লেইস যে কারণে ক্ষমতার প্রতীক হয়ে ওঠে

১৮ শতকের আগপর্যন্ত হাতের বুননে তৈরি হতো লেইস। দিনের পর দিন সময় নিয়ে এক গজ করে লেইস বুনতেন কারিগরেরা। তাই দামও ছিল চড়া, যা সাধারণের নাগালের বাইরে ছিল।

লেইসের ব্যবহার পোশাকে নিয়ে আসে ভিন্নতামডেল হয়েছেন অভিনেত্রী সারিকা সাবাহ, সাজ: অরা বিউটি লাউঞ্জ, পোশাক: আলমিরা, ছবি: সুমন ইউসুফ

১৩ শতকের ইউরোপে পোশাকের মাধুর্য ও দাম—দুটিই বাড়িয়ে দিত সুতার কারুকাজ। যাঁরা কাপড় বুনতেন, তাঁরা কাপড়ের ওপর সুই–সুতা দিয়ে এমব্রয়ডারির নানা নকশা তৈরি করতেন। সেই কাপড় দিয়ে তৈরি হতো রাজকীয় ও উচ্চবংশীয় নারী–পুরুষের পোশাক। হাত পাকাতে বেঁচে যাওয়া কাপড়ের ওপর সুই–সুতা চালাতেন কারিগরেরা। টুকরা কাপড়ে ফুটে উঠত দারুণ সব নকশা। এতই সুন্দর যে ফেলে দিতে মন চাইত না। বুদ্ধি করে সেগুলোকে সেলাইয়ে জুড়ে দিতেন পোশাকের হাতা কিংবা ঝুলে। পোশাকগুলো হয়ে উঠত আরও জমকালো। শুরুতে কাপড়ের সঙ্গে এঁটে দেওয়ায় একে বলা হতো টাইজ বা বন্ধন। পরে লোকমুখে বদলে গিয়ে নাম হলো ‘লেইস’।

১৬ থেকে ১৭ শতকে পোশাকে লেইস হয়ে ওঠে ক্ষমতার প্রতীক। লেইসে ভরপুর থাকত রাজা–রানিদের পোশাকের কলার, কাফ, হাতা আর ঘোমটা। ১৮ শতকের আগপর্যন্ত হাতের বুননে তৈরি হতো লেইস। দিনের পর দিন সময় নিয়ে এক গজ করে লেইস বুনতেন কারিগরেরা। তাই দামও ছিল চড়া, যা সাধারণের নাগালের বাইরে ছিল। ভালো দাম পাওয়া যেত বলে শ্রমসাধ্য হওয়া সত্ত্বেও লেইস তৈরি করত গ্রামাঞ্চলের নারী, এমনকি শিশুরাও। কঠোর নিয়মে লেইসের নকশা ও প্যাটার্ন গোপন রাখতেন তাঁরা। পরের প্রজন্মের হাতে তুলে দিতেন অদ্বিতীয় সব নকশা।

১৯ শতকে শিল্পবিপ্লবের পর মেশিনে লেইস তৈরি করতে শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। সঙ্গে সঙ্গেই আভিজাত্য হারায় এই অনুষঙ্গ। কমে যায় দাম, যুক্ত হয় সর্বসাধারণের পোশাকে। চলুন, এবার লেইসের কিছু ধরনের কথা জানা যাক—

শ্যান্টিলি লেইস

এখন অন্যান্য রঙের সুতা দিয়েও শ্যান্টিলি লেইস বানানো হচ্ছে
ছবি: এআই/প্রথম আলো

কালো সিল্কের সুতা দিয়ে তৈরি নেটের ওপর সূক্ষ্ম ফুলেল নকশার লেইস। ১৮ ও ১৯ শতকে শাল ও সান্ধ্য গাউনের জন্য বেশ জনপ্রিয় ছিল। ফ্রান্সে ১৭ শতকে শ্যান্টিলি লেইসের উৎপত্তি। প্যারিসের অদূরে শ্যান্টিলি শহরের নামে নামকরণ হয়। সম্রাট নেপোলিয়নের স্ত্রী জোসেফিন এই লেইস খুব পছন্দ করতেন, যা এর জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছিল। এখন অন্যান্য রঙের সুতা দিয়েও এ লেইসটি বানানো হচ্ছে।

