ঈদের পাঞ্জাবিতে খায়রুল বাসার

সারা বছর কোনো না কোনো উপলক্ষে আমাদের পাঞ্জাবি পরা হয়ে থাকে। এবারের ঈদেও পরা হবে। ঈদবাজারে এবার কেমন ধারার পাঞ্জাবি চলছে, চলুন জেনে নিই

ঈদে নজর কাড়ছে সিল্কের পাঞ্জাবিনকশার আয়োজনে মডেল হয়েছেন অভিনেতা খায়রুল বাসার, পোশাক: সেইলর, কৃতজ্ঞতা: অরা বিউটি লাউঞ্জ, ছবি: সুমন ইউসুফ

বাঙালির জীবনে পাঞ্জাবি পোশাকটা উৎসবের সমার্থক হয়ে গেছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ—সব বয়সীর ঈদই নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া অসম্পূর্ণ। চাপকান, চোগা, আঙরাখা ইত্যাদি নানা প্যাটার্ন পেরিয়ে আজকের রূপ পেয়েছে পাঞ্জাবি।

পাঞ্জাবিতে হাতের কাজ
পাঞ্জাবি: কে ক্র্যাফট

ভারত ভাগের পরও উভয় বাংলার বাঙালির পাঞ্জাবির ঝুল ছিল খাটো। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ লম্বা ঝুলের দিকে ঝোঁকে। সেটা হয় আড়ংয়ের কল্যাণে। ১৯৮১-৮২ সালে। তবে সেই সময়ও ততটা বাড়ানো হয়নি; বরং ১৯৮৪ সালে উত্তর ভারত থেকে আড়ংয়ে আসা ডিজাইন পরামর্শকই ঝুল বাড়ানোর ঝুঁকি নিয়ে সফল হন। সেই সময়ে তো বটেই, তারও অনেক পর পর্যন্ত ঈদের পাঞ্জাবি মানেই ছিল সাদা। সেটা সব বয়সের জন্যই প্রযোজ্য। নব্বইয়ের দশকে এসে প্রবেশ ঘটে রঙের। তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে রঙিন পাঞ্জাবি। আর এখন তো সেটা সব বয়সীরই পছন্দ। গত চার দশকে বাংলাদেশে পাঞ্জাবি নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। এর কারণ, সারা বছর কোনো না কোনো উপলক্ষে আমাদের পাঞ্জাবি পরা হয়ে থাকে। এবারের ঈদেও পরা হবে। ঈদবাজারে এবার কেমন ধারার পাঞ্জাবি চলছে, চলুন জেনে নিই।

রং

প্রথম আসা যাক রঙের কথায়। এমন সব রঙে এবার পাঞ্জাবি তৈরি করা হয়েছে, একটা সময় যেটা ছিল কল্পনাতীত। বেনিআসহকলার সবটুকু যেন ঢেলে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য রঙেও উপচে পড়ছে প্যালেট। হলুদ, কালো, মেরুন, গাঢ় বেগুনি, নীল, বটল গ্রিন, বেগুনির মতো প্রগাঢ় রং যেমন আছে, তেমনি আছে বাদামি, প্যাস্টেল গ্রিন, মভ আর ডাস্টি পিঙ্কের মতো সতেজ শেড। বিশ্বরঙের বিপ্লব সাহা জানিয়েছেন, ঈদের পরপরই পয়লা বৈশাখ। রং নির্বাচনে এই বিষয়কেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে; যাতে এক পাঞ্জাবি উভয় উৎসবে পরা যায়।

পাঞ্জাবি বিনা বাঙালির ঈদ হয় না
পোশাক: ওটু

সৌন্দর্যবর্ধন

পাঞ্জাবিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলতে সূচিকর্ম আদি ও অকৃত্রিম মাধ্যম। পরবর্তী সময়ে যোগ হয়েছে অন্যান্য মাধ্যম। এখন সূচিকর্মের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মাধ্যম হলো মেশিন এমব্রয়ডারি, স্ক্রিন ব্লক, ছাপা নকশার টাই-ডাই ও বাটিক। চলতি ধারায় এখন ডিজিটাল প্রিন্টও আছে। আছে হাতে আঁকা ছবি। পাশাপাশি মিশ্র মাধ্যমও ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু সেখানে স্পষ্ট পরিমিতি সৌন্দর্য। কে ক্র্যাফটের পাঞ্জাবিতেও এই ধারা লক্ষ করা গেছে। ফ্যাশন ব্র্যান্ডটির পরিচালক খালিদ মাহমুদ খান জানান, তাঁদের এবারের পাঞ্জাবিতে আরামদায়ক কাপড়ের ওপর অলংকরণ করা হয়েছে। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, এমব্রয়ডারির ধরন পাল্টেছে। ডিজাইনের চাহিদামাফিক মোটিফের আকার ও আকৃতি অনুযায়ী করা হচ্ছে এমব্রয়ডারি। কখনো আবার পাঞ্জাবির সামনে বা পেছনের নকশার লে-আউট অনুযায়ীও করা হচ্ছে। তাতে করে নকশার স্থানের ব্যবহারকে নান্দনিক করে তোলার প্রয়াস পাচ্ছেন ডিজাইনাররা। কোনো পাঞ্জাবির পুরো জমিনে অলংকরণ করা হয়েছে তো কোনোটি কেবলই এক পাশে।

