তামিমের কাছে উপহার পাওয়া টিকিটে খেলা দেখেছেন বরিশালের শাহীন

৩৫ বছরের শরীরটা ১৮ ইঞ্চিতেই আটকে আছে। তবে জীবনের পথচলা থেমে থাকেনি, থেমে থাকেনি স্বপ্ন দেখাও। প্রিয় ক্রিকেটার তামিম ইকবালের সঙ্গে সাক্ষাৎ তেমনই একটি স্বপ্ন ছিল। বরিশাল থেকে সিলেটে আনিয়ে তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ওডিআই অধিনায়ক। শাহীন ফকির–এর জীবনের আরও গল্প শুনলেন এম জসীম উদ্দীন

সিলেটে তামিম–মুশফিকদের সঙ্গে শাহীন ফকির
ছবি: সংগৃহীত

আমার জন্মের সাত দিন যেতে না যেতেই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি। জ্বরসহ নানা উপসর্গ। উদ্বিগ্ন মা-বাবা আমাকে বরিশালে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলেন। দেখেশুনে দ্রুত ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক। কিন্তু পরিবারের মানুষেরা বিষয়টা অতটা গুরুত্ব দিলেন না। হয়তো ভেবেছিলেন, এমনি এমনিই আমি ঠিক হয়ে যাব। তার ওপর আর্থিক টানাপোড়েনও ছিল। ঢাকায় না নিয়ে বাড়ি ফিরে যান তাঁরা।

মুলাদীর চর কমিশনার এলাকায় আমাদের বাড়ি। আমরা দুই ভাই, চার বোন। শুনেছি, বাড়িতে আনার কিছুদিন পর নাকি আমি সুস্থও হয়ে যাই। তবে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দুই পা সরু হতে থাকে। দিনে দিনে পা দুটি বাঁকা হয়ে সংকুচিত হয়ে যায়। কখনো দুই পায়ে ভর করে আমার হাঁটা হয়নি। অন্যের সহযোগিতায় দৈনন্দিন সব কাজ করেছি।

আরও পড়ুন
নিজের দোকানে শাহীন
ছবি: সংগৃহীত

আমার একটা দোকান আছে

কখনো বাবা, কখন ভাইয়ের কাঁধে চড়ে স্কুলে যেতাম। তাঁদের ব্যস্ততা থাকলে যাওয়া হতো না। তবে পরীক্ষা দিতাম নিয়মিত। এভাবে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। তারপর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি।

নিজের প্রতিবন্ধিতাকে কারও ওপরে চাপিয়ে দিতে ইচ্ছা করত না। যখন মনে হতো কারও বোঝা হয়ে বেঁচে আছি, খুব কষ্ট হতো। সারা দিন ঘরে বসে বসে ভাবতাম, কিছু একটা করা দরকার। অন্তত নিজের খরচ নিজেরই জোগাড় করা দরকার। একদিন ঠিক করলাম, গ্রামেই একটা ছোট্ট দোকান দেব। বিস্কুট, চকলেট, চানাচুর, চিপস ইত্যাদি থাকবে। কিন্তু দোকান করতে পুঁজি দরকার, ঘর দরকার। তা পাব কোথায়? জীবনের অনেকগুলো বছর এভাবে কেটে যায়। পরে ২০১৮ সালে আমার ইচ্ছার কথাটা সবাইকে জানাই। আমার প্রস্তাবে পরিবারের সবাই আনন্দিত হয়, তবে তাদের মনে শঙ্কা, আমি তো চলাফেরা করতে পারি না। কীভাবে দোকান চালাব? তারপরও আমার প্রবল আগ্রহ দেখে মূলধন দেয় তারা। একজন ছেলে নিই। নিজে উপস্থিত থেকে ছোট্ট একটা ঘর তুলি। শুরু হলো আমার জীবনযুদ্ধের নতুন অধ্যায়।

আরও পড়ুন
গ্যালারিতে বসে বাংলাদেশ–আয়ারল্যান্ড সিরিজের প্রথম ম্যাচ দেখেছেন শাহীন
ছবি: সংগৃহীত

