ঈদে শ্বশুরবাড়ি, নাকি মা–বাবার বাড়ি

ছেলে তাঁর স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে নিজের বাড়িতে ঈদ করবেন, এ যেন আমাদের সমাজের এক পরিচিত চিত্র। (ছবিটি প্রতীকী)
ছবি : কবির হোসেন

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এবার পবিত্র ঈদুল ফিতরে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়বেন। ধারণা করি, এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে অধিকাংশ পুরুষ যাবেন তাঁদের মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করতে, সঙ্গে থাকবেন স্ত্রী-সন্তান। কত শতাংশ নারী তাঁর মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করতে যাবেন বা যেতে পারবেন, সে প্রসঙ্গে অবশ্য কোনো পরিসংখ্যান চোখে পড়ে না। তবে এটা জানি, আজও বাংলাদেশের বিবাহিত নারীদের একটা বড় অংশ নিজের মা-বাবার সঙ্গে ঈদ-পূজার মতো উৎসব উদ্‌যাপনের কথা ভাবতেও পারেন না। মেয়ের মা-বাবাও ভাবতে পারেন না, মেয়ে-জামাই-নাতি-নাতনি নিয়ে ঈদ করার কথা। অনেকে বলতে পারেন, এসব আগে হতো। এখন নারীরা স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাঁরা নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারেন, চাইলেই নিজের মা-বাবার সঙ্গেও ঈদ করতে পারেন। আদতে পরিস্থিতি কতটুকু বদলেছে, তা জানতে প্রশ্ন করেছিলাম নারীবিষয়ক ফেসবুক গ্রুপ ‘চৌরঙ্গী’তে। ব্যক্তিগতভাবেও কথা বলেছি সমাজের কয়েক স্তরের নারীদের সঙ্গে। জানতে চেয়েছিলাম, এখন কি বাংলাদেশের মেয়েরা মা-বাবার বাড়ি অন্তত একটা ঈদ হলেও উদ্‌যাপন করতে পারেন? উত্তর দিয়েছেন অনেক নারী। সংগত কারণে বেশির ভাগ উত্তরদাতার আসল নাম প্রকাশ করছি না।

২.
শুরু করব সমাজের উচ্চশিক্ষিত, সচ্ছল পরিবারের গল্প দিয়ে। চট্টগ্রামের মেয়ে জেরিন ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। উচ্চশিক্ষিত, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন, তাঁর মা শ্বশুরবাড়ি ঈদ করছেন। মায়ের সঙ্গে দাদিরও চমৎকার সম্পর্ক দেখেছেন। চাচাতো ভাইবোনেরা মিলে আনন্দের সঙ্গে দাদাবাড়িতে ঈদ করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই নিজের বিয়ের পর তাঁরও ঈদ নিয়ে একই ধরনের প্রত্যাশা ছিল। তিনিও শ্বশুরবাড়ি ঈদ করতেন।
কিন্তু যেহেতু ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন, তাই শুরু থেকেই শাশুড়ি তাঁকে মন থেকে মেনে নেননি। শাশুড়ি মনে করতেন, জেরিন তাঁর ছেলেকে কেড়ে নিয়েছেন। ফলে যখনই জেরিন শ্বশুরবাড়ি যেতেন, বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়তেন। বিশেষ করে ঈদের সময় কিছু রান্না করলে ইচ্ছাকৃতভাবে সেটি নষ্ট করে দেওয়া হতো। তিনি ফ্রিজে কোনো খাবার রাখলে, সেটি বাইরে বের করে রাখা হতো, যেন নষ্ট হয়ে যায়। বিভিন্নভাবে তাঁকে বোঝানো হতো যে তিনি এই পরিবারের কেউ নন। এমনকি সন্তান জন্মের পরও পরিস্থিতি বদলায়নি।
জেরিন আরও বলেন, ‘শ্বশুরবাড়ি ঈদ করা ছিল আমার ও আমার সন্তানের জন্য রীতিমতো আতঙ্কের। সেখানে আমরা ছিলাম অনাহূত। এরপর আমি দেশের বাইরে পড়তে যাই এবং একদম একা ঈদ করি। কেবল বন্ধুরা পাশে ছিল। সে সময় মনে হয়, কেন প্রতিবছর শ্বশুরবাড়ি ঈদ করে স্বেচ্ছায় যন্ত্রণা ভোগ করি? কেন বাবার মৃত্যুর পর মাকে একা ফেলে রাখি?’
এরপরই জেরিন সিদ্ধান্ত নেন, অনেক হয়েছে, তিনি আর কষ্ট ভোগ করতে যাবেন না। স্বামীর সঙ্গে বোঝাপড়া সেরে নিয়েছেন। যে যাঁর মায়ের কাছে ঈদ করেন। একবেলা হয়তো গিয়ে দেখা করে আসেন শাশুড়ির সঙ্গে। শাশুড়িও তাঁর ছেলেকে পেয়ে খুশি, জেরিনও মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে পেরে খুশি। তবে এই সিদ্ধান্ত নিতে বেশ কয়টা বছর লেগেছে।

আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিবাহিত নারীদের একটা বড় অংশ নিজের মা-বাবার সঙ্গে ঈদ-পূজার মতো উৎসব উদ্‌যাপনের কথা ভাবতেও পারেন না। (ছবিটি প্রতীকী)
ছবি : প্রথম আলো

৩.
বিয়ের সাত বছর পর মায়ের সঙ্গে ঈদ করার সুযোগ বা অনুমতি পেয়েছিলেন খুলনার মেয়ে পাকিজা সিদ্দিকী। তা-ও কিছুটা জিদ করেই সেবার বাবার বাড়ি গিয়েছিলেন। করোনা মহামারি শুরুর বছর সেই ঈদের দুই সপ্তাহ পরই মাকে হারান পাকিজা। তিনি বলছিলেন, ‘সব সময় ভাবি, যদি সেবার জিদ করে মায়ের কাছে না যেতাম, তাহলে মায়ের সঙ্গে ঈদের স্মৃতিই ভুলতে বসতাম। আমার মেয়ের সঙ্গেও মায়ের ঈদ করা হতো না।’
পাকিজার শাশুড়ি পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র বোন। তিনি নিজে প্রতি ঈদে বাবার বাড়ি যান। সেই সঙ্গে নিজের ছেলেদের ও ছেলের বউদেরও যেতে বাধ্য করেন। সেই বাড়িতে সবাই পাকিজাকে ভালোবাসেন। কিন্তু প্রতি ঈদে কারও বাসায় মেহমান হয়ে ঈদ করতে যাওয়া পাকিজার জন্য স্বস্তির ছিল না। কিন্তু শাশুড়ির ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস তাঁর ছিল না। মায়ের মৃত্যুর পর পাকিজা বদলে যান। তাঁর নানাশ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ির দূরত্ব মাত্র আধা ঘণ্টার। তারপরও টানা সাত বছর ঈদে বাবার বাড়ি যেতে পারেননি। সেই কষ্ট কিছুতেই ভুলতে পারেন না তিনি। মায়ের মৃত্যুর পর সিদ্ধান্ত নেন, যদি বাবা আর ছোট ভাইবোনদের সঙ্গে নিজের বাড়িতে একটা ঈদ করতেই না পারেন, তাহলে পদ্মা নদী পাড়ি দেবেন না। ঢাকাতেই নিজের একক পরিবারের সঙ্গে ঈদ করবেন।
এই সিদ্ধান্তে স্বভাবতই শাশুড়ি নাখোশ হন। নানা কটুকথাও শোনান। কিন্তু পাকিজা তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে সরেননি। নিজের মানসিক শান্তির জন্য স্বামীর সঙ্গে কথা বলেছেন। কথা-কাটাকাটি হয়েছে, তবে শেষ পর্যন্ত নিজেরা একটা সিদ্ধান্তেও এসেছেন। এবার তাই ঈদ করতে বাবার বাড়ি যাচ্ছেন পাকিজা। পরিকল্পনা হলো, ঈদের পরদিন নানাশ্বশুরবাড়ি গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করে আসবেন।

