ইদানীং বিশ্বফ্যাশনে সর্পিল নকশার জয়জয়কার কেন
সাপবিষয়ক লোকগল্প ও রূপকথা যেন আমাদের ছেলেবেলার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাপ নিয়ে এ ধরনের গল্প যদি না শুনে বা পড়ে থাকেন, তাহলে অন্তত সিনেমা, সিরিয়াল বা কার্টুনে তো দেখেছেনই। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সাপ তাই তাৎপর্যপূর্ণ। এবার বিশ্বফ্যাশনেও সাপ রীতিমতো রাজকীয় আসনে জেঁকে বসেছে। কিন্তু কেন?
টেইলর সুইফট, জেন্ডায়া, জেনিফার লোপেজ বা প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মতো ফ্যাশনের রথী–মহারথীরা হরহামেশাই ফ্যাশনের বড় বড় লালগালিচায় সাপের নকশার অলংকার পরে উপস্থিত হচ্ছেন। আর সঙ্গে সাপকে পরিণত করছেন বিশ্বফ্যাশনের জনপ্রিয় প্রতীক হিসেবে।
স্নেক প্রিন্টের পোশাক থেকে শুরু করে বেল্ট, আংটি, গলার হার, চেইন, কানের দুল, মাথার মুকুট, চুলের গয়না, হাতের বালা, বাজু—সবখানেই দাপটের সঙ্গে জায়গা করে নিয়েছে সর্পিল নকশা।
কীভাবে সাপ এল গহনার নকশায়
রাশিচক্রের প্রতিটি প্রাণীকে নিয়ে নকশা তৈরি করা সহজ নয়। তবে সাপ এ ক্ষেত্রে অনন্য। চলতি চীনা চান্দ্রবর্ষের প্রতীক এবার সাপ। এদিকে গয়না ডিজাইনারদের জন্য সাপ যেন অতিপ্রিয়।
বিশ্বখ্যাত লাক্সারি গয়নার ব্র্যান্ড বুলগারি, কার্টিয়ার, কোল থেকে শুরু করে অনেকেই সাপের নকশাকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন বিশ্বব্যাপী। বুলগারি গয়না ও ঘড়ি সিরিজের মাধ্যমে সাপকে রীতিমতো ২০২৫ সালের ট্রেন্ডি ফ্যাশন আইকনে পরিণত করেছে।
কেন এত গুরুত্বপূর্ণ সাপ
বিভিন্ন দেশের পৌরাণিক কাহিনির বড় একটা জায়গা দখল করে আছে সাপ। প্রায় সব সভ্যতার লোকগল্পে সাপকে কোনো না কোনোভাবে স্থান ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সাপের খোলস বদলানোর ক্ষমতার কারণে এটি নবজন্ম, ফসল, স্বাস্থ্য ও উর্বরতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
গ্রিক চিকিৎসা দেবতা অ্যাসক্লেপিয়াসের দণ্ডের চারপাশে প্যাঁচানো সাপ সেই প্রতীকী ধারণাকেই বহন করে। আজও বহু স্বাস্থ্যসংস্থার লোগোয়, যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার লোগোতেই এই প্রতীক স্থান পেয়েছে।
একইভাবে ওরোবোরোস (যেখানে সাপ নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলছে এ রকম একটি ‘ইনিফিনিটি’ চিহ্ন)—অসীমতার ধারণাকে প্রকাশ করে। এই চিহ্ন প্রাচীন গ্রিক ও মিসরীয় সভ্যতা থেকে শুরু করে নর্স ও বৈদিক পুরাণেও পাওয়া যায়। এমনকি আমাদের ‘মনসামঙ্গল’–এর কথাই ধরুন না।
যা হোক, পাশ্চাত্য ঐতিহ্যে সাপকে প্রলোভনের প্রতীক হিসেবেও দেখা হয়, যা একই সঙ্গে আকর্ষণীয় ও বিপজ্জনক। সুন্দর, অথচ বিষধর—ভয় পাওয়ার মতোই মোহনীয়, এমন ধারণা ফ্যাশনে জনপ্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয়তা বেড়েছে সাপের। এভাবেই নকশার দৃষ্টিতে এটি তীক্ষ্ণ, রহস্যময় সৌন্দর্যের প্রতীক।
২০২৫ সালেই কেন এত জনপ্রিয়তা পেল সাপ
সাপের নকশা প্রাচীনকাল থেকেই ফ্যাশনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তবে এই ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে সাপ যেন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। এর পেছনে কলকাঠি নেড়েছে চীনা নববর্ষ।
চীনের সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোর একটি, বর্ণিল ও গভীরভাবে শ্রদ্ধেয় ঐতিহ্য হলো চীনা নববর্ষ। কেবল চীনের মানুষেরাই নন, বিশ্বজুড়ে উদ্যাপিত হয় নতুন চান্দ্রবর্ষ। এই উৎসবের ইতিহাস প্রায় ৪ হাজার বছরের। চীনে একেক বছর একেক প্রাণী প্রতিনিধিত্ব করে। আর ২০২৫ সাল হলো সাপের বছর। রহস্যময় সৌন্দর্য ও প্রতীকী শক্তির জন্য সাপের আছে আলাদা কদর।
চীনা পুরাণে সাপ হলো জ্ঞান, অন্তর্দৃষ্টি ও রূপান্তরের প্রতীক। বিশ্বাস করা হয়, এই প্রতীকের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা হন বুদ্ধিমান, আকর্ষণীয় এবং জীবনের বাঁকবদলে সহজে মানিয়ে নিতে সক্ষম।
ইতিহাসে সাপ ও গয়নার বন্ধন
প্রাচীন রোমের জাঁকজমকপূর্ণ সাপের বালা থেকে শুরু করে ভিক্টোরীয় যুগের প্রেমের প্রতীক সাপের আংটি—এই মোটিফ শিল্পী ও ব্যবহারকারী উভয়কেই মুগ্ধ করেছে যুগে যুগে।
২০ শতকে বুলগারি তার সার্পেন্টি সংগ্রহের মাধ্যমে সাপকে বিলাসিতার স্থায়ী প্রতীকে রূপ দেয়; যেখানে মূল্যবান রত্নে মোড়ানো সর্পিল নকশা ছাড়িয়ে যায় সময়কে। আর এ বছর আন্তর্জাতিক ফ্যাশন আইকনদের মাধ্যমে বিশ্বের ফ্যাশন মুহূর্তগুলোকে বিশেষ করতে খেল দেখিয়েছে এই সাপের গয়নাগুলো।
বিলাসবহুল গয়না ও সাপ–সম্পর্কিত ১০টি চমকপ্রদ বিষয়
১. চিরন্তনতা ও পুনর্জন্মের প্রতীক: খোলস বদলের বিষয়টি সাপকে করে তুলেছে নবজন্ম ও অমরত্বের প্রতীক। গয়নায় এই ধারণা সর্পিল ও বৃত্তাকার নকশায় ফুটে ওঠে।
২. ভিক্টোরীয় যুগের ভালোবাসার প্রতীক: রাজপুত্র অ্যালবার্ট যখন রানি ভিক্টোরিয়াকে সাপ আকৃতির আংটি উপহার দেন, সেটি হয়ে ওঠে ভালোবাসা ও প্রজ্ঞার প্রতীক।
৩. বুলগারির সার্পেন্টি সংগ্রহ: সাপকে আধুনিক বিলাসিতার প্রতীকে রূপ দেওয়া এই সংগ্রহে হীরা, রুবি ও পান্নাখচিত সর্পিল নকশা রয়েছে।
৪. প্রাচীন মিসরীয় রাজকীয়তা: মিসরের পবিত্র কোবরা সুরক্ষা ও দেবত্বের প্রতীক ছিল, যা ফারাওদের গয়না ও মুকুটে ব্যবহৃত হতো।
৫. গ্রিক চিকিৎসা প্রতীক: অ্যাসক্লেপিয়াসের দণ্ডে সাপের উপস্থিতি স্বাস্থ্য ও প্রাণশক্তির প্রতীক।
৬. ব্যক্তিগত নকশার স্বাধীনতা: আধুনিক বিলাসবহুল গয়নাগুলোয় সাপের মোটিফকে কাস্টমাইজ করে তৈরি করা হয়। যেমন প্যাঁচানো ব্রেসলেট, আংটি বা হার। এসব দিব্যি পরিধানকারীর দেহের সঙ্গে মানিয়ে যায়।
৭. অনন্য কারিগরি দক্ষতা: সাপের আঁশ ও চলাফেরার মতো সূক্ষ্ম টেক্সচার অনুকরণে গয়নাশিল্পীরা দেখান নিজস্ব নৈপুণ্য।
৮. গোপন বৈশিষ্ট্য: অনেক সর্পিল নকশার ভেতরে ব্যক্তিগত নানা ধরনের বিষয় সিম্বল বা প্রতীক আকারে রাখেন।
৯. বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক তাৎপর্য: হিন্দু পুরাণের নাগ বা নর্স পৌরাণিক কাহিনি—সবখানেই সাপ নানাভাবে অনুপ্রেরণার উৎস।
১০. চিরন্তন আকর্ষণ: প্রলোভন ও সুরক্ষার দ্বৈত প্রতীক হিসেবে গয়নার জগতে সাপ চিরকালীন প্রেরণা।
সূত্র: ন্যাচারাল ডায়মন্ডস ও ভোগ