কাট আর প্যাটার্ন

পাঞ্জাবিতে একটা সময় ছিল কলিদারের রাজত্ব। কিন্তু পরে এক ছাঁটের পাঞ্জাবি দখল নেয় সিংহভাগ বাজার। এটা তৈরি করা সহজ। সময়ও লাগে কম। পাঞ্জাবির কাট আর প্যাটার্ন নিয়ে অনেক নিরীক্ষা হয়েছে। হচ্ছে। এমনকি ইয়ক, কলার ইত্যাদিও এই নিরীক্ষার অংশ হয়েছে। কাট আর প্যাটার্ননির্ভর পাঞ্জাবি একেবারে নতুন নয়। এ ধরনের পাঞ্জাবি আগেও দেখা গেছে। এবারও যাচ্ছে। কাপড়কে গুরুত্ব দিয়েই তৈরি করা হয়েছে। অনেক ভারী কাজের নকশা এবার নেই বললেই চলে। বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডেই এই ধারা লক্ষ করা যাচ্ছে। লা রিভও এর বাইরে নয়। এই ব্র্যান্ডের প্রধান নির্বাহী মন্নুজান নার্গিস জানালেন, তাঁদের এবারের থিম ইচ্ছাপূরণ। এর অধীনেই তাঁরা হালকা নকশার পাঞ্জাবি করেছেন। যেখানে প্রাধান্য পেয়েছে কাপড়ের টেক্সচার। কলার ও ইয়কেও পরিমিত অলংকরণ করা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী কলিদার পাঞ্জাবির পাশাপাশি এক ছাঁটের সাধারণ ফিট ও স্লিম ফিট পাঞ্জাবিও এবারের সংগ্রহে আছে বলে জানিয়েছেন অঞ্জন’স-এর শীর্ষ নির্বাহী শাহীন আহম্মেদ। আবার ফিটের দিক থেকে রেগুলার, ক্যাজুয়াল আর স্লিম, ঈদসংগ্রহে এবারও এই তিন ধরনের পাঞ্জাবি থাকবে।

পুরো কোটিতে ভারী কাজ
পাঞ্জাবি: টুয়েলভ

মোটিফ

থিমনির্ভর সংগ্রহ অনেকেই করেন। এবারও দেখা গেছে। থিম অনুযায়ীই বেছে নেওয়া হয়েছে মোটিফ। ফুল আর জ্যামিতিক নকশাই বেশি চোখে পড়েছে। ট্রাইবাল মোটিফের কাজও দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু পাঞ্জাবিতে ইসলামিক আর তুরস্কের মোটিফ নিয়ে কাজ করা হয়েছে, জানিয়েছেন মন্নুজান নার্গিস। উৎসবকে আলিঙ্গন করতেই বড়সড় পাঞ্জাবির সংগ্রহ তৈরি করেছে সারা লাইফস্টাইল। তবে ঈদের বিষয়টিকে ভাবনায় রেখে ঐতিহ্যবাহী মোটিফের পাশাপাশি জ্যামিতিক ও বিমূর্ত মোটিফকে প্রাধান্য দিয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্র্যান্ডের ডিজাইনার শামীম রহমান।

কাপড়

সুতিই আসলে আমাদের প্রথম পছন্দ। পাশাপাশি সিল্ক। যদিও ধীরে ধীরে যোগ হয়েছে হাত ও মেশিনে তৈরি নানা ধরনের কাপড়। এবার যেমন আছে প্লেইন কটন, জ্যাকার্ড কটন, অ্যান্ডি কটন, রেয়ন কটন, ভয়েল, অরগাঞ্জা, লিনেন, রেমি কটন, ভিসকস ইত্যাদি। বরাবরের মতো পোশাক কারখানার ফেলে দেওয়া কাপড় দিয়েও পাঞ্জাবি তৈরি করেছে অনেক ব্র্যান্ড। এসব কাপড় একরঙা যেমন আছে, তেমনি ছাপা কাপড়ের বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দিয়ে ডিজাইনাররা পাঞ্জাবির নকশা করেছেন।

অনুষঙ্গ

এবারে পাঞ্জাবির অনুষঙ্গ বলতে কোটি প্রাধান্য পাচ্ছে। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, আগে কোটি হতো একক অনুষঙ্গ। পাঞ্জাবির সঙ্গে পরা হলেও উভয়ের ডিজাইনে সামঞ্জস্য বা সম্পর্ক থাকত না। কিন্তু এবার এই বিষয় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে বলেই উভয়ের একটা যুগলবন্দী লক্ষ করা যাচ্ছে। পাশাপাশি একে অপরের পরিপূরকও হয়ে উঠতে পারছে। তাতে করে উভয় পোশাকের সামঞ্জস্যতার কারণে পরিধানকারী হয়ে উঠছেন স্টাইলিশ। কোটির এই সুচিন্তিত ডিজাইনের জন্য ডিজাইনাররা প্রশংসিত হবেন।