পাশ্চাত্য পোশাকের দাপট দেখা গেল ল্যাকমে ফ্যাশন উইক ২০২৫–এ
এ বছর ২৫ বছর উদ্যাপন করল ‘ল্যাকমে ফ্যাশন উইক’। মুম্বাইয়ের জিও কনভেনশন সেন্টারে ‘ল্যাকমে ফ্যাশন উইক ২০২৫’–এর আসর বসেছিল। পাঁচ দিনের এই আয়োজনে প্রতিবারের মতো এবারও ছিল বৈচিত্র্যময় আর ব্যতিক্রমী পোশাকের বাহার। দেশি-বিদেশি ফ্যাশনপ্রেমীদের ভিড়ে জমজমাট ছিল এই উৎসব। কিছু নামী, কিছু নবীন ডিজাইনাররা অংশগ্রহণ করেছিলেন ল্যাকমে ফ্যাশন উইকে। শুধু তা–ই নয়, এবার রাশিয়া, লন্ডনের ডিজাইনাররাও উপস্থিত ছিলেন। ল্যাকমে ফ্যাশন উইক-এর ২৫ বছরে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের পোশাকের বৈচিত্র্যময় সম্ভার ছিল। তবে এবার সাবেকি পোশাকের চেয়ে পাশ্চাত্য পোশাক বেশি দাপট দেখিয়েছে।
সূচনার রাত
ল্যাকমে ফ্যাশন উইক-এর ওপেনিং শো সব সময়ই জমজমাট হয়। তবে এবার ল্যাকমে ফ্যাশন উৎসব ২৫ বছর পার করল। তাই এবারের সূচনার রাত যে আরও উজ্জ্বল হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ল্যাকমের ফ্যাশন উৎসব শুরু হয় খ্যাতনামা ডিজাইনার অনামিকা খান্নার এক অভিনব আয়োজন দিয়ে। তিনি তাঁর এই আয়োজনে নারী শক্তি আর সৌন্দর্যের মধ্যে খুব সুন্দর সমতা বজায় রেখেছিলেন।
অনামিকার ‘সিলভার কলার’ শীর্ষক সংগ্রহের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে নারীর আত্মবিশ্বাসের কথা। আয়োজনে নজর কেড়েছে কাঠামোযুক্ত ব্রালেট, কড়িযুক্ত পোশাকের অলংকার, হাই-ওয়েস্টেড মেটালিক ট্রাউজার। অনামিকা এক মেটালিক আবহে মূলত কর্মরতা নারীদের জন্য নিয়ে এসেছিলেন বাহারি পোশাক।
উদীয়মান তারারা
এনআইএফ গ্লোবাল ‘জেন নেক্সট’ শীর্ষক আয়োজনে নতুন প্রজন্মের তিন ডিজাইনারকে ল্যাকমের আসরে নিয়ে এসেছিল। নবীন মানেই নতুন কথা। ফ্যাশনের নতুন এক দিক। অভিষেক শিন্ধে (Shinde) তাঁর ‘কিও’ কালেকশনের মাধ্যমে নিয়ে এসেছিলেন পুরুষদের জন্য বসন্ত এবং গ্রীষ্মকালীন আরামদায়ক আর রঙিন পোশাকের বাহার। এই প্রদর্শনে নজর কেড়েছে ব্যাগি প্যান্ট-শার্ট, ডোরাকাটা ট্রাউজার্সের সিলুয়েট, বড় আকারের পকেটওয়ালা ক্রপড জ্যাকেট, ছাপা নকশার শার্ট।
১৮৭০ থেকে ১৯৫০-এ নেপালের রাজা রানিদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল যশ পাটিলের কালেকশন। নবাগত ডিজাইনারের এই প্রদর্শনে উঠে এসেছিল ইউরোপীয় স্টাইলের বহুলতা। সোম্য লোচান বেনারসের তাঞ্চৈ সিল্ক ব্রোকেড, ঔরঙ্গাবাদের হাতে বোনা হিমরু ব্রোকেড, পশ্চিম বাংলার ‘ওয়াক্স কাস্টিং’সহ হারিয়ে যাওয়া নানা শিল্পকলাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন।
ধুতি থেকে সুইম স্যুট
ল্যাকমের আসরে এ বছর পুরুষদের ফ্যাশনের বৈচিত্র্য ধরা পড়েছে। ধুতি থেকে সুইম স্যুট সবকিছু নিয়েই হাজির ছিলেন ডিজাইনাররা। ‘দ্য বয়েজ ক্লাব’ শীর্ষক এক আয়োজনে ছিল পুরুষদের সাবেকি থেকে হাল ফ্যাশনের পোশাকের বাহারি আয়োজন। বাঙালি ডিজাইনার অভিষেক রায় তাঁর ‘নবাবস অব বেঙ্গল’ আয়োজনে বাংলার বাবু সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে এনে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। অভিষেকের নান্দনিক পরিবেশনায় ছিল ভেলভেটের পাঞ্জাবির ওপর হাতে করা জারদৌসি কাজ, জামদানি ফুলের কাজ আর নানা ধরনের মোটিফ। ধুতির ডিজাইনেও তিনি অভিনবত্ব এনেছিলেন। ধুতি বা পায়জামার সঙ্গে পাঞ্জাবি, তার সঙ্গে জারদৌসি কাজের মানানসই শাল ছিল এই প্রদর্শনে। ডিজাইনার গৌরব জাগতিয়ানির সম্ভারে ছিল নানা কাটের লম্বা জ্যাকেট, কোটের বৈচিত্র্য।
