উৎসবের পণ্যে হাতে আঁকা নকশার জয় 

শাড়িতেই হাতের কাজের সৌন্দর্য সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটে ওঠে। দেশীয় ব্র্যান্ড বনানীর গো দেশী থেকেছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

তরুণ ফ্যাশন উদ্যোক্তা ফাইজা ইসলাম এক দশক ধরে কাজ করছেন হাতে আঁকা পোশাক নিয়ে। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন তাঁর ব্যস্ততা বেশি। ফাইজা ইসলামের এক নারী ক্রেতার নানিবাড়িতে ছিল বিশাল পুকুর। চারপাশজুড়ে সোনালুগাছ। যখন সেই গাছ ভরে ফুল ফুটত, পুকুরে সেই ফুল ভেসে বেড়াত, মনে হতো যেন সোনার পুকুর! নানি পালতেন রাজহাঁস। সেই হাঁসগুলো আবার দল বেঁধে ঘুরে বেড়াত পুকুরে। এখন নানি নেই, নানিবাড়িও নেই, নেই সেই পুকুরও! কিন্তু স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে ‘সোনার পুকুর’।

ফাইজা সেভাবেই আঁকলেন শাড়ি। সেই শাড়ি দেখে ওই নারী আর কান্না আটকাতে পারলেন না। ফাইজাকে বললেন, ‘মনে হচ্ছে আপনি আমার স্মৃতির ভেতরে গিয়ে ছবিটাকে জীবন্ত করে দিলেন।’ সেই শাড়ি গায়ে জড়িয়েই বিয়ের আসরে বসেছিলেন তিনি।

এই সেই ‘সোনার পুকুর’ শাড়ি
ছবি: ফাইজা ইসলামের সৌজন্যে

বেড়াতে যাওয়া, গায়েহলুদ বা বিয়ের মতো বিশেষ উপলক্ষে অনেকেই ফাইজার কাছ থেকে মনের মতো করে পোশাকে নকশা করে নেন। সেগুলোর দাম ৫ হাজার থেকে শুরু। সিল্ক আর মসলিনের শাড়িগুলো বিক্রি হয় ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকায়। ফাইজা বললেন, ‘কাস্টমাইজড পোশাক করতে ভালো লাগে, কেননা, সেখানে একটা গল্প থাকে। মানুষের ব্যক্তিগত গল্প। সেই গল্পটা পোশাকে ফুটিয়ে তোলাটাই আমার চ্যালেঞ্জ।’

এবার ঈদের কেনাকাটায় হাতে আঁকা পোশাকের চাহিদা বেশ নজর কেড়েছে। শাড়িতে তো বটেই, পাঞ্জাবি আর কামিজেও হাতে আঁকা নকশা ঠাঁই পেয়েছে দোকানে দোকানে। 

রাজধানীর তেজগাঁও-লিংক রোডে আলোকির ঈদের মেলায় গিয়ে দেখা গেল, পোশাকে, বিশেষ করে শাড়িতে আলাদা করে গুরুত্ব পাচ্ছে হাতে আঁকা নকশা। কখনো হাতে আঁকা নকশার ওপরেই করা হচ্ছে এমব্রয়ডারি আর হাতের কাজ। সম্প্রতি শেষ হয়ে যাওয়া মাইডাসের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মেলায় গিয়েও মিলল একই চিত্র। টাই-ডাই, নকশি, ডিজিটাল প্রিন্ট, কলমকারি আর হাতের কাজের পাশে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছে এই হাতে আঁকা নকশা।

হাল ফ্যাশনে চলছে রিক্সা পেইন্টের ধারা
ছবি: প্রথম আলো

একাধিক ফ্যাশন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শাড়িতেই হাতের কাজের সৌন্দর্য সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটে ওঠে। কেননা, ক্যানভাস হিসেবে আর সব পোশাকের চেয়ে শাড়িই থাকবে এগিয়ে। হাতে নকশা করা এসব শাড়ি বিক্রি হচ্ছে আড়াই হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায়। এর চেয়ে বেশি দামের শাড়িও আছে।

অনলাইন আর অফলাইনের ফ্যাশন পণ্যের বাজারে, মেলায় শাড়ির পাশাপাশি হাতে আঁকা ব্লাউজ, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট, থ্রি–পিস, ওড়না, স্কার্ট, টপ, বাচ্চাদের পোশাক, বিছানার চাদর, পর্দা, কুশন কভার, ব্যাগ, জুতা, চশমা, গয়না, টিপ আর ঘরের ব্যবহার্য জিনিসপত্রও বিক্রি হচ্ছে দেদার। কদর আছে হাতে আঁকা নকশার প্রিন্টের পোশাকেরও। 

