বিদেশিদের কাছেও যেভাবে জামদানি জনপ্রিয় করে তুলতে চান ফারহানা
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কাপড় জামদানির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নারায়ণগঞ্জের ডেমরার নাম। উদ্যোক্তা ফারহানা মুনমুন ডেমরার মেয়ে। তাই জন্মসূত্রেই হয়তো জামদানির প্রতি তাঁর বিশেষ ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসা থেকেই এখন তিনি পুরোদস্তুর জামদানি ব্যবসায়ী। তাঁর উদ্যোগের নাম ‘বেনে বৌ’। জামদানি শাড়ি থেকে শুরু করে এই কাপড়ের আপসাইক্লিং ও রিসাইক্লিং কাজ করে চলেছেন সমানতালে। দেশ-বিদেশের মানুষ তাঁর ক্রেতা।
যেভাবে শুরু
২০১৮ সালে বেশ ছোট পরিসরেই ফারহানা মুনমুন শুরু করেন বেনে বৌয়ের কাজ। পরিসর কিছুটা বাড়লে ২০১৯ সালে ফেসবুকে পেজ খোলেন। করোনা মহামারির সময় জামদানি তাঁতিদের দুরবস্থা দেখে প্রথমে ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলেন। হাতে কাজ নেই, তাঁতিরা ফোন করলেই কষ্টের কথা শোনাতেন। সে সময় নিজেকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন ফারহানা। ঠিক করেন, খুব কম লাভে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁতিদের ১০টি শাড়ি বিক্রি করে দেবেন। ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করতেই দ্রুত বিক্রি হয়ে যায় শাড়িগুলো। চ্যালেঞ্জে জিতে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন তিনি।
আপসাইক্লিং ও রিসাইক্লিং
জামদানি শাড়ি বিক্রির পাশাপাশি ফারহানা ২০২০ সাল থেকে শুরু করেন আপসাইক্লিং, রিসাইক্লিং ও ডাইভারসিফিকেশন বা বৈচিত্র্য আনার কাজ। এখন জামদানি দিয়ে তিনি তৈরি করছেন ব্যাগ, জুতা, গয়না, প্যাচওয়ার্কের জ্যাকেট, স্টোল, পাউচ, ল্যাম্প শেড, কটি, কুর্তা, ফতুয়া, শাল ইত্যাদি। কেন এসবে আগ্রহী হলেন? ফারহানা বলেন, ‘জামদানি শাড়ি বোনা ভীষণ কষ্টসাধ্য কাজ। তাঁতিরা এত কষ্ট করে একটা শাড়ি বোনেন, সেটা কয়েকবার পরার পর কিংবা সঠিকভাবে সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। আবার অনেকেই আছেন, যাঁরা জামদানি পছন্দ করেন কিন্তু এত দাম দিয়ে কিনতে পারেন না বা সব সময় শাড়ি পরা হয়ে ওঠে না; তাঁদের জন্যই মূলত আপসাইক্লিং ও রিসাইক্লিং। কেউ চাইলেই একটা স্টোল বা কটি কিনতে পারেন। বিশেষ করে যাঁরা প্রবাসে থাকেন। চাইলে জামদানি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে গোটা বিশ্ব ঘুরতে পারেন। যেটা তাঁরা শাড়ি পরে পারবেন না।’
এসব ভাবনা থেকেই মূলত জামদানি দিয়ে বৈচিত্র্য আনার কাজ শুরু করেন। এতে তাঁতির কষ্টে বোনা শাড়ির কোনো অংশই ফেলনা যাচ্ছে না। সব অংশ দিয়েই কিছু না কিছু তৈরি হচ্ছে। জামদানির যেহেতু ঐতিহ্যবাহী অনেক নকশা আছে, যেসব ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, সেসবও শাড়ি থেকে কেটে নিয়ে ফ্রেমে বাঁধাই করে ফেলছেন ফারহানা। এতে নকশাটি যেমন সংরক্ষণ হচ্ছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে ঘর সাজানোর চমৎকার দেশি উপকরণ।
মাসে গড়ে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করে বেনে বৌ। তবে কোনও কোনও মাসে বিক্রি হয় আরও বেশি। এখন পর্যন্ত মাসে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা বিক্রি করেছেন বলে জানালেন ফারহানা।
জামদানি আপসাইক্লিং ও রিসাইক্লিং করার সময় সবার আগে ফারহানা নিজে জিনিসটি ব্যবহার করে পরীক্ষা করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে অবাক হয়েছিলেন জামদানির জুতা পরে। কারণ, তিনি দেখেন, সাধারণ জামদানি শাড়ি পানিতে ভেজানো না গেলেও জামদানি জুতা পানিতে ভিজলে নষ্ট হয় না। ভেজা জুতা ঠিকমতো শুকিয়ে নিলেই আবার পরার উপযোগী হয়ে যায়।
শুরুতে জামদানি শাড়ি কেটেই কুর্তি, ফতুয়া, জ্যাকেট বানাতেন ফারহানা। কিন্তু এতে প্রচুর কাপড় নষ্ট হতো। তখন তাঁতির সঙ্গে পরামর্শ করে গজ কাপড় বানাতে শুরু করেন। এখন গজ কাপড় দিয়ে তৈরি করছেন নিত্যব্যবহার্য পণ্যগুলো।
বাজার তৈরি
জামদানি পণ্য বিদেশিরা দারুণ পছন্দ করেন বলে জানালেন ফারহানা মুনমুন। তবে তাঁর মতে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা জানেন না যে কোথায় কোন ধরনের পণ্যের চাহিদা বেশি। কীভাবে পাঠাবেন, সে তথ্যটিও তাঁদের কাছে নেই। নতুন বাজার তৈরির ক্ষেত্রেও কোনো সহায়তা পান না তাঁরা। তাই জামদানির বৈচিত্র্যময় পণ্যের বাজার সৃষ্টিতেই তাঁর বিশেষ নজর।