অ্যালঁসো লেইস

১৬৬৫ সালে রাজা চতুর্দশ লুই অ্যালঁসো লেইসকে রাজকীয় স্বীকৃতি দেন
ছবি: এআই/প্রথম আলো

অন্য নাম ‘লেইসের রানি’। সূক্ষ্ম সুই–সুতা দিয়ে বোনা এই লেইসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো নকশার চারপাশে উঁচু কর্ড দিয়ে ঘেরা অলংকরণ থাকে, যাকে বলা হয় কর্ডনে। ফ্রান্সের অ্যালঁসো শহরে ১৭ শতকে এই লেইসের উৎপত্তি। ১৬৬৫ সালে রাজা চতুর্দশ লুই এটিকে রাজকীয় স্বীকৃতি দেন। ১৭ শতকে ইউরোপজুড়ে এর ব্যাপক চাহিদা ছিল। বিলাসবহুল রপ্তানি সামগ্রীটি অভিজাত সমাজ ও ধর্মীয় নেতারা ব্যবহার করতেন। হাতে তৈরি খাঁটি অ্যালঁসো লেইস তৈরির কৌশলকে ইউনেসকো অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ভেনিশিয়ান লেইস

বিলাসবহুল বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবেও রপ্তানি হতো ভেনিশিয়ান লেইস
ছবি: এআই/প্রথম আলো

ইতালির ভেনিসে ১৬ শতকের শেষ ভাগে এই লেইসের উৎপত্তি। সুতার ঘন কারুকাজের ভারী এই লেইসে থ্রিডি বা ত্রিমাত্রিক ভাব ফুটে ওঠে। ১৭ শতকে ইউরোপজুড়ে অত্যন্ত মূল্যবান ছিল এই লেইস। ব্যবহৃত হতো অভিজাত শ্রেণি ও ধর্মযাজকদের পোশাকে। বিলাসবহুল বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবেও রপ্তানি হতো।

ববিন লেইস

ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের এই লেইস তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো
ছবি: এআই/প্রথম আলো

ছোট কাঠি বা ববিনে সুতা পেঁচিয়ে নরম বালিশের ওপর বিশেষ কায়দায় পাকিয়ে তৈরি হতো হালকা ও সূক্ষ্ম নকশার এই লেইস। উৎপত্তি ১৬ শতকে ফ্ল্যান্ডার্স (বর্তমান বেলজিয়াম) ও ইতালিতে। বেলজিয়ামে ববিন লেইস এত বড় শিল্পে পরিণত হয়েছিল যে নির্মাতাদের ওপর কর বসানো হয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের এই লেইস তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।

আইরিশ ক্রোশে লেইস

সাধারণত গোলাপ, ফুল বা পাতা ইত্যাদির নকশা বানিয়ে জালের মতো জোড়া দেওয়া হতো
ছবি: এআই/প্রথম আলো

সূক্ষ্ম ক্রোশে হুক দিয়ে তৈরি এই লেইস ভেনিশিয়ান লেইসের নকশা অনুকরণ করে। সাধারণত গোলাপ, ফুল বা পাতা ইত্যাদির নকশা বানিয়ে জালের মতো জোড়া দেওয়া হতো। আইরিশ ক্রোশে লেইসের উৎপত্তি ১৯ শতকে আয়ারল্যান্ডে। ১৮৪০–এর দশকের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় এটি আয়ারল্যান্ডে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘরোয়া শিল্পে পরিণত হয়েছিল। নারী ও শিশুরা এটি তৈরি করে জীবিকা অর্জন করত। লেইসের টুকরাগুলো বিদেশে ব্যাপকভাবে রপ্তানি হতো।

গিপিওর লেইস

১৬ শতকে ফ্রান্স ও ইতালিতে উৎপত্তি গিপিওর লেইস
ছবি:এআই/প্রথম আলো

১৬ শতকে ফ্রান্স ও ইতালিতে উৎপত্তি। নকশাগুলো জালের ওপর নয়; বরং দড়ি বা চোঙের মতো বুননে যুক্ত থাকে। এই লেইস আজকাল যন্ত্রে তৈরি হয়; থাকে দৃশ্যমান মোটা কারুকাজ, যা পশ্চিমা বিয়ের পোশাকে বেশ জনপ্রিয়।