যে কাপড়ের আভিজাত্য দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে

কথায় বলে, খাঁটি সিল্ক আর খাঁটি সোনায় কোনো পার্থক্য নেই। ফ্যাশনিস্তাদের ভেতর যাঁরা কাপড় বোঝেন, কদর করতে জানেন, তাঁরা এ কথার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হবেন।

জমকালো যেকোনো আয়োজনে নিজেকে অভিজাত লুকে উপস্থাপন করতে সিল্ক শাড়ির তুলনা হয় নাপোশাক: অরণ্য, সাজ: বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ, ছবি: সুমন ইউসুফ

সিল্কের উৎপত্তি হয়েছিল সুদূর চীনে। প্রায় দুই হাজার বছর পর্যন্ত তারা সিল্ক উৎপাদনের পদ্ধতি গোপন রাখতে পেরেছিল। এরপর পদ্ধতিটা ফাঁস হয়ে যায়। সারা দুনিয়াতেই ধীরে ধীরে সিল্কের বিস্তার ঘটতে থাকে।

সিল্কের জনপ্রিয়তা এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি
মডেল: নেহা ও জেরিন

সিল্ক নিয়ে আমাদের ইতিহাসটাও কম গর্বের নয়। টাঙ্গাইলে হ্যান্ডলুমে আর রাজশাহীতে যন্ত্রের বুননে তৈরি হচ্ছে রেশমের কাপড়। গুণগত মানের দিক থেকে এগিয়ে রাজশাহীর সিল্ক। রাজশাহীর কাপড় খুব পাতলা হয়, পরতেও বেশ আরাম।

পিওর সিল্ক, বলাকা সিল্ক, অ্যান্ডি সিল্ক, ক্রেপ সিল্ক, সাটিন সিল্ক, সিফন সিল্ক, তসর সিল্ক, সফট সিল্ক, ধুপিয়ান সিল্ক—একই কাপড়ের নানা নাম, নানা ভেলকি। সিল্কের যত ধরনই থাক, প্রকাশ একটাই—আভিজাত্য। আর শাড়িতে যেন তা পুরোপুরি ফুটে ওঠে!

রাজশাহীতে সপুরা সিল্ক মিলস শাড়ি উৎপাদনের জন্য সারা দেশেই জনপ্রিয়। নগরের বিসিক এলাকায় তাদের কারখানার সঙ্গেই রয়েছে বিশাল বিক্রয়কেন্দ্র। সেটির ব্যবস্থাপক আমিনুল হক জানান, তাঁদের ৩০ থেকে ৩৫ রকমের মসলিন সিল্ক শাড়ি রয়েছে। প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সংগ্রহ। পিওর টাঙ্গাইল সিল্ক শাড়ির দাম ৭ হাজার থেকে ২০ হাজার। এসব শাড়িতে আছে এমব্রয়ডারি, অ্যাপ্লিক, ডিজিটাল প্রিন্ট, স্ক্রিন প্রিন্ট, ভেজিটেবল ডাই, বাটিকের ছোঁয়া।

সিল্কের ওপর ছাপা নকশার কাজ
মডেল: সৌরভ অভি

শাড়ির পাশাপাশি সিল্কের থান কাপড়ের জন্যও সপুরার পরিচিতি আছে। সিল্কের ওপরে ভেজিটেবল ডাইয়ের কাপড় কিনতে খরচ পড়বে গজপ্রতি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। মসলিনের ওপর জামদানি নকশার কাপড় বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১৫০ টাকা গজ। অ্যান্ডি সিল্কের ওপর জামদানি কাজের কাপড় কিনতে গজপ্রতি গুনতে হবে ১ হাজার ৪৫০ টাকা। এদিকে মসলিনের ওপর ডিজিটাল প্রিন্টের কাপড়ের দাম ৯৫০ টাকা। স্ক্রিন প্রিন্ট হলে দাম খানিকটা কম, গজপ্রতি ৫৫০ টাকা। সব মিলিয়ে সিল্কভেদে প্রতি গজ ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। তাই আপনার যদি নির্ভরযোগ্য দরজি থাকে, তাহলে ‘দামে কম মানে ভালো’ সিল্ক সংগ্রহ করে পছন্দমতো নকশায় বানিয়ে নিতে পারেন ঈদের পোশাক। তাতে দাম কম পড়ার পাশাপাশি আরেকটা যে সুবিধা পাবেন, সেটা হলো আপনার পোশাকটি হবে এক পিস!