শিল্পীদের হাত ধরে

একটু পেছনে ফেরা যাক। ১৯৭৯ সালে রাজশাহী আর্ট কলেজের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন মাসুদা কাজী। ১৯৮২ সাল থেকেই সেখানকার বিভিন্ন শাড়ির দোকানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শাড়ি, পাঞ্জাবি আর থান কাপড়ে আঁকতে লাগলেন ছবি। বিয়ের পর ১৯৮৪ সালে ঢাকায় এলেন। যুক্ত হলেন আড়ং, নিপুণ, বিচিত্রা, ভূষণ আর সিল্ক ডাইনেস্টির সঙ্গে। তখন এসব ফ্যাশন ব্র্যান্ডের হয়ে আঁকতেন মাসুদা কাজী ও তাঁর জীবনসঙ্গী শিল্পী কাজী রকিব।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মাসুদা বলেন, একদিন তাঁদের বাড়িতে আফসানা মিমি (অভিনেত্রী) এলেন। তখন তিনি ঢাকায় ‘রঙ’ নামের একটা বুটিকের উদ্যোক্তা। সেখানে হাতে আঁকা নকশার পোশাক পাওয়া যেত। মিমি বললেন, ‘৬০ পিস শাড়ি করে দিতে হবে। শুনে আমি ফিসফিস করে ওকে (কাজী রকিবকে) বললাম, “এ আর এমন কী! এ তো আমাদের চার দিনের কাজ।”’ এ কথা শুনেই মিমি বললেন, ‘আপনারা যত পারেন, করতে থাকেন। আমি সবই নেব।’

হাতে আঁকা নকশার ল্যাম্পশেড
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

মাসুদা ২০১৫ সালে উড়াল দেন যুক্তরাষ্ট্রে। আগামী বছর দেশে ফিরবেন। শরীয়তপুরে শ্বশুরবাড়িতে বসেই হাতে আঁকা নকশার কাজ পুরোদমে শুরু করবেন বলে জানালেন। 

বাংলাদেশে হাতে আঁকা নকশার পোশাকের ইতিহাসে আলাদা করে প্রয়াত শিল্পী ও ফ্যাশন ডিজাইনার শাহরুখ শহীদের নাম উল্লেখ করতেই হয়। তাঁর ঋতুভিত্তিক হাতে আঁকা নকশার শাড়ি নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই সমাদৃত হয়। তিনি হাতে আঁকা নকশার মাধ্যমে তুলে ধরতেন বাংলাদেশের ঐতিহ্য।

বিভিন্ন লেখাপত্র থেকে জানা যায়, হাতে আঁকা নকশার চল শুরু করে চীনারা, রেশমবস্ত্রে। চীনের রাজদরবারে ব্যাপক সমাদর পায় এই শিল্প। জাপানিরাও তা নিজেদের ফ্যাশন-সংস্কৃতিতে জুড়ে নেয়। বলিউডের বিভিন্ন সিনেমায়ও হাতে আঁকা নকশার পোশাকের বহুল ব্যবহার দেখা যায়।

বাংলাদেশেও এই শিল্পের ব্যবহার নতুন নয়। ২০১০ সালের পর থেকে দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোতে আলাদা গুরুত্ব পায় হাতে আঁকা নকশা। এখন প্রায় সব দেশি পোশাকের নামকরা প্রতিষ্ঠানেই এ রকম নকশার শাড়ি-পাঞ্জাবি-শিশুদের পোশাক তৈরি হয়।

থিমভিত্তিক নকশারও আছে চল
ছবি: ফাইজা ইসলামের সৌজন্যে

হাতে আঁকা নকশায় রঙিন ফ্যাশন পণ্য

‘মেহের’-এর জামদানি-মসলিন গাউনে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের মঞ্চে ‘ট্র্যাডিশনাল ড্রেস’-এর আসরে বাংলাদেশকে তুলে ধরেন শাম্মি ইসলাম নীলা। মসলিনের গাউনের নিচের অংশে হাতে আঁকা নকশায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। মেহের-এর স্বত্বাধিকারী সামিনা সারা জানান, একটা নকশা ফুটিয়ে তুলতে কত সময় লাগে, এর ওপর নির্ভর করে পোশাকটির দাম। কেননা, নকশার কারিগরকে ঘণ্টা হিসাবে মজুরি দেওয়া হয়। আর সেটা যোগ হয় পোশাকের দামের সঙ্গে। সামিনা লাখ টাকাতেও বিক্রি করেছেন হাতে আঁকা নকশার পোশাক। 

এবারের ঈদের বাজারে একটা বিষয় নজরে এসেছে, তা হলো হাতে আঁকার আদলে প্রিন্ট নকশার পোশাক এসেছে অনেক। একটা সময় নিত্য উপহারে যেমন প্রখ্যাত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বা হাশেম খানের নকশার প্রিন্ট শাড়ি সমাদৃত হয়েছিল। 

হাতে নকশা করা এসব শাড়ি বিক্রি হচ্ছে আড়াই হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায়। এর চেয়ে বেশি দামের শাড়িও আছে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

২০২০ সালে বাংলাদেশি ফ্যাশন ডিজাইনার সাদিয়া রূপার রিকশা পেইন্টের সংগ্রহ নজর কাড়ে ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের মঞ্চে। গত বছরের ডিসেম্বরে ইউনেসকোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় ‘রিকশা ও রিকশাচিত্র’। অবশ্য এর আগে থেকেই যাত্রা, আড়ং, বিবিয়ানা, বিবি প্রোডাকশন, রঙ, কে ক্র্যাফট, বিস্কুট ফ্যাক্টরি, ওয়ান কালচারসহ দেশীয় ব্র্যান্ড আর প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে পোশাক থেকে ঘরের অন্দরে ঢুকে পড়ে রিকশাচিত্র।

সব মিলিয়ে ঈদুল ফিতরের আগে দেশের ফ্যাশন পণ্যগুলো হাতে আঁকা নকশার উপস্থিতিতে এবার যেন আরও রঙিন।