রানি যখন ফ্যাশন আইকন
সদ্য প্রয়াত ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের নাম উঠলেই চোখে ভেসে ওঠে মাথায় হ্যাট, বুক পকেটে ব্রোচ, গাঢ় রঙের রাজকীয় পোশাক আর জুতা পায়ে কেতাদুরস্ত এক মানুষের মুখ। বছরের পর বছর নানা ফ্যাশনকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে আছে এলিজাবেথের সুনাম।
এখানে থাকছে তাঁর নানান ফ্যাশন স্টেটমেন্টের ও ফ্যাশন আইকন হয়ে ওঠার গল্প।
রানি হওয়ার আগের গল্প
নভেম্বর ১৯৪৭। ব্রিটেনের রাজকন্যার বিয়ে। বিয়ের আয়োজনে রাজবধূ পরেন নরম্যান হার্টনেলের ডিজাইন করা ১২ ফুট লম্বা গাউন। শিফন আর সিল্ক কাপড়ে তৈরি করা হয় সেই গাউন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে, সবকিছুতেই রেশন চলছে। তাই গাউনটি তৈরি করতে নিজের রেশনের কুপন ব্যবহার করেছিলেন রাজকন্যা এলিজাবেথ।
একরঙা উজ্জ্বল রঙের পোশাক ছিল তাঁর প্রধান পরিধেয়। ১৯৫৩ সালে রাজদায়িত্ব গ্রহণের অনুষ্ঠানেও নরম্যান হার্টনেলের নকশা করা গাউন পরেছিলেন রানি।
ক্ল্যাসিক ফ্যাশনের ভক্ত
ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে সব সময় ক্ল্যাসিক ফ্যাশনের অনুসরণ করতে দেখা গেছে। ট্রেন্ড অনুসরণ না করে বরং নিজেই একটা স্টাইল দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি।
সব সময় তাঁকে ক্ল্যাসিক, এক লাইনের পোশাক হিসেবে স্কার্ট আর কোট পরতে দেখা গেছে। তারুণ্যে নানান রঙের স্কার্ট আর কোট পরার দরুন আলোকচিত্রীরা সব সময় তাঁকে চোখে চোখে রেখেছিল। ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত রানি পরিচয়ের বাইরেও সংবাদপত্রের ক্যামেরা তাঁর ফ্যাশনকেও ধারণের চেষ্টা করে।
কোট আর হ্যাটের বৈচিত্র্য
যেকোনো সরকারি অনুষ্ঠানেই নানা রঙের কোট আর হ্যাটে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে দেখা যেত। বেশির ভাগ সময়ই গাঢ় রঙের কোট পরতেন। ষাট ও সত্তরের দশকে তাঁর পরিধেয় কোটে ফুল বা নানান ছাপচিত্র দেখা যায়। আশির দশকের পরে একরঙা কোটের আধিক্য দেখা যায়। রানির প্রভাবে পরে রাজবধূ কেট মিডলটন বা মেগান মার্কেলদেরও একরঙা পোশাক বেশি পরতে দেখা গেছে।
পঞ্চাশের দশকের আগে থেকেই ব্রিটিশ নারীদের মধ্যে ফ্যাশন হিসেবে হ্যাট পরার চল ছিল। ব্রিটিশ রানির যেকোনো সরকারি আয়োজনে বিশেষ করে দিনের বেলা হ্যাট পরতে দেখা যায়। কখনো পলকা ডটের পিলবক্স হ্যাট আবার কখনো স্কার্ট ও স্যুটের সঙ্গে মিলিয়ে হ্যাট পরতেন তিনি।
রানিকে একটি জ্যাকেট ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে পরতে দেখা গেছে। সত্তরের দশক থেকে বিভিন্ন সামাজিক ও অনানুষ্ঠানিক আয়োজনে ব্রিটিশ রানির গায়ে দেখা যেত জলপাই রঙের বারবোর জ্যাকেট। শিকার বা অবকাশযাপনে এই পোশাকে তাঁকে বেশি দেখা যেত। ২৫ বছর পরে রানিকে বিনা মূল্যে একটি জলপাই রঙের বারবোর জ্যাকেট উপহার দেওয়া হলে সেটা নিতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। ৩০০ পাউন্ডের সেই জ্যাকেট ফেলে তাঁর পুরোনো সংগ্রহেই ফিরে যান রানি। বিভিন্ন খেলাধুলা বা অভিযানের সময় রানিকে এই জ্যাকেট পরতে দেখা যায়। কেট মিডলটন ও মেগান মার্কেলকেও পরে একই ধরনের জ্যাকেট পরতে দেখা গেছে।
রানির আরেকটি আইকনিক ফ্যাশন অনুষঙ্গ ছিল হেডস্কার্ফ। বলা হয়, হেডস্কার্ফ ব্যবহারের কারণে রানিকে আরও কাছের মানুষ মনে করতেন ব্রিটিশরা। হেডস্কার্ফের কারণে রানিকে আরও বেশি সরল মানুষ বলে ভাবতেন ব্রিটিশ মধ্যবিত্তরা। কখনো একরঙা, আবার কখনো ফুলের ছাপচিত্রের হেডস্কার্ফে তাঁকে দেখা গেছে। সাধারণের মনে জায়গা করে নিতে পোশাক যে একটি বিশেষ উপায়, সেটা রানির চেয়ে বেশি আর কে জানত!
