পালিয়ে না এলে জীবনটা হয়তো এত সুন্দর হতো না

অভাবের কারণে একবার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পড়াশোনার আকাঙ্ক্ষা তাঁকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করল। গ্রামেরই এক গেরস্ত বাড়িতে শুরু করলেন রাখালি। থাকা-খাওয়া নিশ্চিত হওয়ার পর আবার শুরু করলেন পড়াশোনা। সেই সাইফুল ইসলাম এখন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া সরকারি আকবর আলী কলেজের প্রভাষক। তাঁর জীবনসংগ্রামের গল্প শুনলেন জাওয়াদুল আলম

২০২২ সালের ডিসেম্বরে উল্লাপাড়া সরকারি আকবর আলী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন সাইফুল ইসলাম
ছবি : সংগৃহীত

বাইরে দমকা হাওয়া বইছে। মেঘ ডাকছে। একটু পরই হয়তো বৃষ্টি নামবে। একসময় এমন ঝড়বৃষ্টির মুহূর্তে আমার মনে আতঙ্ক চেপে বসত। গোয়ালঘর লাগোয়া একচালা ঘরটায় ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে থাকতাম। আমার ‘বেডরুম’ কাম ‘রিডিংরুম’ মিলিয়ে ঘরটা ছিল একেবারেই নড়েবড়ে। ছোট মনে ভয় হতো—যদি বাঁশের খুঁটি ভেঙে পড়ে, যদি ঝড়ে কোথাও আশ্রয় না পাই।

তবে আজকের দমকা হাওয়ায় আমার ভয় লাগছে না। ঝোড়ো বৃষ্টির আশঙ্কাও আমার মধ্যে কোনো আতঙ্ক তৈরি করছে না। কারণ, ঢাকায় পাঁচতলা ভবনের একটি সুরক্ষিত কক্ষে আমি বসে আছি। এ রকম একটি নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাতে আমাকে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে আমি উল্লাপাড়া সরকারি আকবর আলী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছি। বনিয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে এখন ঢাকায় এসেছি। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) যে কক্ষে আছি, তার আশপাশের কক্ষে আরও অনেকেই আছেন। কিন্তু আমার মতো কষ্ট করে এতটা পথ পাড়ি হয়তো তাঁদের কাউকেই দিতে হয়নি।

ছোটবেলা থেকেই অভাব-অনটন ছিল সাইফুল ইসলামের নিত্যসঙ্গী
ছবি : সংগৃহীত

‘পড়াশোনা না, তুমি তো কাজ করতে এসেছ’ 

রংপুরের মোমিনপুর চানকুটি মাছুয়াপাড়ায় আমাদের বাড়ি। গ্রামটা অনগ্রসর। এই তো ২০১৬ সালে মাত্র বিদ্যুৎ গেছে। গ্রামের অনেক পরিবারের মতো ছোটবেলায় অভাব-অনটন ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। চার ভাইয়ের মধ্যে আমি তৃতীয়। আমার বড় ভাই হাফেজি পড়েছেন। মেজ ভাই বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেননি, বর্তমানে শ্রমিকের কাজ করেন। আমার ছোট ভাই আমার চেয়ে বছরখানেকের ছোট, টাকার অভাবে তারও পড়াশোনা হয়নি। তিনি ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে শ্রমিকের কাজ করেন।

ছোটবেলায় একরকম বাবার কথা না শুনেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। ষষ্ঠ শ্রেণি পাস করে যখন সপ্তম শ্রেণিতে উঠলাম, বাবা বেঁকে বসলেন; আর পড়াতে পারবেন না। বাড়ির অন্যরাও চাচ্ছিলেন, আমি যেন আয়রোজগার শুরু করি। বুঝতে পারছিলাম, অভাবের সংসারে কিছু করা দরকার। কিন্তু আমার তো শুধু পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে।

আমার বাবা তখন অন্যের জমিতে কাজ করেন। আকালের সময় দুমুঠো ভাতের জন্য বাবা একদিন আমাকে রংপুর শহরের একজনের বাড়িতে রেখে এলেন। সেখানে তিন বেলা খাবার আর থাকার বিনিময়ে বাড়ির ফুট–ফরমাশ খাটতে হবে। সেই সঙ্গে ওই বাড়ির শিশুর সঙ্গে খেলাধুলা করা। খেলাধুলা করতে আমার ভালোই লাগত। কিন্তু বাড়ির ছোটরা যখন পড়তে বসত, আমার মন খারাপ হতো। মনে হতো, আমিও যদি এভাবে পড়তে পারতাম। ওই বাড়িতে যাওয়ার আগে শুনেছিলাম, কাজের ফাঁকে আমাকে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর ওই বাড়ির কর্তা বলে দিলেন, ‘তুমি তো কাজ করতে এসেছ। পড়াশোনা করা যাবে না।’ 

তাঁর মুখে কথাটা শোনার পর আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কান্না পেল। ওই রাতেই ঠিক করলাম, এখানে আর থাকব না। পরদিন সকাল হতেই ওই বাড়ির শিশুটাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে গেলাম। ঘুরেফিরে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েই গ্রামে ফেরার পথ ধরলাম। রংপুর শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ। সকালে রওনা দিয়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল।

