ডেসটিনিই আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে

গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে প্যারিস ফ্যাশন উইকে সেরা ডিজাইনার হওয়ার পরপরই তিনি বাংলাদেশে আসেন। তাঁর এজেন্ট থেকে পরিচিতজন, বন্ধুবান্ধব—সবারই প্রশ্ন ছিল, কেন তিনি বাংলাদেশে যাচ্ছেন? সবার কাছে বিষয়টা অবিশ্বাস্যই ছিল। কিন্তু তিনি এসেছিলেন। ভালোবেসেছিলেন। এ জন্য ফিরে এসেছেন আবার। ঢাকায় ‍উপস্থাপন করেছেন তাঁর সংগ্রহ। সম্প্রতি নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে বিশ্বখ্যাত কোরিয়ান-আমেরিকান ডিজাইনার গ্রেস মুনের সঙ্গে।

ফ্যাশন ডিজাইনার গ্রেস মুনছবি: সুমন ইউসুফ

প্রথম আলো: শুরু করা যাক বাংলাদেশ প্রসঙ্গ দিয়ে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে প্যারিস ফ্যাশন উইকে আপনি সেরা ডিজাইনারের সম্মান পেয়েছেন। এরপর ফেস অব এশিয়ার বিচারক হিসেবে এলেন বাংলাদেশে। তার আগে কতটুকু জানা ছিল এই দেশ সম্পর্কে?

গ্রেস মুন: আসলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি আছে। এখানে বিভিন্ন নামী ব্র্যান্ডের অনেক ভালো মানের পোশাক তৈরি হয়। এটুকুই জানতাম।

ঢাকায় পাঞ্জাবিকে (বাঁদিকের লাল পাঞ্জাবি) অন্যভাবে উপস্থাপন করেন মুন
ছবি: খালেদ সরকার

প্রথম আলো: প্যারিস ফ্যাশন উইকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পর আপনার বাংলাদেশে আসার বিষয়টিকে সবাই কীভাবে নিয়েছিল?

গ্রেস মুন: আসলে কেউ বিশ্বাসই করতে চায়নি। বিশেষত, প্যারিসের সাফল্যের পর সবারই নানা পরিকল্পনা থাকে। তার ওপর তখন অতিমারি শুরু হয়ে গেছে। ফলে সবাই চিন্তিত ছিল। কিন্তু আমি নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে যাইনি।

প্রথম আলো: কিন্তু কেন পুনরায় ফিরে আসা? এবার কি বাধা আসেনি অতিমারির মধ্যে আসার জন্য?

গ্রেস মুন: বাধা নয়, অনেকে এবারও চিন্তিত হয়েছেন। কিন্তু ওই যে বললাম আমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকি। এখানে একটা বিষয় বলা যায়, ভেতর থেকে তাগিদ অনুভব করেছি। অন্যভাবে বললে, ডেসটিনিই আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে।

নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন মুন
ছবি: সুমন ইউসুফ

প্রথম আলো: দুবারে কতটুকুই-বা দেখা কিংবা জানা হলো এখানকার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে?

গ্রেস মুন: আসলে প্রথমবার আমার সফর ছিল খুই সংক্ষিপ্ত। তবে তার মধ্যে আমি যতটুকু পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছি, তাতে আমার মনে হয়েছে এখানে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এটাই আমাকে বিশেষভাবে আগ্রহী করেছে।
এবার আসলে বেশ খানিকটা সময় থাকার সুযোগ হয়েছে। আমি স্টোরগুলোতে গিয়েছি। কাজ দেখেছি। কাপড় অনেকটা কোরিয়ানদের মতো। রং ইন্টারেস্টিং। তবে সত্যি বলতে কি অনেক কিছু দেখে ওঠা হয়নি।

প্রথম আলো: কী ভাবছেন বাংলাদেশ নিয়ে। নতুন কোনো পরিকল্পনা? কোনো কোলাবোরেশন?