বাড়ি থেকে সামান্য দূরে সড়কের পাশে আমার দোকান। শুরুতে সামান্য আয় হতো। এরপর মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিতে শুরু করি। এটা আমি নিজেই করি। এখন মাসে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা আয় হয়। পরিবার এখন সচ্ছল। আমার আয়ের টাকা তাদের দরকার হয় না। তবু নিজের আয় নিয়ে গর্ব হয়, নিজের মতো খরচ করতে ভালো লাগে।

স্বপ্ন হলো সত্যি

আমার বয়সীদের খেলতে দেখে খুব মাঠে নামতে ইচ্ছা হতো। কিন্তু নিজে তো কোনো দিন খেলতে পারিনি। সেই অতৃপ্তি থেকেই হয়তো ছোটবেলা থেকে খেলাধুলা দেখার প্রতি ভীষণ ঝোঁক। বিশেষ করে ক্রিকেট। যখনই বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই ক্রিকেট দেখি। বাংলাদেশের খেলা থাকলে সেদিন আর অন্য কিছুতে মন বসে না। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সবাই আমার পছন্দের খেলোয়াড়, তবে আমার প্রিয় তামিম ইকবাল। তাঁর খেলা যেমন ভালো লাগে, তেমনি তাঁর অন্য কাজগুলোও।

তামিম ইকবালের সঙ্গে একবার দেখা করার সুপ্ত একটা ইচ্ছা আমার ছিল। এই কথা আমার পরিচিতজনেরা জানেন। একদিন এক সাংবাদিক আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন করতে এলে তাঁকেও ইচ্ছার কথাটা বলেছিলাম। তিনি আমাকে নিয়ে লেখার পর তামিম ইকবালও বিষয়টা জানতে পারেন। ওই সাংবাদিকের মাধ্যমেই জানতে পারি, তামিম আমাকে সিলেটে ডেকেছেন।

একে তো পথঘাট চিনি না, তার ওপর আমার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। তাই আমার দুই ভাগনে আর দুজন প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে সিলেটের পথ ধরি। ১৬ মার্চ আমরা বরিশাল আসি। সেখান থেকে ঢাকার সায়েদাবাদ। তারপর সিলেটের বাসে পরদিন সকালে সিলেট পৌঁছাই। আম্বরখানা এলাকায় একটা হোটেলে উঠি আমরা। সেদিন বিকেলে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যে হোটেলে উঠেছে, সেখানে আমাদের সময় দেন তামিম ইকবাল।

চোখের সামনে তামিমকে দেখে শুরুতে কথাই বলতে পারছিলাম না। তামিম ইকবাল আমার পোলিওর বিষয়ে জানতে চান, আমার পরিবারের কথা, আমি নিয়মিত খেলা দেখি কি না, জানতে চান। জানতে চান বাংলাদেশ দলের আর কার খেলা ভালো লাগে। পুরোনো কথাই আবার বলি, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সবাই আমার পছন্দের খেলোয়াড়, তবে আপনি প্রিয়।

তামিম তখন মুশফিকুর রহিমকে ফোন করে আমার কথা বলেন। মুশফিক দ্রুতই চলে আসেন, আসেন শাহরিয়ার নাফীস, নাফিস ইকবাল। সবার সঙ্গেই ছবি তুলি। তামিম ইকবালের সঙ্গে সেলফি তুলতে চাইলে তিনি নিজেই আমার সঙ্গে সেলফি তোলেন। মুশফিকুর রহিমও আমার সঙ্গে সেলফি তোলেন।

এরপর যা হলো, তা আমার কল্পনারও অতীত। তামিম ইকবাল রুম থেকে একটি জার্সি এনে অটোগ্রাফসহ আমাকে উপহার দিলেন। বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড সিরিজের প্রথম ম্যাচ ছিল পরদিন ১৮ মার্চ। সেই ম্যাচের পাঁচটি টিকিটও আমাকে উপহার দিলেন। গ্যালারিতে বসে বাংলাদেশের খেলা দেখার স্বপ্নটাও পূরণ করেন তামিম। আমার সঙ্গে যারা ছিল, তাদেরও জার্সি দেন। আমার বরিশালের মুলাদী থেকে সিলেটে যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থাই করেন তামিম।

প্রিয় খেলোয়াড়কে সামনে থেকে দেখা, এত এত উপহার পাওয়ার অনুভূতি আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। সেই সময়টা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। জীবনে অনেক দিন আসবে, কিন্তু এমন স্বপ্নপূরণের দিন হয়তো কমই আসবে।