জয়িতা ফিরলেন, লড়লেন, জয়ী হলেন

জয়িতা আফরিন
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

বাড়ির নাম পারিজাত বনলতা। এই বাড়িরই চারতলায় থাকেন আলোকচিত্রী জয়িতা আফরিন। লিফটের দরজায় একই নোটিশ কয়েকটা সাঁটানো। নোটিশের মূলকথা, এই বিল্ডিংয়ে পশুপাখি পালন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দরজা ঠেলে জয়িতার ঘরে প্রবেশ করতেই দৌড়ে এসে শুভেচ্ছা জানালেন জয়িতা ও তাঁর পুত্রের পোষা কুকুর কেট। ঘরে ঢুকতেই দেখি, আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দুটি বিড়াল মুকু আর মোমো। অন্য দুই বিড়াল পিকু আর সুশি তখন কেটের সঙ্গে খেলায় মেতেছে।

জয়িতার কাছে জানতে চাইলাম, নোটিশের কী মানে? বললেন, ‘আমার জন্যই টানিয়েছে। আমি যাতে না পালি। আমার ফ্ল্যাট। আমি ঘরে ওদের পালি। অন্যদের তাতে কী সমস্যা বুঝি না। ওরা কারও কোনো অসুবিধা করে না।’ জানা গেল, ওদের তিনি উদ্ধার করে পালা শুরু করেছেন। মুকুর তো দুই দফায় টিউমার আর হার্নিয়া অপারেশনও হয়েছে। জয়িতা বললেন, ‘ওদের কারণে অনেক কাজ নিতে পারি না। ঢাকার বাইরে গেলে কেট দরজার সামনে বসে থাকে। কিছু খায় না। অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমার খুবই খারাপ লাগে। মনে হয়, ওদের বঞ্চিত করছি। তাই এখন ঢাকার বাইরে এক বা দুই দিনের বেশি বড় বাজেটের কাজও নিতে পারি না।’

একমাত্র ছেলে আদিত্য আর পোষ্য কেটের সঙ্গে জয়িতা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

জয়িতার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। পাঁচ ভাই-বোনের ভেতর জয়িতা সবার ছোট। মা–বাবা দুজনই সরকারি চাকরি করতেন। স্কুলে গায়ের রং, অন্তর্মুখী স্বভাব ও চুপচাপ থাকা নিয়ে বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন। জয়িতা যখন নবম শ্রেণির ছাত্রী, তখন ঢাকায় চলে আসে তাঁর পরিবার। ঢাকা থেকেই এসএসসি ও এইচএসসি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর তাঁর বড় ভাই অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়ার সময় জয়িতাকে তাঁর ক্যামেরাটা দিয়ে যান। তখন থেকে ছবি তোলা শুরু। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিষয়ে ভর্তি হন। এর কিছুদিন পর ভর্তি হন পাঠশালায়। দুই জায়গাতেই পড়াশোনার ভীষণ চাপ। একসময় নিজের সিদ্ধান্তে ষষ্ঠ সেমিস্টার শেষে মা–বাবার বেশ কয়েক লাখ টাকা জলে ফেলে নাম তোলেন ড্রপ আউটদের খাতায়।

বাসার ছাদে জয়িতা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ছবি তোলা শিখতে শিখতেই আরেক আলোকচিত্রীর সঙ্গে প্রেম। তারপর মাত্র ২০ বছর বয়সে ঝোঁকের বশে পালিয়ে বিয়ে। বিয়ের এক সপ্তাহের ভেতরই বুঝলেন, ভুল হয়ে গেছে। তারপরও চেষ্টা করলেন এক যুগ। লাভ হলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ হলো না, ফটোগ্রাফির ডিপ্লোমা কোর্সটাও শেষ করা হলো না। ২০০৭ সালে বিয়ে, পরের বছরের মার্চেই মা হলেন। জয়িতা বলেন, ‘২০ থেকে ৩০ বছর—একটা মেয়ের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। আর আমার জন্য সেটাই ছিল ভয়ংকর, দুর্বিষহ ও সংসার নামের জেলখানায় বন্দী জীবন।’

