সাজে অনুষঙ্গে বাংলা

শুধু পোশাকেই নয় সাজের নানা অনুষঙ্গে দেখা যাচ্ছে ভাষার ব্যবহার। বছরজুড়েই তরুণেরা দৈনন্দিন জীবনে স্টাইলের সঙ্গে তুলে ধরছেন এসব অনুষঙ্গ।

পোশাক কিংবা ব্যাগে ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলা ভাষা।মডেল: অভিনেত্রী সুনেরাহ্ বিনতে কামাল, পোশাক: যাত্রা মেলা, ব্যাগ: অহং, টিপ: আরটোপলিশ, স্থান: যাত্রা মেলা, সাজ: অরা বিউটি লাউঞ্জ, ছবি: কবির হোসেন

পোশাকে বাংলা লেখার ব্যবহার নতুন নয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই ভাষার মাস, স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিজয়ের মাসে পরা হচ্ছে বাংলা লেখাযুক্ত পোশাক। ইদানীং এই দৃশ্যপটে আরও কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন চোখে পড়ছে।

ব্লাউজে, শাড়িতে, চায়ের মগে তুলে ধরা হচ্ছে নানা ধরনের লেখা
ছবি: কবির হোসেন

১. বছরজুড়েই এখন পরা হয় বাংলা বর্ণ, কবিতা, গান লেখা পোশাক।

২. পোশাকের বাইরে সাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গেও ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলা।

৩. অন্দরসাজেও এখন বাংলা লেখা পর্দা, কুশন কিংবা চেয়ার এনে দিচ্ছে বেশ ভিন্নমাত্রা।

৪. জেনারেশন জি বা আলফা প্রজন্মের ধারকেরাও বেশ স্টাইলের সঙ্গে বহন করছেন বাংলা লেখা বিভিন্ন জিনিস।

৫. দেশের বাইরে বিদেশিরাও বাংলা লেখা পোশাক পরছেন। আগ্রহ করে কিনছেন বাংলা লেখা নানা পণ্য।

আজ থেকে কয়েক বছর আগেও পোশাক বা অন্দরে ভাষার ব্যবহার ছিল বেশ গুরুগম্ভীর। নতুন প্রজন্মের আগ্রহের কারণেই হয়তো সেই পরিবেশনায় এখন দেখা যাচ্ছে বৈচিত্র্য। অনেক রঙের ভেতর উঁকি দিচ্ছে বাংলা কোনো লেখা। ডায়েরির ওপর লেখা থাকছে ‘বাংলাদেশের নিজস্ব বাগানে উৎপাদিত ইস্ কাহিনি চা’ অথবা ব্যাগের ওপর লেখা হচ্ছে ‘ভালো আছি, ভালো থেকো’। রোদ-বৃষ্টি ঠেকানোর পাশাপাশি চটুল কথা বহন করার কাজও করছে এখন ছাতা।

কলমদানি, বাক্স, টিস্যু বক্সের ওপর মজার মজার ছবির পাশাপাশি নানা ধরনের কথাও লেখা হচ্ছে।
ছবি: কবির হোসেন

কলমদানি, টেবিল ল্যাম্প, টিস্যু বক্সের ওপর মজার মজার ছবির পাশাপাশি নানা ধরনের কথাও লেখা হচ্ছে। ডিজাইনার লিপি খন্দকার বিশেষ এক পরিস্থিতিতে পোশাকের ওপর করেছিলেন বাংলা ভাষার ব্যবহার। সেটা ’৯০ দশকের কোনো একটি সাল হবে, তিনি তখন আড়ংয়ে ডিজাইনার। ’৯৪ বা ’৯৫ সালে একবার ঈদের দিনে পরেছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। সেবার তিনি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি তুলে ধরেছিলেন পোশাকের ওপর। এরপর তাঁর নিজের ফ্যাশন হাউস ‘বিবিয়ানা’ যখন চালু করলেন, সেখানে প্রথম থেকেই পোশাকে স্থান পায় বাংলা ভাষা। বাংলা লেখা পোশাকগুলোয় শ্রদ্ধা ও স্টাইল দুটোই বেশ সুচারুরূপে ফুটে ওঠে।

বাংলা অক্ষর বা বর্ণগুলো নিজেরাই যেন এক একটা নকশা। কোনো কিছুর ওপর বসানো হলে এমনিতেই চলে আসে ভিন্নমাত্রা। অনেক সময় দুই বা তিনটি বর্ণ লেখা হচ্ছে, তো অনেক সময় শব্দ। বাংলা লেখা থাকলেই সেটি পাচ্ছে আলাদা মর্যাদা ও মাত্রা। তরুণ যাঁরা কাজ করছেন, বেশ শৈল্পিকভাবেই তাঁরা বিষয়টি ফুটিয়ে তুলছেন। যাত্রা মেলায় মোট ৪৫টি ব্র্যান্ড আছে। সব কটিই দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছে। বয়স্ক, তরুণ সবাই কিনছেন। যাত্রা বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমতেনান মোহাম্মদ জাকি বলেন, ৪০-এর ওপর যাঁদের বয়স, সাধারণভাবে তাঁরাই বাংলা লেখা পোশাক পরছেন বেশি।