ডিজাইনার অনুরাগ গুপ্তা তাঁর পরিবেশনায় ঋতু পরিবর্তন আর মানুষের বিবর্তনের মধ্যে সুন্দর সমতা বজায় রেখেছিলেন।
জনপ্রিয় দুই ডিজাইনার শান্তনু-নিখিল ‘ফ্যাশন’ আর ‘কমিউনিটি’-র মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়ে ফিউশন উপহার দিয়েছেন। তাঁরা এই মঞ্চে উন্মুক্ত করেছিলেন ‘পিয়াজা নোভা’ কালেকশন। এই কালেকশনে ছিল এমব্রয়ডারি করা কোট আর স্টাইলিশ জ্যাকেট।
শিবান-নরেশ এক রঙিন আয়োজনে উন্মুক্ত করেছিলেন ‘আর্টিস্টিক রিসোর্ট কালেকশন’। তাঁদের ক্যানভাস ছিল নানা রঙের আঁচড়ে উজ্জ্বল। শিবান-নরেশ তুলে ধরেছিলেন পুরুষদের জন্য রঙিন কোর্ডিনেটেড সেট, জাম্প স্যুট, পঞ্চ, রোব, স্যুইম ট্রাঙ্ক। রিসোর্টের জন্য ছিল ভেস্ট, শ্যাকেট, শার্ট, পোলো। তাঁদের রিসোর্ট সম্ভার অনুপ্রাণিত ছিল বিখ্যাত ফরাসি শিল্পী ফার্নান্দ লেগর দ্বারা।
বিকিনি থেকে ট্রেন্ডি শাড়ি
গ্রীষ্মের ট্রেন্ডি পোশাকের অভিনব আয়োজন ছিল সত্য পলের সংগ্রহে। রং, ডিজাইন, ছাপা নকশা সবকিছুতেই ছিল ‘রোমান হলিডে’-র মেজাজ। টিউনিক, কাফতান, ড্রেস, ফুল হাতা ব্লাউজের সঙ্গে রঙিন বা সাদা-কালো শিফনের শাড়ি নজর কেড়েছিল। ডিজাইনার রীনা সিংয়ের ব্র্যান্ড ‘একা’ ল্যাকমের মঞ্চে নিয়ে এসেছিল ‘দ্য রাইট অব স্প্রিং’ শীর্ষক এক চোখজুড়ানো আয়োজন। তাঁর এই আয়োজন রাজস্থানের জয়পুরের রাজকীয় আমের ফোর্ট দ্বারা অনুপ্রাণিত। রীনার পরিবেশনায় সিল্ক, সুতি, অরগেঞ্জা, শীর সুতির হাল ফ্যাশনের পোশাকের ওপর রাজ ঘরানার নানা মোটিফ ধরা পড়েছিল।
ডিজাইনার মহম্মদ মজহার নিজের শহর শাহরানপুরের কাহিনি তুলে ধরেছিলেন। শাহরানপুর ‘উডেন সিটি’ নামে খ্যাত। কাপড় আর কাঠ দিয়ে কীভাবে পোশাক তৈরি করা যায়, তা মহম্মদ মজহার এই আয়োজনে প্রদর্শন করেছিলেন। মজহারের এই কালেকশন ফ্যাশন দুনিয়ার সামনে নতুন এক দরজা খুলে দিয়েছে।
খ্যাতনামা দুই ডিজাইনার ফাল্গুনী শেন পিকক এবং লুফথানসা ল্যাকমের আসরে উন্মোচন করেন সাহসী এবং উজ্জ্বল সংগ্রহ। ‘অল ইট টেকস ইজ আ ইয়েস’ শীর্ষক এই আয়োজনে ‘ফ্যাশন’ আর ‘ট্রাভেলের’ (ভ্রমণ) এক অভিনব ফিউশন ছিল। এই দুই ডিজাইনার তাঁদের প্রদর্শনের মাধ্যমে ‘হ্যাঁ’ বলার ইতিবাচক শক্তিকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। আয়োজনে সাদা-কালো রঙের ব্যবহার ছিল বেশি।
ডিজাইনার রাহুল মিশ্রা ল্যাকমের আসরে শীতের রকমারি পোশাক নিয়ে হাজির ছিলেন। ‘সিল্ক রুট’ শীর্ষক আয়োজনে তিনি নানা সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছিলেন। তাই এক দিকে ছিল ভারতের বাঁধনি, আবার অন্য দিকে ছিল জাপানের শিবরি। গ্রীষ্মের ছুটিতে মন চায় হারিয়ে যেতে। সাক্ষা-কিন্নি তাই এই উৎসবে নিয়ে এসেছিলেন ছুটির মেজাজ। তাঁদের ‘দ্য সানস্টপার পার্টি’ কালেকশন গুজরাটের ঐতিহ্যবাহী আদালাজ স্টেপ ওয়েল দ্বারা অনুপ্রাণিত। ফুলের নানা মোটিফ, জ্যামিতিক প্যাটার্ন ধরা পড়েছিল হালকা শিফন, সুতি, সাটিনের কাফতান, ব্রিজি জ্যাকেট, ড্রেস, সুইম ওয়ার-এর ওপর। ডিজাইনার তরুণ তাহিলিয়ানির প্রদর্শনে নজর কেড়েছিল লিনেনের ওপর হাতে করা চিকন কারির কাজ আর রাবারি ক্র্যাফট।
ডিজাইনার নম্রতা যোশিপুরা এবং আরএলান যৌথভাবে নিয়ে এসেছিলেন টেকসই পোশাকের এক ব্যতিক্রমী আয়োজন। বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ দিয়ে বানানো স্পোর্টস, জিম, হোটেল লাউঞ্জ, এয়ারপোর্ট পোশাকের বৈচিত্র্য ছিল তাঁদের এই মনোগ্রাহী পরিবেশনায়।