২০১৭ সালে এসে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন জয়িতা। তারপর শারীরিক ও মানসিক জটিলতা কাটিয়ে ঠিক করলেন, ছবি তোলাকেই পেশা করবেন। আলোকিচত্রশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘পাঠশালা’য় পড়ার সময় যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল, প্রায় এক যুগ পর তাঁদের খুঁজে বের করলেন। অনেকেই বলেছিলেন, যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরাই ভাত পাচ্ছেন না। ছবি তোলার প্রযুক্তিতেও এর মধ্যে বিপ্লব ঘটে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে জয়িতা ঠিক করলেন, হাল ছাড়বেন না। সেই সময় ছবি তোলার কারিগরি দিকগুলো শেখার ওপর জোর দেন। এ এস এন আরিফের কাছ থেকে ছবি সম্পাদনা শেখেন। কনসেপ্টের পাশাপাশি তাঁর সম্পাদনা ছবিগুলোকে আর সব ছবি থেকে আলাদা করে তোলে। একের পর এক ছবি ভাইরাল হতে থাকে। কেননা, বাংলাদেশে এর আগে কেউ ফিচারাইজডভাবে ছবিতে নারীবাদ নিয়ে তেমন একটা কাজ করেননি।

কুকুরটার মালিক বিদেশে চলে যাওয়ার পর জয়িতা সেটাকে দত্তক নেন
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

সব গুছিয়ে যখন একটু থিতু হয়েছেন, এমন সময় হাতে এল সেই রিপোর্ট। ব্রেস্ট ক্যান্সার। স্টেজ টু। জয়িতার ভাষায়, ‘২০২২ সালের মার্চে হঠাৎ শরীরটা খারাপ লাগছিল। তাই কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দিয়েছিলাম। ২৩ তারিখে ছিল আমার ছেলের জন্মদিন। সেই আয়োজনের প্রস্তুতি চলছিল। এর ভেতর রিপোর্ট এল। ব্রেস্ট ক্যানসার, দ্বিতীয় স্টেজ। বেশির ভাগ ব্রেস্ট ক্যানসারই সেরে যায়। কিন্তু আমারটা বিরল একধরনের ক্যানসার। কখনোই পুরোপুরি সেরে যায় না। ফিরে ফিরে আসে। শুরু হলো নতুন যুদ্ধ।’

আরও পড়ুন

ছয় মাস কেমোথেরাপি আর অস্ত্রোপচারের পর মনে হলো, আর পারবেন না। তবু জয়ী হয়ে ফিরলেন জয়িতা। আবার হাতে তুলে নিলেন ক্যামেরা। শরীর তত দিনে ভেঙে পড়েছে। এই আলোকচিত্রী বলেন, ‘ক্যানসার থেকে আপনি যতই ফিরে আসেন না কেন, আগের জীবন আর পরের জীবন এক নয়। কেমোথেরাপিতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় শরীর। সেটা কখনোই আর পুরোপুরি পূরণ হয় না।’

এখন কেমন আছেন জানতে চাইলে উত্তর এল, ‘জীবনের এই সব ব্যক্তিগত, শারীরিক ও অর্থনৈতিক ধকল সামলে চল্লিশেই বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছি। শরীরের মেটাবলিজম ধীর হয়ে গেছে। লিভার খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত। তবে এই সবকিছু নিয়েই আমি খুবই ভালো আছি।’ ক্যামেরা হাতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। সন্তান আর পোষ্যদের নিয়ে এই মুহূর্তে ব্যক্তিগত জীবনটাও কাটছে বেশ। সব মিলিয়ে এটাই তাঁর জীবনের সুস্থির, সেরা সময়।

ছেলের জন্য ডিম ভাজছেন জয়িতা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন