ঋতুপর্ণার উত্তরসূরিদের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন টিকে থাকবে তো?

রাঙামাটির ঘাগড়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে ফুটবলের প্রশিক্ষণ চলে অনেকটা নীরবে
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

সবুজ পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলে গেছে প্রধান সড়ক। সড়কের নিচে একটা খেলার মাঠ। তাতে খোলা চুলে ফুটবল নিয়ে ছুটছে একদল পাহাড়ি কিশোরী। দলটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য স্মৃতি চাকমা। আট মাস আগে দলে যোগ দিয়েছে ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়া এই কিশোরী। স্মৃতির দৃষ্টি এখন অনেক দূর। জানাল, ‘আমি ঋতুপর্ণাদির মতো মিডফিল্ডার হব।’

২৮ সদস্যের এই দলের প্রত্যেকেই স্মৃতির মতো স্বপ্ন বুনছে। কেউ রূপনার মতো দেশসেরা গোলকিপার হতে চায়, কেউ নিজেকে মণিকার মতো গড়ে তুলতে সচেষ্ট। সকাল–বিকেল ফুটবলই তাদের ধ্যানজ্ঞান। সদ্য সাফজয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল তাদের কাছে এখন বড় প্রেরণা। তার অগ্রভাগে রয়েছেন পাহাড়ের পাঁচ কন্যা, যাঁরা তাদের পূর্বসূরি।

হ্যাঁ, সাফজয়ী দলের পাঁচ সদস্যের শিকড় রাঙামাটির এই ঘাগড়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ। এই মাঠেই ঘামেভেজা শরীরে খেলতে খেলতে ঋতুপর্ণা, মণিকা, আনাই মগিনি, আনু মগিনি ও রূপনা চাকমারা আজকের তারকা, উত্তরসূরিদের আদর্শ। ফুটবলের পাশাপাশি তাঁরা ঘাগড়া বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতেন।

তাঁদের উত্তরসূরি এই ২৭ জনও ঘাগড়া বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে পড়ে। একজন শুধু পাশের ঘাগড়া কলেজের ছাত্রী। স্কুলের পেছনে তিনটি টিনশেড কক্ষে গাদাগাদি করে তারা থাকে। নিজেদের রান্না নিজেরাই করে। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফুটবল নিয়ে মাঠে নামে তারা। মাঝের সময়টা বিদ্যালয়েই কাটে। বিকেল হতেই আবার ফুটবল পাঠ।

নানা প্রতিকূলতার ভেতরও ফুটবল খেলছে মেয়েরা
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

তাঁদের কোচ শান্তিমণি চাকমা। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলপাগল। স্কুলের পাশেই তাঁর বাসা। এখন ব্যবসা করেন। কোচ জানালেন, পাহাড়ের এই নারী ফুটবল দলের পেছনের কথা। তখন ২০১১ সাল। বঙ্গমাতা ফুটবল খেলতে আশপাশের উপজেলা ও জেলায় যেতে হতো। এই সময় যে মেয়েটির খেলা মনে ধরত, তাকেই নয়নের মণি করতেন শান্তিমণি ও বীরসেন চাকমা। বীরসেন তখন মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।

শান্তিমণি বলেন, ‘২০১১ সালে আমাকে মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দলটি গঠনের দায়িত্ব দেন বীরসেনদা। সে বছর বঙ্গমাতায় দলটি জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়। তখন থেকে বীরসেন আর আমি অন্য স্কুল থেকে আসা দলের যে মেয়েটির খেলা ভালো লাগে, তাদের সংগ্রহ করা শুরু করলাম। তাদের এক জায়গায় এনে বীরসেনদা নিজের পকেটের টাকা খরচ করে স্কুলের একটি কক্ষে রাখতেন। আর আমি ফুটবল শেখাতাম। এভাবে শুরু।’

শুধু রাঙামাটি নয়, একসময় অন্য দুটি পার্বত্য জেলা থেকেও পাহাড়ি মেয়েদের সংগ্রহ করা শুরু করলেন। এভাবে তাঁরা ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ে মেয়েদের ফুটবল দল করেন। একসময় দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তাঁদের কীর্তি। ২০১৬ সালে স্কুল–মাদ্রাসা গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় এই স্কুলের ফুটবল দল। ওই দলে তখন চাতুইমা, বড় মণিকা, শিপালিকা তালুকদার, মাওপাই মারমা, লিংচুমা মারমারা নজর কাড়েন। এভাবে দলটির সেরা মেয়েদের জাতীয় পর্যায়ে খেলার ডাক আসতে শুরু করে।

সেই দলে পরে ঋতুপর্ণারা যোগ দেন। এখনো পাঁচজন সম্ভাবনাময় আছে, জানান শান্তিমণি। বলেন, ‘অভিভাবকেরা অনেককে দিতে চান না। জাতীয় দলের ফুটবলার রূপনাকেও প্রথমে দিতে চায়নি পরিবার। পরে তাদের বুঝিয়ে নিয়ে আসি। সে আজ দেশসেরা গোলরক্ষক।’

অনেকটা নীরবে নিভৃতেই ফুটবলার গড়ার কাজটি এখনো করে যাচ্ছেন এই দুজন। অনুশীলনে খেলোয়াড়দের যে রকম পরিশ্রম করতে হয়, সেভাবে খেতে দিতে পারেন না। এখানে মেয়েরা নিজেদের খরচে খায়। যে খরচটুকুও অধিকাংশ পরিবার বহন করতে হিমশিম খায়।

বীরসেন আক্ষেপ করে বলেন, ‘২০১৪ সালে মেয়েদের উচ্চবিদ্যালয় কমিটির কাছে বুঝিয়ে দিয়েছি। তারপরও মূলত আমরা পরিচালনা করি। মেয়েদের অনেক সংকট। দরকারি সব সরঞ্জাম নেই। খাওয়ার ঠিক নেই বলে ঠিকমতো পুষ্টিও পায় না। পরিচালনার জন্য সেই অর্থে নীতিমালাও নেই।’

এত এত সংকটের ভেতরেও স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে মেয়েরা। আধপেটা খেয়েও নিজেদের লক্ষ্যে তারা অটুট। সবারই ইচ্ছা জাতীয় দলের হয়ে দেশ-বিদেশে বাংলাদেশকে তুলে ধরবে। দশম শ্রেণির দুই ছাত্রী মহিনা ও তিশা চাকমার দৃষ্টি এখন জাতীয় পর্যায়ে খেলার। মণিকা চাকমার মতো রক্ষণভাগ আগলে রাখতে চায় বিলাইছড়ির মিতা। দীপা চাকমার বাবা কৃষিকাজ করেন। সে–ও ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে এত কম বয়সে ঘর ছেড়ে এই মেয়েদের সঙ্গে থাকছে। মাসাপ্রু, ঐশিসহ সবার ঘরেই নুন আনতে পান্তা ফুরায়। মেয়েরা তাকিয়ে থাকে মাস শেষে কখন বাড়ি থেকে খাওয়ার টাকা আসবে। এত সংকটের মধ্যে থাকলে তার প্রভাব পড়ে খেলার মাঠেও।

কোচের মতে, এই পাহাড়ি কন্যাদের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে ভবিষ্যতের মণিকা, রূপনা, সানজিদা বা ঋতুপর্ণারা। অপুষ্টি আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তাদের এই স্বপ্ন কতটা পূরণ হবে, ভবিষ্যৎই তা বলবে।