সাদা-কালোয় অনুভূতি প্রকাশ

সাদা ও কালো। যদি বলি এই দুটি আলাদা কোনো রং নয়, চমকে উঠতে পারেন অনেকেই। বিজ্ঞান বলছে সাদা ও কালো এই দুটি একক কোনো রং নয়। সাদা রং তৈরি করে সূর্যরশ্মি। সূর্যের আলো যখন প্রিজমের মধ্য দিয়ে যায়, তখন লাল-সবুজ-নীল—এই তিন রং দেখা যায়। তা অনেক আগেই প্রমাণ করেছেন বিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন। আবার সাতরঙা গোলাকার শক্ত কোনো কাগজ বা বোর্ড জোরে ঘুরতে থাকলে দেখা যায় সব রংই উধাও—সাদা একটা কিছু চোখে পড়ছে।
বিজ্ঞানীরা বলেন আলোর অনুপস্থিতি হলো কালো। আবার িশল্পীদের কাছে সব রং মিশিয়ে তৈরি হয় কালো, সাদা তো ক্যানভাস। বলা হয় এই সাদা ও কালো একক রং নয়। দুটোই অনেক রঙের সমন্বয়। তাই এই দুটি রঙের প্রভাব হয়তো অনেক বেশি। বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ, বিশেষ আবেগ বা অনুভূতির প্রকাশ করা যায় সাদা-কালো দিয়ে।

পশ্চিমে নানা অনুষ্ঠান, দিন কিংবা আয়োজনে ড্রেসকোড, কালারকোড থাকলেও আমাদের দেশে নির্দিষ্টভাবে সে রকম কিছু নেই। তবে উপলক্ষ, দিনের আবহ বুঝে আমরাও কিন্তু পোশাকের রং ঠিক করি। জাতীয় শোক দিবস কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারির কোনো আয়োজনে গেলে সাদা-কালোর বাইরে খুব একটা আমরা যাই না। একুশের প্রথম প্রহরে বা ভোরের প্রভাতফেরিতে সাদা-কালো পোশাক, খালি পা—কাউকে বলে দিতে হয় না। যে বাড়িতে শোকের ঘটনা ঘটেছে, সেখানেও দেখা যায় স্বজন হারানো মানুষেরা শোকের প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিজের পরনের পোশাকটি বদলে সাদা বা কালো পোশাক পরে শামিল হচ্ছেন শেষযাত্রায়। আসলে পরিবেশ-পরিস্থিতি, আবেগ-অনুভূতি বলে দিচ্ছে ওই সময়ে কোন রং থাকবে পরনে।
দেশের একটি ফ্যাশন হাউসের নাম সাদাকালো। যেখানে শুধু সাদা ও কালো রঙের পোশাক তৈরি ও বিক্রি করা হয়। কথা হয় সাদাকালোর ডিজাইনার ও চেয়ারম্যান তাহসীনা শাহীনের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘কিছু কিছু অনুষ্ঠান, আয়োজন থাকে তাৎপর্যপূর্ণ। সাদা আর কালো এ দুটো রঙ সেরকম দিনে পরা হয়। কালো তো শোকের রঙই। এ রকম দিনে রঙিন বলতে যে রংগুলো বোঝায় সেগুলো দূরে রাখা হয়।’

গত এপ্রিলে একটি সাক্ষাৎকারের জন্য আড্ডা হচ্ছিল ডিজাইনার চন্দ্রশেখর সাহা ও তাহসীনা শাহীনের সঙ্গে। প্রশ্নটা ছিল এমন—শুধু সাদা ও কালো রঙের পোশাক নিয়ে একটা ফ্যাশন হাউস চালানো যায় কীভাবে? চন্দ্রশেখর সাহা তখন বলেছিলেন, ‘প্রায় সব ফ্যাশন হাউসেই কিছু না কিছু সাদা-কালো পোশাকের সংগ্রহ থাকে। একটা কোণে কিংবা একটা তাকে কিছু পোশাক থাকে। কিন্তু একটি ফ্যাশন হাউস শুধু সাদা-কালো পোশাক তৈরি করবে, এ ধারণা নতুন ছিল। আমাদের সংশয়ও ছিল। কিন্তু এখন দেখেন সাদাকালো আলাদা একটা জায়গা করে নিয়েছে। এমন কিছু দিন বা উপলক্ষ আছে যেখানে অংশ নিতে শাহীনদের এই দোকান থেকে পোশাক কিনতেই হবে।’
তাহ্সীনা শাহীনও বললেন এমনটাই—‘সাদা-কালো প্রাথমিক রং। এমন কারও ওয়ার্ডরোব নেই যেখানে সাদা-কালো পোশাক থাকে না। জীবনে অনেক উপলক্ষ আসে যেখানে এ দুটো রঙের বিকল্প নেই।’
সাদা ও কালো মানে সব রঙের সমন্বয়। এই দুই রঙের পোশাকে ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। এমনটাই জানালেন ফ্যাশন ডিজাইনার এমদাদ হক। তিনি বললেন, মূলত এই দুটি রং পরা হয় নিরপেক্ষতার জন্য। সাদা ও কালো নিরপেক্ষ রং মনে হয়। বয়সের জন্যও রঙের একটা ব্যাপার আছে। যখন নিরপেক্ষতা প্রকাশ করতে হয়। আবার ভাবগম্ভীর পরিবেশে কিংবা ভাবগাম্ভীর্যের কোনো আয়োজনে সাদা-কালো পোশাক পরা হয়। এ রকম আবহে অন্য উজ্জ্বল রংগুলো বাদ দেওয়াই উচিত।’
সাদা মানে শুধুই সাদা নয়। চাঁপা সাদা, ঘিয়ে সাদা, উজ্জ্বল সাদা—নানা শেড চলে আসে পোশাকে। কালোর বেলায়ও আছে বিভিন্ন শেড। আবার এই দুই রঙের মিশেলও দেখা যায় পোশাকে। যেগুলো আলাদা করেই নজর কাড়ে। শুধু সাদা বা শুধু কালো শার্ট, টি-শার্টও আজকাল তরুণদের পরনে দেখা যায়। এগুলোয় আভিজাত্য, আনুষ্ঠানিকতা যেমন প্রকাশ পায় তেমনি স্মার্ট লুকও চলে আসে।
শান্তির প্রতীক শ্বেতপায়রা। শান্তির জন্য তাই তো বেছে নেওয়া সাদা পোশাক। কোনো কোনো উপলক্ষ শান্ত, সমাহিত পরিবেশের, ভাবগাম্ভীর্যের। সেখানে সফেদ একটি পাঞ্জাবি যে আবেদন তৈরি করতে পারে, তা আর কোনো রংই পারে না। আর শোকের আবহে কালোর বিকল্প নেই। কালো তো শোক প্রকাশের প্রতীকই হয়ে উঠেছে।
সব রং ধারণ করে যে সাদা, যে কালো—শান্তির জন্য, শোক প্রকাশে, শ্রদ্ধা জানাতে কিংবা ভাবগাম্ভীর্য ধরে রাখতে ঘুরেফিরে সে দুটি রংই আসে। অন্য কোনো রং অনেকটাই বেমানান সেখানে।