আমিরা হককে কাছ থেকে দেখা
২০১১ সালে পূর্ব তিমুরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের প্রধান ছিলেন বাংলাদেশের নারী আমিরা হক। তিনি সেখানে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের কোনো নারী জাতিসংঘের এত উচ্চ পদে আগে কখনো কাজ করেননি। সে সময় আমি পূর্ব তিমুরে জাতিসংঘ শান্তি মিশনের বাউকাউ অঞ্চলে আঞ্চলিক প্রশাসক হিসেবে কাজ করতাম। তখন যাঁকেই জিজ্ঞাসা করেছি, প্রায় সবাই আমিরা হককে নিয়ে চমৎকার ইতিবাচক কথা বলেছেন। প্রথম যেদিন আমিরা হকের কার্যালয়ে গেলাম, তিনি আন্তরিকভাবে আমার খোঁজখবর করলেন। নানা বিষয়ে কথা হলো। এমন গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, সংবেদনশীল মানুষ আমি খুব বেশি দেখিনি। পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উৎসবে-অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাঁর ব্যক্তিত্বের ছটা সব সময়ই আমাকে আলোকিত করেছে।
আমিরা হকের নেতৃত্বে জাতিসংঘের মিশনটির সঙ্গে পূর্ব তিমুরের নানা স্তরের মানুষের সুন্দর সম্পর্ক গড়া ওঠে। আমিরা হক পূর্ব তিমুরের সরকারি ও বিরোধী দলের নেতা, মিলিটারি, পুলিশ, সিভিল সোসাইটি এবং আইন ও বিচার বিভাগের নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে দেখা করেন, বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে প্রয়াসী হন। পুরো দেশটাই তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন, দেখা করেছেন স্থানীয় কর্মকর্তা এবং নারীনেত্রীদের সঙ্গে। বহু উদ্যোগ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তিনি পূর্ব তিমুরে জাতীয় পুলিশ বাহিনীর সক্ষমতা বাড়িয়েছেন, যা সচরাচর অন্য শান্তিরক্ষা মিশনগুলোয় দেখা যায় না।
যে তিন বছর তিনি পূর্ব তিমুরে ছিলেন, স্থানীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন, যাতে করে মিশন বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরা অন্য কোথাও ভালো চাকরি পান বা উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন
পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতাসংগ্রামে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছের। তবু যুদ্ধ ও সংঘাত-পরবর্তী সময়ে সেখানে নারী নির্যাতন খুব বেড়ে যায়। নারী নির্যাতন রোধে আমিরা হকের নেতৃত্বে জাতিসংঘ শান্তি মিশন তখন বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়। জাতিসংঘের হাতে তখন দেশটির পুলিশিং এবং নির্বাহী ক্ষমতা। পূর্ব তিমুরে অধিকসংখ্যক নারী পুলিশ কর্মকর্তা পাঠানোর জন্য মিশন তখন জাতিসংঘে পুলিশ সরবরাহকারী দেশগুলোর কাছে অনুরোধ করে। জাতিসংঘের পুলিশ কর্মকর্তারা নারীবান্ধব পুলিশ স্টেশন, নারীদের জন্য নিরাপদ আবাস তৈরি করেন। নির্যাতিত নারীরা এখানে কিছুদিনের জন্য আশ্রয় নিতে পারতেন। ওখানকার পুলিশ স্টেশনগুলোয় শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে ইউনিসেফ। দেয়ালে উজ্জ্বল রং করা হয়, মায়েরা থানায় অভিযোগ করতে এলে সঙ্গে আসা শিশুরা যেন আনন্দে থাকে। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ওপরও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন আমিরা হক। মিশনে কমিউনিটি পুলিশিংয়ে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পাঠানোর জন্য জাতিসংঘের পুলিশ কন্ট্রিবিউটিং দেশগুলোকে অনুরোধ করেছেন।