গ্রেস মুন: আমি ট্র্যাডিশনাল কাস্টম ডিজাইনার নই। বরং আমি ওয়েস্টার্ন কমার্শিয়াল ডিজাইনার। তা সত্ত্বেও বলতে পারি শাড়ি আমাকে মুগ্ধ করেছে। এই পোশাক নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। ভবিষ্যতে হতেও পারে।

শাড়ি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে মুনের
ছবি: সুমন ইউসুফ

প্রথম আলো: সারা পৃথিবী অদ্ভুত এক সময় পার করছে। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিও একটা ক্রান্তিতে রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর কীভাবে নিজেকে এগিয়ে নিতে চান?

গ্রেস মুন: অনেক কিছুই তো হলো। প্রতিষ্ঠানের দেউলিয়া হওয়া, মানুষের চাকরি হারানো, বেতন কমে যাওয়া ইত্যাদি অনেক নেতিবাচক বিষয়ের মুখোমুখি আমাদের হতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও বলি, মানুষের জীবনে তিনটি অপরিহার্য বিষয় থাকবে। খাদ্য, পরিধেয়, বাসস্থান। আবার এটাও ঠিক, ডিজাইনার হিসেবে, সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে আমাদেরও ভাবতে হবে, কী করা যায় সামনে। আমি নতুনদের সঙ্গে কাজ করতে পছন্দ করি। করেও থাকি। এই যেমন এবার আজিমের সঙ্গে কাজ করছি। তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি।

প্রথম আলো: অতিমারি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সম্পৃক্তদের কী শিক্ষা দিয়ে গেল?

গ্রেস মুন: যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকা। এটাই মনে হয় সবচেয়ে বড় শিক্ষা। কারণ, এর আগে তো আমরা এভাবে ভাবতে পারতাম না।

প্রথম আলো: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা পেয়েছিলাম ক্রিস্তয় দিওরের নিউ লুক। এবার তেমন কি কিছু ঘটতে পারে? নতুন কোনো তাক লাগানো কিছু?

গ্রেস মুন: আমরা ডিজাইনাররা ক্রেজি। যেকোনো কিছুই করে ফেলতে পারি। তবে এখন সংক্রমণরোধী কাপড় নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে। এর মধ্যে কিছু তৈরিও হয়েছে। সবাই অর্গানিক সুতা, অর্গানিক কাপড় নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে নতুন কিছু অবশ্যই আসবে। এভাবে সবাই তৈরির হচ্ছে আগামীর জন্য।

ফ্যাশন উইক হয়েছে দর্শকশূন্য স্থানে। দেখা গেছে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে
ছবি: রয়টার্স

প্রথম আলো: এ সময়ে ফ্যাশন উইকের নানা ধরন দেখলাম। ফিজিক্যাল যেমন হলো তেমনি ডিজিটালও হলো। আবার দুইয়ে মিলে ফিজিটাল শোও হয়েছে। এর মধ্যে কোনটার পক্ষে আপনি?

গ্রেস মুন: (একটু ভেবে হাসতে হাসতে বললেন) ফিজিক্যাল। আসলে আমি কেন ফিজিক্যাল বলেছি জানো? এটা স্বতঃস্ফূর্ত। কারণ, আমরা এই অতিমারির কারণে মানুষের সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। দেখা হওয়া, কথা বলা, স্পর্শ এসবের ভীষণ গুরুত্ব রয়েছে। এ জন্যই আমি ফিজিক্যালের পক্ষে।

প্রথম আলো: একটু আগে আমরা অর্গানিক কাপড় নিয়ে কথা বলছিলাম। সেই প্রসঙ্গে ফিরে একটু বলতে চাই, সময়ের দাবি হলো পুনর্ব্যবহার, টেকসই পণ্য তৈরি। আপনার কাজে এর প্রতিফলন কতটুকু?