টাই–ডাইয়ের শার্টে স্টাইলিশ লুক
পোশাক: অরণ্য

সপুরা সিল্ক মূলত সিল্ক কাপড়ের উৎপাদক। এখান থেকে সিল্ক নিয়ে অনেক ফ্যাশন ডিজাইনার অনলাইন আর অফলাইনে কাজ করছেন। একরঙা কাপড় নিয়ে বৈচিত্র্যময় নকশা করছেন। ফলে সিল্কের জনপ্রিয়তা এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে তুঙ্গে। শাড়ির পাশাপাশি পাঞ্জাবি, শার্ট, ওড়না, স্কার্ফ, শ্রাগ, কেপ, কোটি, জ্যাকেটও তৈরি হচ্ছে সিল্কে।

সুতা থেকে সিল্ক তৈরির প্রথম যে ধাপ, মানের সিল্ক, সেটা দিয়েও আজকাল তৈরি হচ্ছে চমৎকার নকশার শাড়ি। অনেক প্রতিষ্ঠান এটাকে মসলিন বলে বিক্রি করে, তবে এটা সিল্কের একটা পর্যায়। এ ছাড়া বেনারসি ও জামদানির সঙ্গে অনেকে টুকরা সিল্কের নকশায় ফিউশন ঘটাচ্ছেন। তাতে শাড়ির জমকালো ভাবটা হচ্ছে অন্য রকম। মসলিন শাড়ি পরলে ফুলে থাকে, এমন অভিযোগ অনেকের। এ সমস্যার সমাধানে সিল্ক ও মসলিন সুতার মিশ্রণে একটু নরম কাপড় তৈরি করছে আড়ং। সিল্ক আর সুতিরও মিশ্রণ হচ্ছে। মাঝেমধ্যেই একরঙা একটি শাড়ির পাড়ে চিকন লেস লাগিয়েই খেল খতম। আবার আঁচল, পাড়ে থাকে এমব্রয়ডারি আর চুমকির কাজ। টাঙ্গাইল শাড়ী কুটিরের স্বত্বাধিকারী মুনিরা এমদাদও ঈদ উপলক্ষে এনেছেন সিল্ক শাড়ির নতুন সংগ্রহ। এই ফ্যাশন উদ্যোক্তা জানান, সিল্কের ওপর এখন নানা ধরনের প্রিন্ট-শিবরি, টাই-ডাই, ব্লক প্রিন্টের কাজ হলেও একরঙা সিল্কের আবেদন ও জৌলুশ কমেনি। মুনিরা এমদাদ বলেন, সিল্কের শাড়ি ফেলে রাখলে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, তাই মাঝেমধ্যে ভাঁজ ভেঙে পরতে হয়।

সিল্কের ওপর এখন নানা ধরনের প্রিন্ট-শিবরি, টাই-ডাই, ব্লক প্রিন্টের কাজ করা হচ্ছে
শাড়ি: সপুরা সিল্ক

দেশের জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড আড়ংয়ে মেলে বিভিন্ন দামের পোশাক। আড়ংয়ের সাবব্র্যান্ড ‘হার স্টোরি’ লাক্সারি আর এক্সক্লুসিভ সংগ্রহ তৈরি করে। কেবল ঢাকার গুলশান, বনানী আর উত্তরা (সম্প্রতি খোলা হয়েছে) আউটলেটে মিলবে ‘হার স্টোরি’র কর্নার। আর আছে চট্টগ্রামের ষোলশহরে। হার স্টোরির সব সংগ্রহই তৈরি হয় সিল্ক কাপড়ে। এখানে আছে শাড়ি, টপ, কেপ, শ্রাগ, জ্যাকেট, স্কার্ফ ইত্যাদি। একেকটি নকশার মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি সংগ্রহ থাকে। যেখানে একটি স্কার্ফের দাম পাঁচ হাজার থেকে শুরু। সব মিলিয়ে এই সংগ্রহগুলোর দাম একটু বেশি, তবে আভিজাত্য আছে ষোলো আনা। সিল্কে তৈরি টপ, কোটি, ওয়ান পিসগুলোর দাম ১০ হাজারের মতো। কিছু জ্যাকেট আছে দাম ৩০ হাজার টাকা।