দেশীয় নকশা আর লেখায় সাজানো ফতুয়া
ছবি: কবির হোসেন

আবার জেনারেশন জি বাংলা লেখা পোশাক কিংবা অনুষঙ্গ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পছন্দ করেন। পাশ্চাত্যের দামি কোনো ব্র্যান্ডের জ্যাকেটের ওপর হয়তো বাংলা লেখা কোনো ব্যাজ আটকে দিচ্ছেন। তাঁদের ভাষায়, ‘বাংলাফাই’ করে নেওয়া আরকি। একইভাবে ক্রপ টপের সঙ্গে কানে পরে নিচ্ছেন বাংলা বর্ণের দুল কিংবা কপালে টিপ। ঐতিহ্যকে এভাবে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা। খুব ছোটর মধ্যে বর্ণকে ধারণ করার বড় একটি মাধ্যম টিপ। অনলাইনভিত্তিক দোকান আরটোপলিশের স্বত্বাধিকারী সুমাইয়া সায়েদ জানালেন, ‘কপালে অক্ষর বসানো টিপ পরলে, গয়না কম পরা ভালো। সে ক্ষেত্রে কান দুটো খালি রাখা যেতে পারে। চোখে কাজল আর কপালে টিপই যথেষ্ট।’

আগে সবাই ইংরেজি অক্ষরে নিজের নামের আদ্যক্ষরগুলো পরতেন। এটা দেখেই বাংলাতে সেই অক্ষরগুলো দিয়ে গয়না বানানোর কথা চিন্তা করেন জেরিন তাসনিম খান। অনলাইনভিত্তিক দোকান সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি থেকে বানানো এসব গয়না সব বয়সীরাই কিনছেন এবং পরছেন, জানালেন জেরিন। বাংলা বর্ণ বা অক্ষরগুলো যেন একেকটা অলংকৃত প্যাটার্ন। আশপাশে বাড়তি কারুকাজ না থাকলেও চলে। নিজেরাই নিজেদের তুলে ধরার জন্য যেন যথেষ্ট।

কানের দুলেও বাংলা। দুল: সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি
ছবি: কবির হোসেন

পাশাপাশি বাংলা লেখা আছে, এমন অনেক অনুষঙ্গ অন্দরসাজেও বেশ জনপ্রিয়। তবে সেগুলো সাজানো নিয়ে আছে নানা মত। লিপি খন্দকার মনে করেন, যেখানে ভাষার ব্যবহার থাকবে, সেখানে সেটা প্রাধান্য পেলেই ভালো লাগবে। বিছানার চাদরটি এক রঙের হলে ওপরে কুশন কিংবা বিছানার পাশে রাখা ছবির ফ্রেমে থাকতে পারে ভাষার উপস্থিতি। হতে পারে সেটা নানা দেশের ভাষা। ইমতেনান মোহাম্মদ মনে করেন, লেখায় সাজানো অনুষঙ্গের সঙ্গে মেলানো যাবে অনেক কিছুই। বাড়ির ভেতরের সাজের ছন্দভঙ্গ হবে না।

অনুষঙ্গে ভাষার ব্যবহার থাকলে কী লাভ? শুধুই কি দেশপ্রেম? না। অনলাইনভিত্তিক দোকান অহং-এর স্বত্বাধিকারী নিশাত ফেরদৌস জানালেন, লেখাগুলোর ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায় মনের অনেক কথা। ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’, ‘কেন’, ‘না’—এসব শব্দ রাস্তায় চলাফেরার সময় আশপাশের মানুষকে একধরনের বার্তাও দেয়। আবার ‘ভালো আছি, ভালো থেকো’ অথবা ‘মন বসে না শহরে’—মনে জমে থাকা কথা যেন।

কপালের টিপে বাংলা অক্ষর
ছবি: কবির হোসেন

ফ্যাশন বা সাজের মতো বিষয়গুলোও যে হতে পারে বাংলা ভাষার বাহক, সেটাই যেন দাপটের সঙ্গে প্রমাণ করে চলেছে তরুণ প্রজন্ম। সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিচ্ছেন, আন্তর্জাতিকতার এই যুগেও বাংলাকে অন্তরে ধারণ করে চলেছেন তাঁরা।