গ্রেস মুন: আমি এরই মধ্যে রিসাইকেলড কাপড় নিয়ে কাজ করেছি। একটা সংগ্রহও তৈরি করেছি। আরও করার ইচ্ছা আছে। এর বাইরে বলতে চাই, বিশ্বজুড়ে মানুষ প্লাস্টিক নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। এই প্লাস্টিক থেকে একটি প্রতিষ্ঠান সুতা তৈরি করছে। আমি তাদের সঙ্গে কাজ করছি।

প্রথম আলো: অতিমারিকালে মানুষের ক্রয়মনোভাবের পরিবর্তন ঘটেছে। বেশির ভাগ মানুষ কম কিনছে কিন্তু ভালো জিনিসটা কিনছে বা কিনতে চাচ্ছে; যেটা টেকসই। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ফাস্ট ফ্যাশনের ভবিষ্যৎ কী হবে?

গ্রেস মুন: আসলে ফাস্ট ফ্যাশনের ভালো-মন্দ উভয়ই আছে। কারণ, এই প্রক্রিয়ার নেপথ্যেও তো মানুষের সম্পৃক্তি আছে। এখানেই আমাদের অন্যভাবে দেখতে হবে। নেপথ্যের গল্পটা সামনে আনতে হবে। আর ফাস্ট ফ্যাশনের নামে মানুষকে এক্সপ্লয়েটও করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতির পরিবর্তনও জরুরি।

ফ্যাশন উইকের পক্ষে মুন
ছবি: মনের ফেসবুক পেজ

প্রথম আলো: ফ্যাশন উইক নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। এর যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ফ্যাশন উইক কিছুটা অস্তিত্বসংকটের মধ্যেও আছে। ফ্যাশন উইককে আপনি কীভাবে দেখেন?

গ্রেস মুন: ফ্যাশন উইক আসলেই সৃষ্টিযজ্ঞ। অনেক সময়, আর অর্থ ব্যয় হয় মাত্র ২০ মিনিটের জন্য। কিন্তু সেখান থেকে তরুণেরা অনেক কিছু শিখতে পারে। ডিজাইনারদের জন্য এটা গর্বের বিষয়ও। নামের জন্য কিন্তু তারা এটা করে না। সব মিলিয়ে আমার মনে হয় ফ্যাশন উইক অবশ্যই থাকা উচিত।

প্রথম আলো: ২০১৭ সালে আপনাকে নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকে সংগ্রহ উপস্থাপন করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই সংগ্রহের ছবি দেখেছি। কিছু পোশাকের প্যাটার্ন, কাপড়ের ওপর রঙের উপস্থিতি, নকশার ধরন আমাদের মনে করিয়ে দেয় ইভস সাঁ লোরের কথা। তেমন কোনো প্রেরণা কি ছিল?

গ্রেস মুন: না, সেটা নয়। বরং আমি আমার ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। সেটাই ছিল আমার প্রেরণা। আমি একজন কোরিয়ান–আমেরিকান। আমেরিকাতে থাকলেও আমাকে সবাই কোরিয়ানই ভাবে। এ জন্য আমি মনে করি একজন ডিজাইনারের আত্মপরিচয়টাই মুখ্য। নিউইয়র্কে আমি সেটাই করেছিলাম।

বস্তুত আমি উজ্জ্বল রং পছন্দ করি। এখানেও আমি উজ্জ্বল রঙের পোশাক উপস্থাপন করেছি। একেকটি রংকে আমি একেকভাবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করি। ফ্যাশন শো মানে তো আর কেবল কাপড় দেখানো নয়, বরং গল্পকথনও বটে। আমি অন্তত সেভাবেই ভাবি। উপস্থাপন করি।

এশিয়ান-আমেরিকানদের কাছে মুন এখন আইকন

প্রথম আলো: ১৮ বছরের একটা মেয়ে নিজের জগৎ ছেড়ে বিদেশবিভুঁইয়ে যাচ্ছে পড়তে। ভয় লাগেনি?

