পোশাকে আর অন্দরে রিকশাচিত্র জনপ্রিয় হয়ে উঠল যেভাবে

দেশি ফ্যাশনের ব্র্যান্ডগুলো পোশাকের ওপর কাজ করছে রিকশাচিত্র নিয়েমডেল: সৌম্য জ্যোতি ও দিব্য জ্যোতি, শার্ট: যাত্রা, টি–শার্ট: বিস্কুট ফ্যাক্টরী, ছবি: সুমন ইউসুফ

ফ্যাশন আর জীবনযাপনের অনুষঙ্গে রিকশাচিত্র এখন জনপ্রিয়। এ যেন বাঙালির রঙিন মনেরই প্রতিফলন।  রিকশার পেছনের এক টুকরা টিনের পাত থেকে উঠে আসা রিকশাচিত্র রঙিন করে তুলেছে পোশাক আর অন্দরের সাজসজ্জা। আরও আনন্দের খবর হলো বাউলগান, জামদানি বুননশিল্প, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও শীতলপাটির পর ইউনেসকোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে বিজয়ের মাসে স্বীকৃতি পেয়েছে ‘রিকশা ও রিকশাচিত্র’।

কেতলির ওপর দেখা যাচ্ছে রিকশাচিত্র
ছবি: নকশা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জ্বালানিসংকট দেখা দিলে সে সময় বেশ কয়েকটি দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রিকশা। ১৮৭০ সালে জাপানে তিন চাকার রিকশার সূত্রপাত হয়। ১৯২০–এর দশকে হাতে টানা রিকশার দেখা মেলে কলকাতায়। ঢাকায় ১৯৩৮ সালে শুরু হয় সাইকেল রিকশা চালানো। রিকশা যেখানে যে সময়েই আসুক না কেন, এই জাদুর শহর ঢাকা রিকশাকে যেভাবে আপন করে নিয়েছে, তেমনটা বিশ্বের আর কোথাও ঘটেনি। রিকশাচিত্র যে একান্তই আমাদের, এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক চলে না। প্রতিদিন চোখের সামনে দেখতে পাওয়া এই রিকশা যেন এক চলমান আর্ট গ্যালারি।

ময়ূর, মায়ের দোয়া, শাবানা-ববিতা থেকে টাইটানিক জাহাজ

তরুণেরা রিকশাচিত্রের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন, সাদরে গ্রহণ করেছেন।
ব্যাগ ও টুপি: যাত্রা, টি–শার্ট ও জুতা: বিস্কুট ফ্যাক্টরী, ছবি: সুমন ইউসুফ

সাতচল্লিশের দেশভাগের পর বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলার ধারার পাশাপাশি অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের হাত ধরে সিনেমার ব্যানার পেইন্টিং, রিকশা আর্ট, ট্রাক আর্ট ও টেম্পো আর্টের মতো শিল্প বিকশিত হতে থাকে। রিকশাচিত্র যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের হাত ধরে আসেনি, তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে, সরল উপস্থাপনায় উঠে আসে সংস্কৃতি আর জীবনযাপনের একান্ত প্রতিচ্ছবি। ষাটের দশকে রিকশা পেইন্টিংয়ে দেখা যেত বাংলা সিনেমার ‘তুমুল হিট’ তারকাদের প্রতিকৃতি। এরই ধারাবাহিকতায় পরে দেখা গেল রংবাজ, বেদের মেয়ে জোস্‌না, নিশান চলচ্চিত্রের মোটিফের রিকশা পেইন্টগুলো। সেসব এতই জনপ্রিয় যে আজও কোথাও কোথাও চোখে পড়ে। এরপর বিভিন্ন সময়ে উঠে আসে ফুল-পাতা, চাঁদ-তারা, শাপলা-পদ্ম থেকে শুরু করে শিয়াল, বাঘ, খরগোশ, বিভিন্ন উপাখ্যানের চরিত্র, ভিউ কার্ডের বিদেশি দৃশ্য থেকে অনুপ্রাণিত জাপানের বাড়ি, লন্ডনের ব্রিজ, আইফেল টাওয়ার, টাইটানিক জাহাজ, মরুভূমির উট-বেদুইন ইত্যাদি। স্মৃতিসৌধ, ময়ূর, সংসদ ভবন, শহীদ মিনার, তাজমহল উঠে এসেছে রিকশাচিত্রে, নিজস্ব ঢঙে। উঠে এসেছে মায়ের দোয়া, ভাই-বোন, আল্লাহর নামে চলিলাম, জন্ম থেকে জ্বলছি—এসব লেখাও।

ফ্যাশনের মোড়কে রিকশাচিত্র ঢুকে পড়ল ওয়ার্ডরোবে, ড্রয়িংরুমে

হেলমেটের ওপর রিকশাচিত্র
ছবি: নকশা

গত এক দশকে দেশি ফ্যাশন হাউসগুলোর হাত ধরে রিকশাচিত্র ঢুকে পড়েছে অভিজাত শ্রেণির ওয়ার্ডরোবে। তারপর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। শুরুতে যাত্রা, আড়ং, বিবিয়ানা, বিবি প্রোডাকশন, রঙ, কে ক্র্যাফট থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটা দেশি ফ্যাশনের ব্র্যান্ড শাড়ির ওপর রিকশাচিত্রের কাজ শুরু করে। সেটা সাদরে গ্রহণ করেন শিল্পমনা ফ্যাশনিস্তারা। এরপর ব্লাউজ, থ্রি–পিস হয়ে পাঞ্জাবি, কুশন, পর্দা, টি-শার্ট, ফতুয়া থেকে শুরু করে চুড়ি, ব্যাগ, কানের দুল, টিপে উঠে এল রিকশাচিত্র।

রিকশাচিত্র ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে সব ধরনের সামগ্রীতে
ছবি: নকশা

রিকশাচিত্র নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের একজন ফ্যাশন হাউস বিবিয়ানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিপি খন্দকার। তিনি ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল—একাধারে চার বছর কাজ করেছেন রিকশাচিত্র নিয়ে। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম আর গাজীপুরের রিকশার ওপরের রেক্সিনের নকশা নিয়ে গবেষণা করেন। সেখান থেকে ম্যাজেন্টা, রানি গোলাপি, এমারেল্ড গ্রিন, স্কারলেট রেড, কালো প্রভৃতি রং নিয়ে কাজ করেন। চারটি সিরিজে বের করেন রিকশাচিত্র থেকে অনুপ্রাণিত ফ্যাশনপণ্য। রিকশাচিত্রের থিমে তৈরি ফ্যাশনপণ্যগুলো নিয়ে নেপালে ফ্যাশন শোও করেছেন। লিপি বললেন, ‘আমি রিকশার কারখানায় গিয়ে দেখি, কীভাবে প্লাস্টিকের রেক্সিনের রঙিন ঝালর কেটে কেটে একটার ওপর একটা বসিয়ে কাজ চলছে। আর আমার মাথায় তখন চলছে কীভাবে আমি অ্যাপ্লিক আর হ্যান্ড এমব্রয়ডারির মাধ্যমে কাপড় জোড়া দিয়ে দিয়ে কাজগুলো করব। সেখান থেকে ফিরেই আমি কাজ শুরু করে দিয়েছি। শুরুতে পয়লা বৈশাখের শাড়ি করলাম। কেননা বৈশাখটা আমাদের খুবই রঙিন একটা উৎসব।’ এই ডিজাইনার জানান, রিকশাচিত্রের থিমে তৈরি শাড়ি এত জনপ্রিয়তা পেল যে তাঁরা আরও পোশাক, গয়না, ঘর সাজানোর উপকরণ, মগেও নিয়ে এলেন রিকশাচিত্র। সেগুলোও সাদরে গ্রহণ করলেন ভোক্তারা।

সানগ্লাসের ওপর করা রিকশাচিত্র জনপ্রিয়তা পেয়েছে তরুণদের মাঝে
ছবি: নকশা

সময়ের সঙ্গে রিকশাগুলো যতই রং হারিয়েছে, তার বিপরীতে রিকশাচিত্রে আরও বেশি করে রঙিন হয়েছে বাড়ির অন্দর, জীবনধারা। ২০২৩–এ দাঁড়িয়ে চশমা বা রোদচশমা, মুঠোফোনের খাপ (কভার), স্যান্ডেল, সোফা, পর্দা, ফুলদানি, চেয়ার–টেবিল, কেটলি, টেবিল ল্যাম্প, বুকস্ট্যান্ড, চায়ের কাপ, ছবির ফ্রেম, হেলমেট, বদনা, রান্নাঘরের ক্যাবিনেট, হারিকেন, মগ, টিফিন বাটি, গয়নার বাক্স, বয়াম, টিনের ট্রাংক, ড্রয়িংরুমের দেয়াল—রিকশাচিত্রে রঙিন হতে আর কী বাকি আছে, সেটাই যেন এখন খুঁজে দেখার পালা।

১৯৯৯ সালে যাত্রার যাত্রা শুরু। প্রায় প্রথম থেকেই বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে এই নকশা তুলে ধরেন চিত্রকরেরা। যাত্রার মহাব্যবস্থাপক আনুশেহ আনাদিলের মতে, রিকশাচিত্রের এই ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার পেছনে রয়েছে এর ‘ভাইব্র্যান্ট, ইউথলাইক ও ক্রেজি’ হাবভাব। এই উদ্যোক্তা ও শিল্পীর মতে, রিকশাচিত্রে যেভাবে জীবন আর শিল্প অনায়াসে এক হয়ে যায়, সেটা অনন্য! এখন তো ওয়ান কালচার, নৈসর্গিক, সরলাসহ অনলাইনে অনেকেই বিক্রি করে রিকশাচিত্রের পণ্য।

উজ্জ্বল আর উচ্ছল রিকশাচিত্র
ছবি: সুমন ইউসুফ

নানা অনুষঙ্গে রিকশাচিত্র নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের ভেতর অন্যতম বিস্কুট ফ্যাক্টরি। এর কর্ণধার বিস্কুট আবির এখন পর্যন্ত অন্তত ১৫ হাজার নকশা আঁকা চশমা বিক্রি করেছেন। ২০১৫ সালে কাজ শুরু করেন তিনি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর কাজ করেছেন রিকশাচিত্র নিয়ে। এরপর বাবা হওয়া উপলক্ষে নেন বিরতি। এই শিল্পী আর উদ্যোক্তা বললেন, ‘এমনও হয়েছে যে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানেই আমি এক হাজার সানগ্লাসের ফরমাশ পেয়েছি। গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে রিকশাচিত্রের ফন্টে লিখেছি, “গায়েহলুদ দিবি কি না বল”। ...মুঠোফোনের কেস বিক্রি করেছি পাঁচ হাজারের ওপর। এর সবই ছিল তরুণদের জন্য একেবারেই নতুন। তাঁরা আগ্রহ দেখিয়েছেন, সাদরে গ্রহণ করেছেন। তাই রীতিমতো একটা বিপ্লব ঘটে গেছে। এখন তো সমানে ডিজিটাল প্রিন্টেও চলছে রিকশাচিত্র। এটা হওয়ারই ছিল, হওয়াটা খুব দরকারও ছিল।’

শিতের জ্যাকেটেও আছে এই ধারা
ছবি: সুমন ইউসুফ

’ অনেকে আবার গায়েহলুদের কাস্টমাইজড পোশাকও করছেন রিকশাচিত্রের থিমে।

রিকশাচিত্র এখন ইউনেসকোর স্বীকৃতি পেয়ে আলোচনায়। বিজয়ের মাসে আমাদের জন্য বড় সুসংবাদ। তবে এর পেছনের কারিগরেরা রয়ে গেছেন পাদপ্রদীপের নিচে। রিকশাচিত্রের এখনকার মূলধারার বাণিজ্যিক কাজ, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ আর কর্মশালায় যুক্ত করতে হবে এর সত্যিকারের কারিগরদের। কেননা ইউনেসকোর এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পেছনের ‘আনসাং হিরো’ তো তাঁরাই!