সিল্কের কামিজ, শার্ট, পাঞ্জাবির সংগ্রহেও ভেজিটেবল ডাইয়ের নকশা করে ফ্যাশন হাউস অরণ্য। সেখানে শাড়ির বাইরে আরও মিলবে নানা রকম সিল্কের স্কার্ফ।

ফ্রেন্ডশিপ কালারস অব চরসের প্রধান ডিজাইনার হাসান ইমাম ঈদ উপলক্ষে বাজারে এনেছেন সিল্কের বেনারসি। সঙ্গে রয়েছে বেশ কিছু টপ আর ওয়ান পিস। সিল্কের বেনারসি শাড়িগুলোর দাম ৩৬ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা। অ্যান্ডি সিল্কের পাঞ্জাবি আর কুর্তির দাম ৪ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে।

সিল্কের পাঞ্জাবি
পোশাক: অরণ্য

সিল্কের এত এত ভোলবদলের ভেতর ভালো সিল্ক চেনার উপায় কী? ২৭ বছর ধরে রেশম উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত আছেন দোয়েল সিল্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জি এম আলমগীর। এই অভিজ্ঞ সিল্ক ব্যবসায়ী জানালেন, সিল্কের ওজন যত বেশি, মানে তত ভালো। তবে আজকাল পলিয়েস্টার মিশিয়ে ওজন বাড়ানো হচ্ছে। তাই সিল্ক কেনার আগে যাচাই করে নেওয়া উচিত, এটা আসল কি না। যাঁরা গজ কাপড় কিনবেন, তাঁরা কাপড়ের কোনার একটু অংশ আগুনে পুড়িয়ে দেখুন। ছাই হয়ে গেলে বুঝবেন, রেশমের সুতায় তৈরি সিল্ক। পৃথিবীর ৩৬টি দেশে একই পদ্ধতিতে রেশম উৎপাদন করা হয়। সব জায়গায় এই পদ্ধতিতেই সিল্ক চেনা হয়। পোড়ানোর পর গন্ধ বের হবে এবং পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।

সিল্কের যত ধরনই থাক, প্রকাশ একটাই—আভিজাত্য
পোশাক: অরণ্য

জমকালো যেকোনো আয়োজনে নিজেকে মিনিমালিস্টিক ও অভিজাত লুকে উপস্থাপন করতে সিল্ক শাড়ির তুলনা হয় না। সিল্কের শাড়ির সঙ্গে মুক্তার গয়নার জুটি রীতিমতো ক্ল্যাসিক। অ্যান্টিক ধাঁচের বা রুপার গয়নাও ভালো মানাবে। তবে সিল্ক কাপড়ের আবেদনই যেহেতু জৌলুশময়, তাই গয়নায় বাড়াবাড়ি না থাকাই সমীচীন। আর মেকআপও যেটুকু না করলেই নয়, ততটুকু। এককথায়, সিল্কের পোশাকের সঙ্গে আর সবকিছুই সাদামাটা রাখা ভালো। তাতে আপনার ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠবে আর সিল্কের জৌলুশও হারাবে না।

দেশি ডিজাইনাররা এখন নিয়মিত বিয়ের সংগ্রহ আনছেন। চাইলে ফরমাশ দিয়েও বানিয়ে নিতে পারেন। বাজেটটা হয়তো তৈরি পোশাকের চেয়ে একটু বেশি হবে, তবে দেশের টাকা দেশেই থাকবে।