকারী থাকে, বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে তাকে আনা হয়। কারণ, জলদস্যুরা জাহাজ ছিনতাই করতে পারে, কিন্তু মুক্তিপণ আদায়ের মহাযজ্ঞ কীভাবে শেষ করতে হয়, তা তারা জানে না। ৩০-৪০ জন জলদস্যু পালা করে নাবিকদের পাহারা দিত। জাহাজের ওপর থেকে নিচে যেতে অনুমতি নিতে হতো, সঙ্গে সশস্ত্র পাহারা থাকত। আর কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ ও সমঝোতার কাজটা করত মধ্যস্থতাকারী।

এরপর কী হলো? প্রশ্নটার উত্তর দেন গিয়াস। তিনি বলেন, ‘১৫-১৬ দিন জলদস্যুরা চুপচাপ ছিল। একদিন আলী জামান আমাদের সামনেই ইংরেজিতে একটা ড্রাফট করলেন, তাতে কোম্পানির উদ্দেশে লেখা হলো, তোমাদের জাহাজ আমাদের কবলে। ১৫ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দাও, সবাইকে ছেড়ে দেব। জাহাজ থেকেই ফ্যাক্স করে তা পাঠানো হলো কোম্পানির জার্মানির কার্যালয়ে। এবার শুরু হলো দুই পক্ষের দরকষাকষি। আমাদের জীবনটাও তখন দরকষাকষির ফাঁদে পড়ে গেল।’

নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য যুদ্ধজাহাজ থাকার পরও গালফ অব এডেনে চলাচলকারী জাহাজ জলদস্যুর কবলে পড়ে কীভাবে?

এই প্রশ্নের উত্তর দেন দুজনে মিলে, ‘মনে করুন সাত-আটটি জাহাজকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য কয়েকটা যুদ্ধজাহাজ টহলে থাকে। কিন্তু এমন নয় যে এগুলো এক-দুই নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই থাকে। বিপৎসংকেত পাওয়ার পর আক্রান্ত জাহাজের কাছে আসতে অন্তত ১০-১৫ মিনিট সময় তো লাগে। ওই সময়ের ভেতরেই জাহাজটাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় জলদস্যুরা। আর তারা তো জিম্মি করে মানুষকে। নইলে যুদ্ধজাহাজগুলো ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারে জলদস্যুদের।’

জলদস্যুদের আস্তানায় ১৫-২০ দিন অবস্থানের পর জাহাজের খাবার ফুরিয়ে যায়। সবার মনে ভয়, ‘ওরা আমাদের না খাইয়ে মারবে না তো?’ সে ভয় অচিরেই দূর হলো। যেদিন খাবার ফুরাল, সেদিনই জলদস্যুরা ছোট বোটে করে সওদা নিয়ে এল। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন, হলুদ, পেঁয়াজ এমনকি কাঁচামরিচও নিয়ে এল তারা। সঙ্গে আনল একজন পাচক। জাহাজের পাচক রান্না করে ক্রুদের জন্য, আর জলদস্যুদের জন্য ওদের পাচক। রান্নাটাও হয় আলাদা।

আপনারা কী খেতেন? গিয়াসের জবাব, ‘আমরা তো ভারতীয় খাবারে অভ্যস্ত। আমি আর জাফর ভাই মাঝেমধ্যে আলুভর্তাও খেতাম। তবে ওরা সারা দিন ছাগলের মাংস চিবাত। দুই দিন পর পর জাহাজে বড় ছাগল নিয়ে আসত। জবাই করার পর ছেড়ে দেওয়া হতো আস্ত এক ডেকচিতে। লবণসেদ্ধ মাংস খেত পরম তৃপ্তি নিয়ে।’

তাঁরা জানান, জলদস্যুরা দিনে দুবার মাদক সেবন করত। গাছের ছালের মতো একটা জিনিস চিবিয়ে চিবিয়ে খেত, সঙ্গে প্রচুর চিনি। তাতে রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে থাকতে পারত ওরা।

পানির বিনিময়ে তেল

জাহাজে জ্বালানি ছিল ৫০ দিনের। তেল ফুরালে জীবনের আশাও ফুরাল সবার! সমাধান দিল জলদস্যুরাই। তাদের কবলে ছিল তখন সাত-আটটি জাহাজ। যেসব জাহাজে অতিরিক্ত তেল ছিল, সেগুলো থেকে তারা তেল নিয়ে আসত।

জাফর বলেন, ‘আমরাও কিন্তু বসে ছিলাম না। প্রতিদিন তিন টন পানি (ফ্রেশ ওয়াটার) বিশুদ্ধ করতাম। অনেক ছোট জাহাজে “ফ্রেশ ওয়াটার” বানানোর সুযোগ ছিল না। আমরা তাদের পানি দিতাম, বিনিময়ে তেল আনতাম।’

তেল আনার জন্য মাঝেমধ্যে ক্রুদেরও নিয়ে যেত জলদস্যুরা। সশস্ত্র দুজনের সঙ্গে একবার গিয়েছিলেন গিয়াস। ‘স্যাম হো ড্রিম’ নামের ওই জাহাজের ক্রুদের সঙ্গে টুকটাক কথাও হয়েছিল তাঁর। তাঁদের অবস্থা ছিল গিয়াস আর জাফরদের মতোই। মুক্তির আশায় অসহনীয় দিন কাটছিল তাঁদের।

