টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়েই বাঁচতে চাই

টাঙ্গাইলের পাথরাইল গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটা মুনিরা এমদাদ-এর বড় প্রিয়। বোনের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার সূত্রে রাস্তাটির সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তখন এটি ছিল কাঁচা–পাকা, দুই পাশে ফুটে থাকত লাল শিমুল। প্রথম দেখার সেই ভালো লাগা আজও অটুট। যেমন অব্যাহত আছে তাঁর পাথরাইল–যাত্রা। বাংলাদেশের ফ্যাশনে টাঙ্গাইল শাড়িকে পরিচিত করে তোলা আর পাথরাইলে টাঙ্গাইল শাড়ির পুনর্জাগরণের পেছনে মুনিরা এমদাদ ও তাঁর টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের ভূমিকা অনেক। গত ২৮ মার্চ বেইলি রোডে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন রয়া মুনতাসীর

প্রথম আলো :

টাঙ্গাইল শাড়ির প্রতি ভালোবাসা তৈরি হলো কী করে?

১৯৮২ সালের কথা। আমার বোনের শ্বশুরবাড়ি ছিল টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলায়। দেলদুয়ারের একটা ইউনিয়ন পাথরাইল। পাথরাইল গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া-আসা করতে হতো। তখন ভালো রাস্তা ছিল না। কাঁচা-পাকা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানকার তাঁতিদের কাজ দেখতে পেতাম। ওঁদের কথা আগেই শুনেছিলাম। তাঁদের দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। কাজের মান ভালো হলেও নকশার কারণে নিজের জন্য কিনতে পারছিলাম না। শহরকেন্দ্রিক নারীদের জন্য মানানসই নকশার শাড়ি বানাতে পারতেন না তাঁরা। সাড়ে ১০ হাত, ১১ হাতের শাড়ি বানাতেন তাঁরা। কিছু একটা করতে চাইলাম। আমার স্বামীকে (প্রকৌশলী ইমদাদুল হক) বললাম। প্রথমে রাজি হননি। ওখানে গিয়ে নিয়মিত কাজ করাটা কঠিন ছিল। মাসে একবার যাব বলে ঠিক করলাম। শুরু হলো আমার কাজ—তিনজন তাঁতিকে নিয়ে। ১২ হাতের শাড়ি বোনানো শুরু করলাম ওদের দিয়ে। এরপর ব্লাউজ বানানোর জন্য যে বাড়তি কাপড় দরকার, সেটাও শাড়িতে যোগ করতে বললাম। তাঁদের কাজগুলোকেই প্রাধান্য দিতাম, শুধু রঙের বিন্যাসটা বদলে দিতাম। এরপর দোকানও দিলাম। আমি তখন থাকতাম বনানীতে। বেইলি রোডের এই জায়গাটায় দুটি ঘর নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। একজন কর্মী ছিল। যেদিন টাঙ্গাইলে যেতাম, সেদিন দোকান বন্ধ থাকত। আমার ছেলে তখন খুব ছোট। ওকে সঙ্গে করে নিয়েই চলে যেতাম। তাঁতিদের বাড়িতেই সারা দিন কেটে যেত। শুধু ওঁদের কাজ না, ব্যবহারও মন কেড়ে নেয়।

টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়েই বাঁচতে চান মুনিরা এমদাদ
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

প্রথম আলো :

টাঙ্গাইল শাড়ির পরিবর্তন কী দেখলেন?

টাঙ্গাইল শাড়িতে আগে বেশি দেখা যেত বুটির কাজ। তখন জ্যাকার্ডে বোনা শাড়ির পরিমাণ ছিল কম। পাড় ছোট ছিল, আঁচল ছিল না। মিরপুরের তাঁতিদের সহায়তা নিয়ে শাড়িতে আঁচল বসানোর কাজ শুরু হলো। পরে পাওয়ারলুম এসেছে। তবে হাতে বোনা বুটি শাড়ির দাম বেশি। মেশিনে করা হলে দাম কমে আসে অনেকটাই।

প্রথম আলো:

এই শাড়ির মূল সৌন্দর্য কোথায় বলে মনে করেন?

টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের আবহাওয়া, নদী, গ্রামের গাছের গল্পই তুলে ধরে। আমাদের অন্য পোশাকে অতটা ভালো লাগে না, যতটা তাঁতের শাড়িতে মানায়, এটা আমার কাছে মনে হয়। টাঙ্গাইলের শাড়ি কম দামেও পাবেন, বেশি দামেও পাবেন। সুন্দর একটা ব্লাউজ দিয়ে একটু গুছিয়ে পরলে সাজে আভিজাত্য চলে আসে।

পুরোনো নকশার আদলে তৈরি করা নতুন জামদানি
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

প্রথম আলো :

টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির বাংলাদেশের আর কোন কোন অঞ্চলের শাড়ি বা কাপড় তুলে ধরছে?

আমি পুরো বাংলাদেশ থেকে আনা কাপড় আর শাড়ি এখানে রাখছি। টাঙ্গাইল শাড়ি আর রূপগঞ্জের জামদানি, সিলেটের মণিপুরি, রাজশাহীর সপুরা সিল্ক, টাঙ্গাইলের সিল্ক, টাঙ্গাইলের মসলিন ইত্যাদি।

প্রথম আলো :

টাঙ্গাইল থেকে কী ধরনের কাজ করিয়ে আনেন?

টাঙ্গাইলের একটা গুণ হলো, অনেক ধরনের কাজ এখানে করা যায়। সুতি, সিল্ক, জামদানি, সিনথেটিক—সব ধরনের কাপড়ই তৈরি হচ্ছে। আমি শাড়ি বা পোশাকে শিবোরি, টাইডাই, ব্লকপ্রিন্ট, এমব্রয়ডারিসহ অনেক ধরনের কাজ করাচ্ছি, কিন্তু কাপড়টি বুনিয়েছি টাঙ্গাইল থেকে।

কাতানও পাওয়া যায় টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

প্রথম আলো :

এত দিনের পথচলা, নিশ্চয়ই অনেক স্মরণীয় স্মৃতি আছে?

১৯৮৩ সালের এপ্রিল মাসের কথা। রাতে হঠাৎ ফোন এল। দোকানে কোনো শাড়ি নেই। শুনে তো ভয়ই পেয়ে গেলাম, কী হলো? মহিলা সমিতির নাটক না হলে পুরো বেইলি রোডই তখন নীরব থাকত। ভাবলাম খারাপ কিছু। আসলে পয়লা বৈশাখের কারণে সব কাপড় বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। দোকান শুরু করার পরপর এমন একটা ঘটনা, এখনো মনে পড়ে।

প্রথম আলো:

সেই সময়ের সঙ্গে এ সময়ের টাঙ্গাইলে কাজের পরিবেশে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান?

মুনিরা এমদাদের সারাদিন কেটে যায় শাড়ির মাঝেই
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

আমি যখন কাজ শুরু করলাম, তখন তাঁতিদের বাড়িতে যেতাম। দেখতাম তাঁদের স্ত্রীরা সুতায় নলি ভরছেন। সুতা পলিশ করে, মাড় দিয়ে, নলি ভরতেন। সেটা আবার তাঁতে আটকানো (ফিট করা) হতো। তাঁরা সব সময় এই কাজটিকে বাড়ির কাজ বলেই মনে করতেন। কখনো বাড়তি কাজ হিসেবে ধরতেন না। কিন্তু এখন অবস্থা পাল্টে গেছে। এখন অবস্থাপন্ন হয়ে যাওয়ায় এ ধরনের কাজ তাঁতিদের স্ত্রীরা আর করছেন না। নলি ভরার লোক এখন ভাড়া করে আনতে হয়। হাতে বোনা তাঁতও কমে গেছে। এখন মেশিনেই বেশি কাজ করা হয়। সিনথেটিক কাপড় বানানো হচ্ছে বেশি। সিনথেটিক কী মাত্রায় ব্যবহার করব, এ নিয়ে একটা আইন থাকা উচিত। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গেলে দেখা যায় এ ধরনের কাপড় পরার কারণে আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে যায়। টাঙ্গাইলেও এখন প্রচুর পরিমাণে সিনথেটিক কাপড় ব্যবহার করা হচ্ছে। দাম কম, চকচকে হওয়ার কারণে বিক্রিও হচ্ছে অনেক। যাঁরা চেনেন না, তাঁরা একে সিল্ক মনে করেন।

প্রথম আলো:

টাঙ্গাইলে বোনা জামদানি শাড়িগুলোর সঙ্গে অন্য জামদানি শাড়ির পার্থক্য কী?

টাঙ্গাইলের শাড়িগুলো এখন মূলত মেশিনে করা হয়। রূপগঞ্জের জামদানি হাতে বোনা হয়।

প্রথম আলো :

জামদানি শাড়িতে অনেকেই বাড়তি কিছু যোগ করেন। এটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আমার কাছে বিষয়টি ভালো লাগেনি, এ কারণে আমি সেটা করিও না। জামদানির একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। সেটা কেন নষ্ট করব? সারা বিশ্বের কাছে এটা আমাদের সম্পত্তি। এর ওপর কেন বাড়তি কাজ করব।

টাঙ্গাইলে তৈরি করা জামদানি শাড়ি
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

প্রথম আলো :

আজ থেকে ৫০ বছর পর আমাদের দেশের তাঁতে বোনা কাপড়ের ভবিষ্যৎ কী?

নতুন প্রজন্ম তাঁতে বসছে না। ৫০ বছর পর জামদানি পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ আছে। হাতে টাকা চলে এলে এই কাজ আর কেউ করতে চাচ্ছে না। আমি যখন কাজ শুরু করি, তাঁরা সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করে দিতেন। বেশ নিয়মের মধ্য দিয়েই পারিবারিকভাবে কাজটি করা হতো।

প্রথম আলো :

আমাদের এখানে কি ভালো মানের সুতা পাওয়া যায়?

আমাদের দেশে ১০০ কাউন্টের সুতা পেতেই অনেক কষ্ট করতে হয়। তাঁতিদের ১০০ কাউন্টের সুতা ব্যক্তিগতভাবে আমাদের পৌঁছে দিতে হয়। এখানকার বাজার মনে করে মোটা সুতার চাহিদা বেশি। এ কারণে বেশি কাউন্টের সুতা সহজলভ্য নয়। খুব ভালো কাপড়গুলোয় ১০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হয়। অনেক শাড়িতে একদিকে ১০০, আরেক দিকে ৮৪ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া ৭৪ কাউন্ট, ৭০ কাউন্টের সুতার কম দামি শাড়িও বানানো হচ্ছে। টাঙ্গাইলে ৫০০ টাকার শাড়িও যেমন পাওয়া যায়, আবার ৫০ হাজার টাকার শাড়িও পাওয়া যায়। শাড়ির দাম কমে-বাড়ে কারিগরদের মজুরির ওপর ভিত্তি করে।

টাঙ্গাইলের পাথরাইলে প্রতিদিনই তৈরি করা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন নতুন শাড়ি
ছবি: সুমন ইউসুফ

প্রথম আলো :

একটা জামদানি শাড়ি কিনতে গেলে বেশ কয়েক হাজার টাকা থেকে লাখ টাকাও লাগে। এটা কি কমিয়ে আনা সম্ভব? চাইলেও অনেকে কেন জামদানি শাড়ি কিনে পরতে পারেন না?

জামদানি বানানোর উপকরণের দাম খুব কম। দামি শাড়ির জন্য ১ হাজার টাকার বেশি উপকরণ লাগে না। কিন্তু কত দিন ধরে সেটা বানানো হচ্ছে, সেটার ওপর দাম নির্ধারণ হয়। এরপর আছে কারিগরদের মজুরি। একজন ওস্তাদ, আরেকজন শাগরেদ থাকে। এরপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) যোগ হয়। এ কারণে দাম বেড়ে যায়। দিনপ্রতি এখন কারিগরদের মজুরি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। যাঁরা দক্ষ, তাঁরা ৭০০ টাকা করে পান। অন্যরা ৬০০ টাকা করে।

আমি পুরোনো জামদানি থেকে নকশা বের করি। তারপর এটাকে নতুন সেটআপে বসাই। টাঙ্গাইলে সিনথেটিক দিয়ে জামদানির মোটিফে শাড়ি তৈরি হচ্ছে। অনেক ক্রেতা বুঝতে পারেন না। জামদানির নকশা বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা ভালো না। মোটিফের তো অভাব নেই। জামদানির নকশা দিতে মানা করি।

প্রথম আলো:

ক্রেতাদের জন্য কী ধরনের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন?

টাঙ্গাইলের বুননে স্কার্ফ, টপস—এগুলো এখন করা দরকার নতুন প্রজন্মকে আগ্রহী করে তোলার জন্য।

প্রথম আলো :

বাজারে টাঙ্গাইলের শাড়ির চাহিদা কি কমে যাচ্ছে?

আসলে এখন তো অনেকেই আর শাড়ি পরতে চায় না। লাইফস্টাইলের কারণে শাড়ি পরা কমে গেছে।

প্রথম আলো:

এত বছর ধরে শাড়ি নিয়ে কাজ করছেন, কোন কাজটি করতে ভালো লাগে?

নতুন কিছু করতে পারলে ভালো লাগে। সৃজনশীল দিকটি আমাকে টানে। কখনো একঘেয়েমি কাজ করে না। এই শাড়ি নিয়ে কাজটাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

সিল্কের শাড়িতে টাই–ডাইয়ের কাজ
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

প্রথম আলো :

১০ থেকে ২০ বছর পর টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরকে নিয়ে কী করতে চান?

এই চিন্তা মাঝেমধ্যেই পেয়ে বসে—আমি না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে চালানো যায়, আদর্শ বজায় রেখে। আমার কারিগর আর কর্মীরাও বলেন, এটা এখন শুধু আপনার নয়, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির এখন আমাদেরও।