স্ত্রী নিজের বাবার বাড়িতে ঈদ করতে যাবেন, এটা অনেক স্বামীই পছন্দ করেন না। (ছবিটি প্রতীকী)
ছবি : সুমন ইউসুফ

৪.
ফেসবুকে এক নারী লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে বিয়ের পর মেয়েদের আর কোনো মা-বাবা থাকে না। মা-বাবার মেয়ে আর নিজের থাকে না। তাঁদের জীবনে ঈদ বলে কিছু আসে না। শুধু ছেলেদের মা-বাবার জীবনে ঈদ আসে এবং তাঁদের ইচ্ছা করে সবাইকে নিয়ে ঈদ করতে। সে জন্য সবাই ওই বাড়িতে থাকে।’
তাসফিয়া করিম নামের একজন জানালেন, বিয়ের পর গত ১৫ বছরে মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। জেবিন খান নামের আরেকজন বলেন, ‘১১ বছরে কোনো দিন ঈদে মায়ের কাছে যেতে পারিনি। তবে ঈদের ৭ দিন পরও যদি মায়ের কাছে যাই, সেদিনই আমার ঈদ হয়।’
বাবার মৃত্যুর কারণে বিয়ের ১৮ বছর পর একটা ঈদ মায়ের সঙ্গে করেছিলেন শারমিন জাহান। সেটাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছিলেন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। ভুল হয়েছে স্বীকার করে নেওয়ার পর তাঁকে ‘মাফ’ করে দেন স্বামীর মা ও বোন।
১৭ বছর হলো বিয়ে করেছেন তাসরিন পিয়াসা। বললেন, ‘ভাবতে খারাপ লাগে যে মা-বাবা কোনো দিন তাঁদের একমাত্র নাতনির সঙ্গে ঈদ করেননি।’
এ রকম আরও অনেক ঘটনার কথা শুনেছি। বিয়ের পর মা-বাবার সঙ্গে ঈদে শামিল হতে না পারার কষ্টে দিন কাটান বহু নারী। ঈদের দিন ভালো খাবার রান্না করেন, কিন্তু নিজের মা-বাবার মুখে সেই খাবার তুলে দিতে না পারার দুঃখ তাঁরা ভুলতে পারেন না।
কথা বলেছিলাম যশোর থেকে ঢাকায় এসে গৃহকর্মী হিসেবে কাজে নিয়োজিত আম্বিয়া খাতুনের সঙ্গে। তিনি স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী গ্রামে থাকেন, শ্বশুরবাড়িতে। ঢাকায় স্বামী কাজ করেন, সেখানেই বিয়ে করেছেন আম্বিয়াকে। সন্তানও আছে। ঈদে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার অনুমতি নেই তাঁর। তাই বলে বাবার বাড়িতেও যেতে পারেন না। স্বামীর সঙ্গে সন্তানকে পাঠিয়ে দেন, তিনি হয়তো ঢাকাতেই থেকে যান। খুব বেশি হলে বোনদের বাড়ি গিয়ে ঈদ করেন। কিন্তু সন্তানকে নিয়ে নিজের বাবার বাড়িতে ঈদ করতে যেতে পারেন না। কারণ, স্বামী সেটা পছন্দ করবেন না।
এসব নারী যে অর্থনৈতিকভাবে স্বামীর ওপর নির্ভরশীল, তা নয়। কিন্তু নিয়মের বাইরে, সংসারে অশান্তি করে কিংবা কারও বিরাগভাজন হয়ে তাঁরা ঈদের মতো উৎসব উদ্‌যাপন করতে চান না, সে কারণেই সব মেনে নেন।