তবে দাড়ি রাখা একেবারে সহজ কাজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন হয় বাড়তি যত্ন–আত্তির। দাড়ির সুস্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের জন্য নিয়মিত পরিচর্যা করতে হয়। সচেতন থাকতে হয় আরও অনেক ব্যাপারে। ধরা যাক, কোনো বিশেষ অতিথির সামনে যাওয়া প্রয়োজন। ঘুম থেকে হুড়মুড় করে উঠে চলে গেলেই হবে না। চুল ঠিক করার আগে দাড়ির দিকেও দিতে হবে বাড়তি নজর। কারণ, চুলের দিকে বিপরীত মানুষটির নজর যতটা না বেশি যায়, তার চেয়ে বেশি চোখ পড়ে দাড়িতে। দাড়ি না থাকলে চুলে দুই দফা আঙুল চালিয়ে গেলেই হলো।
দাড়ি রাখা সহজ না হলেও পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে পাওয়া পুরোনো চিত্র বা ভাস্কর্যে উপস্থাপিত সমকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটির মুখে দীর্ঘ দাড়ির আলামত পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০০ সালে নির্মিত শহর মহেঞ্জোদারোতে যে ‘প্রিস্ট কিং’ বা যাজক রাজার ভাস্কর্য পাওয়া গেছে, তাতেও রয়েছে গোঁফ কামানো ছোট দাড়িওয়ালা মুখ। তক্ষশীলায় পাওয়া উপবাসরত বুদ্ধমূর্তির মুখেও ছিল দাড়ি। মেসোপটেমিয়া সভ্যতার জরথুস্ত্রের যে মূর্তি ইরাকে পাওয়া গেছে, তাতেও আছে লম্বা ও সুন্দর দাড়ি। তা ছাড়া প্রায় সব নতুন-পুরোনো আধ্যাত্মিক মনীষীর চেহারা থাকে শ্মশ্রুমণ্ডিত।
দাড়ির প্রতি আগ্রহ বাড়া মানে শেভিং ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়া। হয়েছেও তা–ই। বিখ্যাত ব্লেড কোম্পানি জিলেটের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার গলায় শোনা গেল সে কথা—ব্লেডের ব্যবসা আর আগের মতো নেই। চোখধাঁধানো বিজ্ঞাপন আর সুন্দর সুন্দর কথায় তরুণেরা ব্লেড কিনছেন না। তাঁদের সব আগ্রহ ‘ট্রিমার’-এর দিকে। তাই ট্রিমারের এখন রমরমা অবস্থা চলছে।
দাড়ি কারও কারও চেহারায় নিয়ে আসে এক গভীর দীপ্তি। একবার ভাবুন তো, দাড়িহীন রবীন্দ্রনাথ কি গুরুদেব উপাধি পেতেন? অথবা গুরু রজনীশ বা ওশো ক্লিন শেভ করে এসে দাঁড়ালে ভক্তদের কী দশা হবে? চার্লস ডিকেন্স, চেখভ, হেমিংওয়ে, দস্তয়েভস্কি, ওয়াল্ট হুইটম্যান, তলস্তয়, শেক্সপিয়ার, জিওফ্রে চসার, ডিএইচ লরেন্স, হেনরিক ইবসেন—দাড়িওয়ালা মনীষীদের এ তালিকা বড় দীর্ঘ। পৃথিবীর বিখ্যাত সব লেখক, শিল্পী, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, তাত্ত্বিকদের দাড়ির প্রতি রয়েছে অসামান্য দুর্বলতা। এত সব জ্ঞানী-গুণীজন যখন দাড়ি রাখছেন, তখন এতে কিছু একটা তো আছেই!
সেই ‘কিছু একটাই’ আবারও দাড়িকে ফ্যাশনের জগতে নিয়ে এসেছে। সেলুন বা চুলকাটার দোকানগুলোতে আগে চলচ্চিত্রের নায়কদের পাশাপাশি চীন ও জাপানের দাড়ি–গোঁফহীন মডেলদের ছবি দেখা যেত। সেদিন আর নেই। এখন বাহারি ডিজাইনের সঙ্গে দাড়িওয়ালা মডেলের ছবিই আকছার দেখা যায়। যে চলচ্চিত্রের নায়কদের আগে দেখা যেত, তাঁদের জায়গায় এবার শ্মশ্রুমণ্ডিত নায়কদের ছবি দখল নিয়েছে।
নেবেই–বা না কেন, হলিউডের প্রায় সব সিনেমা আর সিরিজে দাড়ির জয়জয়কার বহু আগে থেকেই চলছে। যুদ্ধবিগ্রহ বা ঐতিহাসিক চরিত্রে তো দাড়ি অবধারিত। অন্যান্য গল্পেও নায়ক বা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের মুখে থাকছে দাড়ি। ইউরোপীয় ফ্যাশনে দাড়ির অবস্থান কোথায়, তা বোঝার জন্য একজন বিশেষজ্ঞের কথা শুনলে আঁচ করা সম্ভব। ফ্যাশন বিশেষজ্ঞদের মতে, বিয়ার্ড ইজ দ্য নিউ সিক্স প্যাক। মানে হলো, একজন সুদর্শন পুরুষের সংজ্ঞায় ‘সিক্স প্যাক’ যেমন অত্যাবশ্যকীয় শব্দ ছিল, সে স্থান এখন পুরোপুরি দাড়ির দখলে।
ফ্রান্সে দাড়ি ইস্যুটি সামনে এলে একজন বিখ্যাত ফরাসি নারী তো বলেই দিয়েছেন, দাড়িহীন ‘নারীমুখো’ পুরুষের দিকে তিনি তাকাতে চান না। ক্লিন শেভ করা মোলায়েম মুখের চেয়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ির পুরুষমুখ তাঁর কাছে ঢের আকর্ষণীয়। বিশেষজ্ঞেরা আরও বলেন, দাড়ি একই সঙ্গে ‘কুল’ ও ‘হট’। আর এ কারণই হাল আমলের তরুণদের তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে। এখন একটা বড়সংখ্যক তরুণ হয় দাড়ি রাখছেন, নয়তো দাড়ি রাখার স্বপ্ন দেখছেন।
আপনি যদি দাড়ি রাখার স্বপ্ন দেখে থাকেন, তো কিছু প্রস্তুতি নিয়ে রাখুন এখনই। হঠাৎ দাড়ি রাখা শুরু করলে চারপাশ থেকে নানা রকম কথা শুনতে হতে পারে। গানটা তো শুনেছেনই, কুচ তো লোগ ক্যাহেগে, লোগো কা কাম হ্যায় ক্যাহনা...
সূত্র:
১. অব বিয়ার্ড অ্যান্ড মেন: দা রিভেলিং হিস্টোরি অব ফেসিয়াল হেয়ার, ক্রিস্টোপার অল্ডস্টোন মোর, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস, ২০১৫।
২. দাড়হি পিরসে ফ্যাশন মে ক্যায়সে আগায়ি, হাসনাইন জামাল, বিবিসি উর্দু।