গ্রেস মুন: ভয়, তা আবার লাগবে না। আমি তো ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। কারণ, আমি ইংরেজি শিখলেও ভালো বলতে পারতাম না। এখানে তো ছেলেমেয়েরা বেশ ভালো ইংরেজি বলে দেখি।

প্রথম আলো: আর কেনই–বা ফ্যাশন ডিজাইন পড়তে যাওয়া?

গ্রেস মুন: ছোট থেকেই আমার হাতের কাজের প্রতি ঝোঁক ছিল। নিজে অনেক কিছুই বানাতাম। সহজাত এ বিষয়টা অবশ্যই ছিল। এর বাইরে আমি আসলে আইকন হতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম আমাকে দেখে যেন সবাই অনুপ্রাণিত হয়। যেটা আমার সময়ে ছিল না। সেটা হয়েছে। তবে কোরিয়ায় নয়, বরং আমেরিকা এবং ইউরোপের অভিবাসী এশিয়ানরা আমাকে অনুসরণ করে।

প্রথম আলো: কোরিয়া, জাপান এবং চীনের ডিজাইনাররা অনেক ভালো করছে। ফ্যাশন উইকগুলোতে যাচ্ছে। এ নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ?

গ্রেস মুন: অবশ্যই ওরা ভালো করছে। তবে এদের মধ্যে পার্থক্য আছে। কারণ, জাপানি ডিজাইনাররা পৃষ্ঠপোষকতা পায়, যেটা অন্যদের ক্ষেত্রে হয় না। আর এসব কাজে পৃষ্ঠপোষণা ভীষণই জরুরি। পাশাপাশি আরও একটা বিষয় বলা প্রয়োজন, আমি বাইরে থাকার কারণে সেটা অনুধাবন করতে পারি। আসলে পশ্চিমা ফ্যাশনজগতে মনোভাবটা বুঝতে পারা জরুরি। যেটা এশিয়ার ডিজাইনারার এখনো ধরতে পারে না।

আজিমের পাশে দাঁড়িয়েছেন মুন
ছবি: খালেদ সরকার

প্রথম আলো: ভারতীয়দের সম্পর্কে আপনার ধারণা?

গ্রেস মুন: ওদের মেধা আছে। রং নিয়ে খেলা করার বিষয়টা দারুণ। কিন্তু এর বাইরে আমি তেমন আর কোনো বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাই না, যেটা আমাকে আকর্ষণ করে বা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশংসিত হতে পারে।

প্রথম আলো: ভারতীয় ডিজাইনারদের সঙ্গে কাজ করার কোনো ইচ্ছা আছে কি না?

গ্রেস মুন: এটা ঠিক আমি তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও জানতে চাই। তাদের কাজের ধরন সম্পর্কেও জানার, দেখার ইচ্ছা পোষণ করি। কিন্তু কাজ করার ইচ্ছা নেই। তার চেয়ে বরং বাংলাদেশকে নিয়ে কাজ করতে চাই। এখানে অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে আছে। এদের পথ দেখাতে পারলে দারুণ কিছু হবে। আজিমের সঙ্গে কাজ করার কারণও কিন্তু সেটা।

কোকো শ্যানেলই মুনের চিরকালের আইডল
ছবি: উইকিপিডিয়া

প্রথম আলো: আপনার কি কোনো আইডল আছে?

গ্রেস মুন: অবশ্যই। কোকো শ্যানেল আমার চিরকালের আইডল। নানাভাবেই তিনি আমাকে প্রভাবিত করেন, প্রাণিত করেন।

প্রথম আলো: নতুনদের জন্য কোনো বার্তা?

গ্রেস মুন: কোনো সহজ পথ নেই সাফল্যের। বরং চেষ্টা করতে হবে। শিখতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কারণ, নিজেকে প্রতিনিয়ত ভাঙতে হবে। আবার গড়তে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সম্ভাবনা অনেকেরই থাকে। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে সাফল্যে রূপান্তর করতে পারে কজন? সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েই এগোতে হবে।

প্রথম আলো: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

গ্রেস মুন: ধন্যবাদ আপনাকেও।