আমাকে দেখে বাবা ভীষণ রাগ করলেন। গায়ে হাতও তুললেন। আসলে ক্ষুধার কষ্টের কাছে পড়াশোনা বিলাসিতা। বাবা হয়তো চাচ্ছিলেন আমি অন্তত খেয়ে–পরে ভালো থাকি। আমার মতো অনেকের সঙ্গে এটাই যে হয়ে আসছিল।

৪০তম বিসিএসে স্বপ্ন পূরণ হয় সাইফুল ইসলামের
ছবি : সংগৃহীত

আমি যখন ‘লজিং মাস্টার’

দিনকয়েক বাড়িতে থাকার পর বাবার রাগ পড়ে গেল। বাবাকে বোঝালাম, আমার পড়াশোনার খরচ আমিই চালাব। তবু আমি পড়তে চাই। ‘হ্যাঁ’–‘না’ কিছুই তিনি বললেন না। বাবার চোখে–মুখে এক অসহায়ত্ব।

এরপর গ্রামের এক ধনাঢ্য বাড়িতে গিয়ে ‘লজিং মাস্টার’ হিসেবে থাকা শুরু করলাম। বাড়ির দুই মেয়েকে পড়াই আর হাটবাজার, গরু–ছাগল দেখাশোনা করি। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই গরুর জন্য ঘাস কাটতে বেরিয়ে পড়ি। গরুর পরিচর্যা শেষে খাওয়াদাওয়া। তারপর মাদ্রাসা। বিকেলে ফিরেই ওই বাড়ির বাজারসদাইসহ কোনো কাজ থাকলে সেগুলো করা। সন্ধ্যায় গরু গোয়ালঘরে রেখে ওই বাড়ির দুই মেয়েকে পড়ানো। তাদের পড়ানোর সময় আমার পড়াটাও শেষ করতাম।

দাখিল পরীক্ষার আগপর্যন্ত এভাবেই চলল। তারপর ওই বাড়িতে থাকা ছেড়ে দিলাম। তখন আমার নিজের পড়ার জন্য বেশি সময় দরকার। অত কাজ করে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারছিলাম না। তত দিনে আমি অনেক কাজ শিখে গেছি। পড়াশোনার ফাঁকে কৃষিশ্রমিকের কাজ শুরু করলাম। আবার কৃষকের থেকে শাকসবজি কিনে গ্রামের হাটে নিয়ে বিক্রি করতাম। এভাবে যা আয় হতো তা দিয়ে নিজের খরচ চলে যেত।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ পর্যন্ত বিসিএসের ব্যাপারে সাইফুল ইসলামের কোনো ধারণা ছিল না
ছবি : সংগৃহীত

রংপুরের জীবন

২০০৮ সাল। দাখিল পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ–৪.৮১ পেলাম। আমাদের গ্রামে কখনো এত ভালো ফল কেউ করেনি। তখন আমাদের গ্রামের গণিতের এক শিক্ষক পরামর্শ দিলেন রংপুর শহরে ভর্তি হতে। ধাপসাতপাড়া বায়তুল মোকারম মডেল কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হলাম। কয়েক মাসের মধ্যেই রংপুর শহরে টিউশনি খুঁজে নিলাম। মজার ব্যাপার হলো, যে বাড়িতে আমি প্রথম টিউশনি করাতে যাই, সেটা ছিল রংপুর শহরে পেটেভাতে যে বাড়িতে ছিলাম সেই বাড়িটার পাশেই। সেদিন গর্বে আমার বুক ভরে গিয়েছিল। যেখানে আমি একদিন কাজের খোঁজে এসেছিলাম, আজ সেই এলাকায় গৃহশিক্ষক হিসেবে এলাম। রংপুরেও কিছুদিন লজিংও ছিলাম। একটা বাড়িতে থাকতাম। ওই বাড়ির তিন পরিবারের তিন ছেলেমেয়েকে পড়াতাম। তিন বেলা তিন পরিবারে খাওয়াদাওয়া করতাম। অবশ্য মাসখানেক ওই বাড়িতে থাকার পরই মেসে উঠেছিলাম।

 স্বপ্ন দেখার শুরু

আলিম পরীক্ষায় আমার ফল আরও ভালো হলো। জিপিএ–৫ পেলাম। এরপর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ পর্যন্ত বিসিএসের ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা ছিল না। তবে স্বপ্ন ছিল, ব্যাংক বা সরকারি কোনো চাকরি করব।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কিছুদিন পরই পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে আমার বিভাগের গোলাম রব্বানী স্যার বলেছিলেন, ‘এই ব্যাচ থেকে যদি একজনেরও বিসিএস ক্যাডার হওয়ার যোগ্যতা থাকে, তাহলে সেই একজন হলো তুমি।’ স্যারের ওই কথায় ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হই। এর পর থেকে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। একবারেই সফল হয়েছি, এমন না। ৩৭ ও ৩৮তম বিসিএসে হোঁচট খেয়েছি। তবে ৪০তম বিসিএসে এসে আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এদিকে আমি ৪১তম বিসিএসের মৌখিক পর্যন্ত পৌঁছে গেছি। আমি বিশ্বাস করি, ধৈর্য নিয়ে পরিশ্রম করলে সাফল্য ধরা দেবেই।

ফেলে আসা দিনের কথা মনে পড়লে আমি এখনো রোমাঞ্চিত হই। এসব অভিজ্ঞতার কথা অন্যদের বলতে আমি কখনো সংকোচ বোধ করি না। বরং আমার সংগ্রামের ঘটনাগুলোই আমাকে আগামী দিনের জন্য শক্তি জোগায়।