ঈদের আনন্দে সুরের ছন্দ

মে মাসের শেষদিকে পরিবারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার সুযোগ দেওয়া হয় জিম্মিদের। তবে সময় এক-দেড় মিনিটের বেশি দেওয়া হতো না। জিম্মি-জীবনের দুঃসহ দিনগুলো কীভাবে কাটত? এমন প্রশ্নের উত্তরে গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘প্রাথমিক টেনশন একটু কমার পর রাতে ঘুম হতো ভালো। তখন মোটামুটি বুঝতে পারছিলাম ওরা হয়তো আমাদের প্রাণে মারবে না। আমি আর জাফর একসঙ্গেই থাকতাম। একসঙ্গে খেতে যেতাম, পাশাপাশি ঘুমাতাম।’ 

গত ২৭ আগস্ট (২০১০ সাল) গিয়াসের সঙ্গে শেষ কথা হয় তাঁর পরিবারের লোকজনের সঙ্গে। সেদিন তাঁর মা শিরিন আকতার আর স্ত্রী বিবি ফাতেমা বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কাছে নামাজ পড়ে দোয়া চাইছি, ঈদের আগেই যেন তুমি মুক্তি পাও।’

সেদিনই গিয়াস জলদস্যুদের কাছে জানতে চাইলেন ঈদ কবে? তারা বলল, ‘বিবিসি শোনো, তারপর জানবে।’ তবে জলদস্যুরাও চমকে দিয়েছিল নাবিকদের। ‘ঈদের আগের দিন রাতে গানের সিডি নিয়ে আসে জলদস্যুরা, ঈদের দিন সেটা চালিয়ে দেয় জাহাজে। পাচক সেমাই রান্না করেছিল।’ বললেন জাফর ইকবাল।

সোমালিয়ার জলদস্যু
ছবি: এপি

আকাশ থেকে নামল ডলার

২৭ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে সাতটা। জলদস্যুদের হুকুমে ঘুম ঘুম চোখে জাহাজের ডেকে যেতে বাধ্য হন জাফর ইকবাল ও গিয়াস উদ্দিন। দেখলেন বাকি ১৯ জনও আছেন সেখানে, ক্যাপ্টেন মাখানে ছিলেন ব্রিজে। সাগরের জাহাজে ৬০ জন সশস্ত্র জলদস্যু যেন যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত। তখনই আকাশে উড়ে এল সাদা রঙের জেট বিমান। চোখের পলকে পাঁচজন জলদস্যু দুই ভাগ হয়ে দুটি স্পিডবোটে উঠে গেল। বোট দুটির মাঝখানে কয়েক গজ জায়গা। জেট বিমান খুব নিচু হয়ে অনেকটা জাহাজের গা-ঘেঁষে চক্কর দিল। এরপর উধাও।

কয়েক মিনিট পর আবার এল সেই বিমান, এবার জাহাজের ওপর চক্কর দিয়ে স্থির হলো। নাটকের শেষ অঙ্কে সর্বনাশের আশায় যেন রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা সবার। হঠাৎ বিমান থেকে প্যারাসুটে বাঁধা সিলিন্ডারের মতো একটি বস্ত্ত ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগল। বস্ত্তটি এসে পড়ল জলদস্যুদের দুই স্পিডবোটের ঠিক মাঝখানে পানিতে, তবে সেটি ডুবল না। ওটা ছোঁ মেরে নিয়ে একদল উঠে গেল জাহাজে।

আবার উধাও বিমানটি। মিনিট চার পর শোনা গেল বিমানের কান ফাটানো শব্দ। জাহাজের ওপরে এসে বিমানটি একই জায়গায় একই কায়দায় সিলিন্ডার-জাতীয় আরেকটি বস্ত্ত ফেলল। সেটি নিয়ে জাহাজে উঠে গেল অপর দলটি।

প্লাস্টিকে মোড়ানো বস্ত্তটি খোলার পর দেখা গেল ডলারের মেলা। এরপর গোনার পালা। আগের দিনই জলদস্যুরা ডলার গোনা ও ভেজাল শনাক্ত করার যন্ত্র এনে রেখেছিল জাহাজে। পাক্কা তিন ঘণ্টা গোনার পর কালো মানুষগুলোর মুখটা আলোয় ভরে গেল।

রাতভর চলল ডলার ভাগাভাগি, যার যা প্রাপ্য তা নিয়ে মধ্যরাত থেকে শুরু হলো জলদস্যুদের প্রস্থান। ২৮ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় শেষ দলটি জাহাজ ত্যাগ করে।

সেই মুহূর্তের অনুভূতির কথা বললেন জাফর ইকবাল, ‘মনে হলো আকাশ থেকে নামল একপশলা করুণাধারা। তখন জাহাজে আনন্দের মাতম, চলছে নাবিকদের নাচ। নাবিকেরা ছিলেন বাংলাদেশ, ভারত আর ইউক্রেনের। তিন সংস্কৃতির মানুষের নৃত্যের ছন্দ তিন রকম। কিন্তু আনন্দের ভাষা ছিল একই, ‘আমরা আজ মুক্ত।’