বাউ ব্লাউজ
লম্বা হাতার বাউ ব্লাউজ এখন আর দেখা যায় না, তবে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে নিয়মিতই দেখা যেত এই পোশাকে। বিভিন্ন রাজকীয় আয়োজনে বাউ ব্লাউজে নিজেকে সাজাতেন এলিজাবেথ।
লোফার আর ওয়েলিংটন বুট
এখন সারা বিশ্বে গুচি লোফার যে এত জনপ্রিয়, তার কারণ নাকি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
ফ্যাশন গবেষকেরা বলছেন, সত্তরের দশক থেকে গুচি লোফার ব্যবহার করেন রানি। আশির দশক থেকে মূলধারার ফ্যাশন ট্রেন্ড হয়ে ওঠে এই লোফার। যেকোনো রাষ্ট্রীয় বা রাজকীয় আয়োজনে খুব সাধারণ স্টাইলের লোফার পরতেন রানি। এ ছাড়া রানিকে নানা আয়োজনে নিয়মিত ওয়েলিংটন বুট পরতে দেখা যেত। বৃষ্টি কিংবা শিকারের সময় ব্রিটিশ রানি বেছে নিতেন ওয়েলিংটন বুট।
ব্যাগে না বলা কথা
বাইরে নারীর নিত্যসঙ্গী তাঁর ব্যাগ। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের হাতেও বাইরে গেলে দেখা যেত ব্যাগ। প্রায়ই তাঁকে বক্স ব্যাগ ব্যবহার করতে দেখা যেত। ব্রিটিশ ডিজাইনার লুনারের তৈরি বক্স ব্যাগ বহন করতেন রানি। একরঙা ব্যাগেই তাঁকে বেশি দেখা গেছে।
রানির এই ব্যাগ নাকি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর না বলা কথা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে দিত। এই যেমন কোনো জনসমাগমে গেছেন রানি, নির্দিষ্ট সময় পর যখন সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে চাইতেন, তখন তাঁর ব্যাগটি শুধু নিচ থেকে তুলে টেবিলের ওপর রাখতেন। এতেই কর্মকর্তারা বুঝে যেতেন রানি এখন বের হয়ে যেতে চান। এরপর তড়িঘড়ি করে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা রানিকে বের করে নিয়ে আসতেন।
টিয়ারা, স্যাশ ও গ্লাভস
আভিজাত্যকে ধরে রাখতে রাজকীয় পোশাকের সঙ্গে নিয়মিত টিয়ারা, স্যাশ ও গ্লাভস পরতেন রানি। লম্বা হাতার গাউনের সঙ্গে এসব অনুষঙ্গ তাঁর ফ্যাশনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।
সেই শুরুর সময় থেকে রানি যে গ্লাভস পরতেন, তাতে তাঁর ফ্যাশন যেমন ঠিক থাকত, তেমনি এটি তাঁর সুরক্ষাও নিশ্চিত করত। রানির দায়িত্বে থাকার কারণে তাঁকে নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে হাত মেলাতে হতো। আর সম্প্রতি করোনার কল্যাণে তো বিশ্বের আমজনতা জেনে গেছেন, মানুষের হাতে কত জীবাণু থাকে। রানিকে সেই জীবাণু থেকেও সুরক্ষা দিত এই গ্লাভস।
রাজকীয় কিন্তু সাধারণ
অতীতের রাজপরিবার মানেই ছিল বিলাসী জীবন। সেই প্রথাকে ভেঙেছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তাঁকে দেখে রাজপরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যরা সাধারণ স্টাইল গ্রহণ করেছেন। রানির নাতবউ কাউন্টেস অব ওয়েসেক্স সোফি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘রানির ফ্যাশন আসলেই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রাজকীয় স্টাইল আর সাধারণ মানুষের আগ্রহকে স্টাইলের মাধ্যমে দারুণভাবে সমন্বয় করেছেন এলিজাবেথ।
সূত্র: টাইম, দ্য সান ও নিউইয়র্ক টাইমস