জেন-জি সাজপোশাকের কোন স্টাইল ফলো করছে
নিজেকে নিজের মতো করেই তৈরি করতে চান এখন কিশোর-তরুণেরা। আর কাজটা করতে গিয়ে নিখুঁত হওয়ার কোনো চেষ্টাই তাঁরা করছেন না। পরিবর্তে সাজে, পোশাকে, জীবনযাপনে বেছে নিচ্ছেন অকৃত্রিমতা। বিদেশি ফ্যাশনের মধ্যেই ধারণ করছেন দেশীয়পনা। আর সবার ওপরে রাখছেন নিজস্বতা। যা ভালো লাগে, তা–ই জীবনের সঙ্গে জুড়ে নিচ্ছেন মুক্তমনা এই কিশোর-তরুণেরা।
সহজ পোশাকের দিন
পোশাক ইস্ত্রি করতে না হলে বেঁচে যান এখনকার কিশোর-তরুণেরা। তাই তো এমন কাপড়ের জামা কেনার চেষ্টা করেন, যেটা সহজে কুঁচকাবে না, বলছিলেন তাঁদেরই একজন আদিবা (২৩)। হালকা সুতি, লিনেন ও জর্জেটের পোশাকে অভ্যস্ত মুগদা মেডিকেল কলেজের এই শিক্ষার্থীর কাছে সহজ পোশাক মানেই সময় সাশ্রয়ী। আরেকটি হচ্ছে ‘টু পিস’ কৌশল, অর্থাৎ পোশাকে দুটি অংশ থাকবে। প্যান্টের সঙ্গে শার্ট, টি–শার্ট পরে এই কৌশলে ছেলেরা অনেক আগে থেকে অভ্যস্ত হলেও মেয়েদের মধ্যেও আজকাল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে কো–অর্ড সেট পরছেন প্রায় প্রতিদিন। ওদিকে কিশোর ও তরুণেরা পরছেন অতিরিক্ত বড় আকারের শার্ট ও টি-শার্ট।
চাপা প্যান্টের দিন ফুরাল
একরঙা টপসের সঙ্গে রঙিন প্যান্ট পরতে ভালোবাসেন মাইশা (২৪)। পরনের হালকা গোলাপি প্যান্টটি কিছুদিন আগেই কিনেছেন। তাঁর সংগ্রহে আছে সবুজ, আকাশি, এমনকি কমলা রঙের প্যান্টও। এগুলোর বেশির ভাগই কিনেছেন ঢাকা কলেজের বিপরীতে নুরজাহান মার্কেটের একটি দোকান থেকে। তৈরি পোশাকের বিশাল এ মার্কেটকে প্যান্টের স্বর্গরাজ্য মনে করেন মাইশা।
মাইশার বন্ধু ফাইরুজও (২৪) এখান থেকে প্যান্ট কেনেন। রঙিন নয়, তাঁর পছন্দ কালো, বাদামি প্যান্ট। হিজাবের সঙ্গে মিলিয়ে প্যান্টের রং বেছে নেন তিনি। রঙের ব্যাপারে দুজনের পছন্দ দুই রকম হলেও দুজনেরই পছন্দ ঢিলেঢালা প্যান্ট। ১ আগস্ট নুরজাহান মার্কেটে এই দুই বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মাইশা জানান, এখানে মেয়েদের প্যান্টের খুব ভালো একটি দোকান আছে। পথ দেখিয়ে সেখানে নিয়ে গেলেন। দোকানের নাম ওয়ান লাইফ স্টাইলমার্ট। দোকানটির বিক্রয়কর্মী রিয়াদের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত এই দুই তরুণী। রিয়াদ বলেন, চাপা প্যান্টের দিন এখন আর নেই। শুধু মেয়েরা নয়, কিশোর বয়সী ছেলেরাও এখন ঢিলা প্যান্ট পছন্দ করে। গ্যাবার্ডিন প্যান্টের পাশাপাশি ঢিলেঢালা ব্যাগি প্যান্ট, জিনস, কার্গো, ইত্যাদি প্যান্ট পরছে তারা। ঢিলেঢালা প্যান্ট কিনে প্রয়োজনে কোমরে তারা–বেল্ট পরছেন ছেলেরা। মেয়েদের পাশাপাশি আজকাল ছেলেরাও পরছেন হাই ওয়েস্ট গুর্খা প্যান্ট।
যেমন খুশি তেমন সাজি
পোশাক যা–ই হোক, কপালে একটি ছোট্ট টিপ পরেন পূর্বা (২২)। তাঁর বন্ধু রাফিদকে (২২) কেউ কোনো দিন একরঙা পোশাকে দেখেনি। সব সময় রঙিন ছাপের হাওয়াই শার্ট অথবা অদ্ভুতুড়ে ছাপওয়ালা টি–শার্ট পরেন তিনি। তাঁদের আরেক বন্ধু পাভেলের পরনে টি–শার্টের ওপর ঢিলেঢালা একটি শার্ট থাকবেই। তিনজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পূর্বা বলছিলেন, সবারই কোনো না কোনো স্টাইল আছে। সবাই নিজের মতো করে সাজে। সাজপোশাকের ব্যাপারে কিশোর-তরুণদের পছন্দ প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হচ্ছে বলে জানান ফ্যাশন ব্র্যান্ড গরুর ঘাসের সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম ইসলাম। আধুনিক ধারার পোশাক নিয়ে কাজ করা এই তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, একেক সময় একেক রং, প্যাটার্ন, টেক্সচার ও ফিট পছন্দ করছেন কিশোর-তরুণেরা।