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনটি পূর্ব তিমুরের যাবতীয় সংঘাত নিরসন করে। দেশটিতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করে। নারীর ক্ষমতায়নেও নানা গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে মিশন। ২০১২ সালে জাতিসংঘের পূর্ব তিমুর মিশন বন্ধ হওয়ার আগে মিশনের পুলিশ, মিলিটারি এবং স্টাফদের নিয়ে প্রায়ই টাউন হলে মিটিং করতেন আমিরা হক। প্রতিটি মিটিংয়েই বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তর পর্বে তাঁর সংবেদনশীলতা আর প্রজ্ঞার প্রকাশ ঘটত। তিনি জানতেন, মিশন বন্ধ হয়ে গেলে এখানে কর্মরত স্থানীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবাই চাকরি হারাবেন। তাই দীর্ঘ সময় নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতেন, তাঁদের বোঝাতে চেষ্টা করতেন, মিশন বন্ধ হওয়ার মানে হচ্ছে দেশটির এবং দেশের জনগণের সাফল্য।
যে তিন বছর তিনি পূর্ব তিমুরে ছিলেন, স্থানীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন, যাতে করে মিশন বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরা অন্য কোথাও ভালো চাকরি পান বা উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। মিশন বন্ধ হওয়ার আগে তিনি ট্রানজিশন প্ল্যান (অন্তর্বর্তীকালীন পরিকল্পনা) করেন, যার সভাপতি ছিল দেশটির প্রেসিডেন্ট। তা ছাড়া পূর্ব তিমুরের প্রধানমন্ত্রী, বহু মন্ত্রী, পুলিশ, মিলিটারিপ্রধানও এই ট্রানজিশন প্ল্যানে অংশ নিয়েছেন। জাতিসংঘের ইতিহাসে এটাই প্রথম শান্তিরক্ষা মিশন, যাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ অন্তর্বর্তীকালীন পরিকল্পনা ছিল। জাতিসংঘের অন্য শান্তিরক্ষা মিশনগুলোর কাছে পূর্ব তিমুর মিশনের ট্রানজিশন রোল মডেল হিসেবে কাজ করে।
পূর্ব তিমুরের বাউকাউ অঞ্চলে জাতিসংঘ শান্তি মিশনের আঞ্চলিক প্রশাসক হিসেবে আমি যখন কাজ করি, আমিরা হক একবার বাউকাউ এসেছিলেন। তিনি আমার অফিস সহকারী, অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ, মিলিটারিসহ যাঁদের সঙ্গেই কথা বললেন, সবাইকে যথাযোগ্য সম্মান ও শ্রদ্ধা দিয়েই তা করলেন, সবার খোঁজখবর নিলেন। মিশনপ্রধানের এমন আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণে সবাই মুগ্ধ হয়েছিলেন। ঊর্ধ্বতনরা অধস্তনদের সঙ্গে সচরাচর কীভাবে কথা বলেন, আমার তা জানা আছে বলেই আমারও মুগ্ধতার শেষ ছিল না।
আমিরা হক জাতিসংঘের ফিল্ড সাপোর্ট ডিভিশনের আন্ডারসেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। সে সময় তিনি পৃথিবীর সব শান্তিরক্ষা মিশন, সব ফিল্ড মিশনের সাফল্যের লক্ষ্যে কাজ করে যান। জাতিসংঘ থেকে অবসরে যাওয়ার পরপরই তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন, আমিরা হককে হাই লেভেল ইনডিপেনডেন্ট প্যানেল অব পিস অপারেশনে (এইচআইপিপিও) ভাইস চেয়ার হিসেবে কাজ করার জন্য অনুরোধ করেন এবং নিয়োগ দেন। ভবিষ্যতের শান্তিরক্ষা মিশন কেমন হতে পারে, আর জাতিসংঘ নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত কি না, এসব নিয়ে কাজ করে এই প্যানেল। আমিরা হক সুদান ও আফগান শান্তিরক্ষা মিশনে জাতিসংঘ মহাসচিবের ডেপুটি স্পেশাল রিপ্রেজেনটেটিভ এবং হিউম্যানিটারিয়ান কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি সুদানে যখন কাজ করেন, আমি তখন সুদানের দারফুরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আছি। আমিরা হক সে সময় অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং বৈষম্যের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষদের জীবনে পরিবর্তন আনতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছেন। তিনি ক্যাম্পে ঘরবাড়িহীন উন্মূল মানুষদের সঙ্গে দেখা করেছেন, তাঁদের সান্ত্বনা দিয়েছেন, তাঁদের অবস্থা পরিবর্তনে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন, তাঁর অফিসের মাধ্যমে ক্যাম্পের অসহায় মানুষদের কাছে মানবিক সাহায্য পৌঁছে দিতে প্রয়াস পেয়েছেন।
