ডিজাইনার হিসেবে যেমন, স্থপতি হিসেবেও তেমনই সংবেদনশীল রিজভী হাসান

প্রতি বাংলা নববর্ষের মতো ১৪৩২ সনেও দেশের ক্রীড়া, অভিনয়, গবেষণা, স্থাপত্যসহ নানা ক্ষেত্রের তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে হাজির হয়েছে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। একঝাঁক উজ্জ্বল তরুণকে নিয়ে দুই পাতার আয়োজন থেকে পড়ুন স্থপতি রিজভী হাসানের গল্প।

রিজভী হাসানছবি: সংগৃহীত

ঢাকা ছেড়ে নিজের শহর ঝিনাইদহে এসেছি বেশ কয়েক বছর। এখানে ‘আরবান রিভার স্পেসেস’ নামের একটি উদ্যোগের মাধ্যমে আগামীর ঝিনাইদহ গড়ার কাজ করছিলাম। নবগঙ্গাপারের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে হাঁটার পথ, বাগান, নাগরিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার সুবিধাসহ বাসযোগ্য শহর গড়ে তোলার সেই আয়োজনে যুক্ত ছিলেন বুয়েটের কয়েকজন। ২০১৭ সালের শেষ দিকে তাঁদের সঙ্গেই আমার অফিসে এলেন রিজভী হাসান। এই কাজের একটি প্রজেক্টের সঙ্গেও যুক্ত হলেন। ‘পন্ড সাইড কমিউনিটি নেটওয়ার্ক’ বা পুকুরপারের বাসিন্দারা কীভাবে তাঁদের পুকুরগুলোকে সুন্দর করে তুলতে পারে, মানুষ আর না-মানুষ সবারই কাজে লাগে—সেই বিষয়ে কাজ। স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে মিশে সপ্তাহখানেকের মধ্যে কাজটা দারুণভাবে করে ফেলেন রিজভী।

তখন তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্যে স্নাতক করে ঢাকায় একটি বড় প্রতিষ্ঠানে যুক্ত। রিজভীর কাছে তাঁর লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে চাইলাম। কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম, আমাদের মতোই মাথায় প্রশ্ন নিয়ে ঘুরছেন তিনি। মানে, আমাদের স্থাপত্যের অর্জিত জ্ঞানটা কি শুধু টাকাওয়ালা অল্পসংখ্যক মানুষের বাড়ি-অফিস ডিজাইনেই আমরা সীমাবদ্ধ রাখব, নাকি গণমানুষের কাজে লাগে, তাঁদের সঙ্গে মিলেমিশে করা যায়, এমন কাজ করার চেষ্টা করব—

এরপর জানতে পারলাম ঢাকার চাকরিটা রিজভী ছেড়ে দিয়েছেন। ঝিনাইদহের কাজটা সম্ভবত তাঁকে শান্তি দিয়েছিল। সেই শান্তির খোঁজেই নানা জায়গায় ঘুরে ব্র্যাকের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্প প্রকল্পে যুক্ত হলেন। স্থপতি সাদ বিন মোস্তফার সঙ্গে মিলে সুন্দর সব কাজ করতে লাগলেন রিজভী। ‘বিয়ন্ড সারভাইভাল: আ সেফ স্পেস ফর রোহিঙ্গা উইমেন অ্যান্ড গার্লস’ নামের প্রকল্পে শরণার্থীশিবিরের কমিউনিটি সেন্টার গড়লেন। দেখতে খুদে স্টেডিয়ামের মতো। গ্যালারির মতো অংশটি ঘর। মাঝে ছোট খোলা আঙিনা। বাঁশের কাঠামোতে শণের ছাউনি ঘর। ঘরের ভেতরে রংবেরঙের নকশা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এত সুন্দর কাজ হবে কেউ ভাবেনি। মানুষজনের সঙ্গে মিলেমিশে ডিজাইনটা করেন রিজভীরা। সেখানে যাঁরা মিস্ত্রি তাঁদের পরামর্শ, দক্ষতা, শিল্পমন স্থাপত্যে যুক্ত করেন। রিজভীর এই কাজ নিয়ে প্রতিবেদন করে যুক্তরাজ্যের পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান। ২০২০ সালে জাতিসংঘের ‘রিয়েল লাইফ হিরো’র স্বীকৃতি পান রিজভী। ২০২২ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক সম্মানজনক আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার পায় এই কাজ। রোহিঙ্গা প্রকল্পের সঙ্গে যৌথভাবে আমাদের ‘আরবান রিভার স্পেসেস’ও আগা খান পুরস্কার পায়। আমরা সবাই মিলে পুরস্কার আনতে গিয়ে আয়োজকদের হাসতে হাসতে বলেছিলাম, ‘তোমরা তো আসলে একটা টিমকেই দুইটা পুরস্কার দিয়েছ!’

রিজভী হাসান ডিজাইনার হিসেবে যেমন, স্থপতি হিসেবেও তেমনই সংবেদনশীল। কাজের ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষের প্রতি, ঐতিহ্য ও ম্যাটেরিয়ালের প্রতি তাঁর দারুণ পক্ষপাত। আমার কাছে তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ স্থপতি। অন্য স্থপতিদের মতো তিনিও মানুষের বাড়িঘর নকশা করেন। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে তাঁর আর খাজা ফাতমীর অফিসও আছে। তবে সেসব কাজ আমাদের দেশের জলবায়ু, ঐতিহ্যকে ধারণ করে। কাজ পেলেই করে ফেলার তাগাদা তাঁর নেই। নিজের ওপর নিজেই যেন দায়বদ্ধতা আরোপ করেছেন। তাঁর কাজে ক্লায়েন্টদেরও উদ্বুদ্ধ করেন।

জনমানুষের স্থাপত্যে আগ্রহী, এমন তরুণদের পথপ্রদর্শকও হয়ে উঠেছেন রিজভী। তার চেয়ে কম বয়সী তরুণদের তিনি আশ্রয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের সঙ্গে তাঁর খুব ওঠাবসা। ফাইনাল ইয়ারের থিসিসে অনেকেই রিজভীদের কাজ থেকে প্রভাবিত হচ্ছেন। নিজেরাও বিভিন্ন আয়োজনে বিচারক হিসেবে এবং মেন্টর হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাচ্ছেন।

রিজভী হাসান খুবই দক্ষ একজন মানুষ। ড্রাইং, ফিল্ম বানানো থেকে খুঁটিনাটি অনেক কিছু নিজেই করেন। যদিও একা সব কাজ করা আমাদের দর্শনের সঙ্গে মেলে না, আমরা টিম গঠন করে কাজ করি। তবু রিজভী চাইলে নিজেই অনেক কিছু করতে পারেন।

এই তরুণ স্থপতি তাঁর পথেই থাকুন, এই তো প্রত্যাশা।

খোন্দকার হাসিবুল কবির: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যকলা বিভাগের শিক্ষক ও কো-ক্রিয়েশন আর্কিটেক্টসের সহপ্রতিষ্ঠাতা