সাদামাটা মেকআপ ছাপিয়ে প্রতিদিন নতুনভাবে সাজতে একদমই ভয় পাচ্ছেন না তাঁরা। গ্রাফিক আইলাইনার, কালো, নীল, বেগুনি রঙের লিপস্টিকে নিজেকে সাজিয়ে তুলছেন অন্য রকমভাবে। এই এত কিছুর উদ্দেশ্যও একটাই, নিজেকে প্রকাশ করা। দেশির সঙ্গে বিদেশি ধাঁচ ফিউশন করে তৈরি হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের নিজস্ব স্টাইল। এ জন্য অবশ্য আন্তর্জাতিক ফ্যাশনধারায়ও চোখ রাখছেন তাঁরা।
ফিরে আসুক পুরাতন
নতুন তো আছেই, সঙ্গে পুরোনোকেও ফিরিয়ে আনতে ক্ষতি কী? বলছিলেন শান্ত–মরিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাশন ডিজাইনিং বিভাগের শিক্ষার্থী আনিকা (২৩)। নব্বই দশকের ফ্যাশনের ভীষণ ভক্ত এই তরুণী বলছিলেন, পলকা ডট, রঙিন চেক, ফ্লোরাল প্যাটার্ন, ইত্যাদি এখন ফিরে আসছে। ফ্লানেল ও কর্ড কাপড়ের শার্ট, স্লিপ ড্রেস, মিডি ড্রেসের পাশাপাশি ফিরে এসেছে বেলবটম প্যান্টও।
আরামদায়ক অনুষঙ্গ
প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আঁটবে, এমন একটি ব্যাগ আর আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জুতা, অনুষঙ্গের মধ্যে এই দুটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, জানায় আরাশতা (১৭)। মাঝেমধ্যে নানা ঢঙের ছোট–বড় ব্যাগ ব্যবহার করলেও নিয়মিত ব্যবহারের জন্য মাঝারি মাপের ব্যাগই পছন্দ এই কিশোরীর। কাঁধের ব্যাগের পাশাপাশি ব্যাকপ্যাকও আছে পছন্দের তালিকায়। দুই হাত মুক্ত রাখতে ক্রসবেল্ট করে নেয় ছোট ব্যাগগুলো।
কড়া রোদে বের হলে পা–বন্ধ শু আর বৃষ্টির সময় বৃষ্টিরোধী প্লাস্টিকের স্যান্ডেল বা ক্রকস পরছেন কিশোর-তরুণেরা। স্নিকার ছাড়া বোহিমিয়ান ঢঙের শু, বুটজুতা, রেট্রো শু, কনভার্স জুতাও পরছেন ছেলেমেয়ে সবাই। মেয়েদের পছন্দ হালকা স্লিপার। পেনসিল হিলের বদলে তাঁরা বেছে নিচ্ছেন প্ল্যাটফর্ম হিল।
সবার জন্যই গয়না
রেজিন দিয়ে গয়না তৈরি করেন জিসান। নিজের হাত ও গলায় পরার লকেট, কানের দুল, টপ, আংটি, ব্রেসলেট, মালা, চোকার ইত্যাদি বানান। অনলাইনে তাঁর পেজের নাম ‘দ্য জাউন স্টোর’। তবে ক্রেতারা যেন সামনাসামনি দেখে কিনতে পারেন, সে জন্য প্রায় প্রতিদিন ধানমন্ডি ১৫ নম্বরের ইউনিমার্টের সামনে একটি ছোট্ট টেবিলে গয়নাগুলো সাজিয়ে বসেন। জিসান বলেন, শুধু মেয়েরা নন, ছেলেরাও আজকাল লকেট, ব্রেসলেট পরছেন, আংটি পরছেন। তাই তো ইউনিসেক্স বা উভয়লিঙ্গ গয়নার চাহিদা আছে।
কৌশলের নাম ‘মিনিমালিজম’
ফ্যাশনের জন্য এত এত কাপড় কেনার ঝামেলা থেকে রক্ষা পেতে তিনটি পদ্ধতি মেনে চলেন কিশোর ও তরুণেরা। সেগুলো হলো থ্রিফট, রেন্ট আর আপসাইকেল। থ্রিফট হচ্ছে অন্যের ব্যবহৃত জিনিস কেনা। রেন্ট হচ্ছে সাময়িক ব্যবহারের জন্য ভাড়া নেওয়া। আর আপসাইকেল হচ্ছে পুরোনো পোশাককে নতুন কিছুতে রূপ দেওয়া। ফ্যাশনের জন্য এত এত পোশাক কেনা সম্ভব না বলেই কিশোর-তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই তিন উপায়। যাঁরা এই তিন উপায়ে পোশাক কেনেন, তাঁরা আসলে মিনিমালিজমে বিশ্বাসী, জানান রুকাইয়া হাসান (২৫)। বেশ কয়েক দিন ধরেই থ্রিফটের ব্যবসা করছেন তিনি। বলছিলেন, আজকালকার কিশোর-তরুণেরা ফ্যাশনসচেতন হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ নিয়ে ভাবেন। তাঁরা জানেন, ফেলে দেওয়া কাপড় পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর। সে জন্য তাঁরা ফাস্ট ফ্যাশনের ব্যাপারেও ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে উঠছেন। তা ছাড়া এ কৌশলে কম খরচে বেশি ফ্যাশন করা যায়।