আন্ডারসেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে কাজ করার সময় প্রায় আট বছর পর আবারও দারফুরে যান আমিরা হক। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আট বছর পর দারফুরে গিয়ে দেখেন, সেখানকার মানুষের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। যদিও তাদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য নানা উদ্যোগ এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া তখনো অব্যাহত ছিল। উদ্বাস্তু মানুষেরা আগে যেখানে তাঁবুতে থাকত, এখন সেখানে কিছু ইটের দেয়ালের ঘর উঠেছে। আইডিপি ক্যাম্পই একটা উপশহরের মতো গড়ে উঠেছে। ক্যাম্প এবং বাইরের বাস্তুচ্যুত মানুষগুলো তখনো জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা থেকে পাওয়া খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসাসেবার ওপর নির্ভরশীল। আন্ডারসেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে সে সময় তিনি পৃথিবীজুড়ে গৃহহীন, শরণার্থী মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের দুর্ভাগ্য দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেন এবং জাতিসংঘের সব শান্তিরক্ষা মিশনের সাফল্যের জন্য নিরলস কাজ করে যান।
শৈশবে কিছুদিন ঢাকার হলি ক্রস স্কুলে পড়েছেন আমিরা হক। তবে তাঁর স্কুলজীবনের প্রায় পুরোটাই কাটে ভারতের শিলংয়ে, লরেটো কনভেন্টে। শিলংয়ের নয়নাভিরাম প্রকৃতি আর লরেটো কনভেন্টের শিক্ষার পরিবেশ তাঁকে উদারমনা, আত্মবিশ্বাসী, স্বাধীনচেতা এবং স্বনির্ভর তরুণী হিসেবে গড়ে তুলেছে। ষাটের দশকে ঢাকার হলি ক্রস কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। সেই ষাটের দশকেই তাঁর উদারমনা পিতা-মাতা উচ্চমাধ্যমিক পাস করা কন্যাকে স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনার জন্য আমেরিকায় পাঠান। বৃত্তি নিয়ে ওহাইওতে ওয়েস্টার্ন কলেজ অব উইমেনে পড়তে যান আমিরা। কলেজটি ছিল তরুণ স্কলারদের চমৎকার এক কমিউনিটি। পরে তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব সোশ্যাল ওয়ার্ক থেকে কমিউনিটি অর্গানাইজিংয়ে মাস্টার্স করেন। এখানে পড়ার সময় তিনি অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করেন। দ্বিতীয় মাস্টার্স করেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ব্যবসা প্রশাসনে।
১৯৭৬ সালে ইন্দোনেশিয়ার ইউএনডিপিতে জুনিয়র অফিসার হিসেবে যোগ দেন তিনি। দুই বছর পর আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় ইউএনডিপির অ্যাসিস্ট্যান্ট রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে সেখানে যোগদান করেন। ইউএনডিপির রেসিডেন্স রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে লাওস ও মালয়েশিয়ায় কাজ করেন ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। বাস্তুচ্যুত, শিক্ষা-সংস্কৃতিবঞ্চিত শরণার্থী অসহায় মানুষদের জন্য কাজ করেছেন তাঁর ক্যারিয়ারের প্রায় পুরো সময়।
বর্তমানে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি বক্তা হিসেবে বক্তৃতা করেন, পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে ইনস্টিটিউট এবং শান্তি ও নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেন, তাদের সভা-সেমিনারে বক্তৃতা দেন। কর্মযোগী এই নারীর অর্জন ও সাফল্য বাংলাদেশের বহু নারীকে সাহস জোগাবে, স্বপ্ন দেখাবে এবং সেই স্বপ্নপূরণে কঠোর পরিশ্রম করতে অনুপ্রাণিত করবে।