টাঙ্গাইল শাড়ির শিল্প ও বাণিজ্য গড়ে উঠেছে যে দুই গ্রামকে ঘিরে

বাংলাদেশের আর দশটা গ্রামের সঙ্গে পাথরাইল ও চণ্ডীকে মেলানো যাবে না। কেন? টাঙ্গাইল শাড়ির ঠিকানা যে এই দুই গ্রাম। এই দুই জায়গাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে অনন্য এই শাড়ির শিল্প ও বাণিজ্য। গ্রাম দুটি ঘুরে এসে বাংলাদেশের ঐতিহ্য টাঙ্গাইল শাড়ির আদ্যোপান্ত তুলে ধরলেন পল্লব মোহাইমেন

শাড়ি বুনছেন এক তাঁতিছবি: সুমন ইউসুফ

টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার একটি ইউনিয়ন পাথরাইল। এই ইউনিয়নের দুটি গ্রাম চণ্ডী ও পাথরাইল। গ্রাম দুটির বুক চিরে চলে গেছে টাঙ্গাইল–দেলদুয়ার পাকা সড়ক। সড়কটা মোটামুটি ব্যস্ত হলেও এখনো বাংলাদেশের আর দশটা গ্রামের মতোই দুপুরের পর ঝিমিয়ে পড়ে পাথরাইল আর চণ্ডী, সন্ধ্যার পর নিঝুম। তারপরও বাংলাদেশের অন্য কোনো গ্রামের সঙ্গে এ জায়গাকে মেলানো যাবে না। কেন? পাথরাইল নামটা পড়েই সমঝদার পাঠক বুঝতে পেরেছেন। টাঙ্গাইল শাড়ির ঠিকানা যে এই পাথরাইল ইউনিয়ন। এই জায়গাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে টাঙ্গাইল শাড়ির বাণিজ্য।

টাঙ্গাইল-দেলদুয়ার সড়কের পাথরাইল–চণ্ডী অংশের দুই পাশেই পাকা দালান, কাচঘেরা ঝাঁ–চকচকে দোকান দেখে জায়গাটাকে শহর বলে ভ্রম হবে। শুধু কি সড়কের দুই পাশ? চণ্ডী ও পাথরাইল গ্রামের কাঁচা রাস্তার অলিগলিতে দোতলা, তিনতলা বাড়িগুলো সচ্ছলতা, বিত্তবৈভবের জানান দেয়। প্রায় সব বাড়ির সামনের অংশ শাড়ির শোরুম। পেছনের অংশে আড়ত বা ব্যবসাটির স্বত্বাধিকারীর বাড়ি। টাঙ্গাইলে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক কামনাশীষ শেখর বললেন, ‘শুধু ব্যবসা করে সৎভাবে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার উদাহরণ এই পাথরাইলে পাবেন। ব্যাংকগুলো ছুটে আসে এখানে ব্যবসায়ীদের গ্রাহক বানাতে।’ এসব কারণেই বললাম, পাথরাইল ও চণ্ডী বাংলাদেশের ব্যতিক্রমী গ্রাম।

তাঁতে বোনা হচ্ছে টাঙ্গাইল শাড়ি
ছবি: সুমন ইউসুফ

ঈদের ব্যস্ততা পাথরাইলের পথে

মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে সদলবল পাথরাইলে গিয়েছিলাম। আমরা যখন পাথরাইলে পৌঁছাই, তখন দুপুর ছুঁই ছুঁই। শোরুমগুলোর সামনে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। শাড়ি দিয়ে ভরা হচ্ছে কার্টনের পর কার্টন। এগুলোর আপাত গন্তব্য টাঙ্গাইল, বিভিন্ন পরিবহন সংস্থার কার্যালয়। সেখান থেকে যাবে ঢাকার ছোট–বড় বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সামনে যেহেতু ঈদুল ফিতর, পাথরাইলে তাই ব্যস্ততা বেশি। সীতানাথ–রণজিৎ বসাকের বর্তমান অংশীদার সুবীর বসাক একটা হিসাব দিলেন, ‘বছরের ১১ মাস যে পরিমাণ টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রি হয়, ঈদুল ফিতরের সময়, অর্থাৎ রমজানের এক মাসে সেই পরিমাণ শাড়ি বিক্রি হয়।’ পাথরাইলে রমজান শুরুর আগে আগে বিক্রিবাট্টার সেই তোড়জোড় ভালোভাবেই বোঝা গেল। সুবীর বসাক ও তাঁর ছোট ভাই পলাশ বসাকের কাছ থেকে জানা গেল, উৎসবভিত্তিক বিক্রির ক্ষেত্রে ঈদের পরেই আছে দুর্গাপূজা। এ ছাড়া পয়লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারির সময়ও টাঙ্গাইল শাড়ির বেশ চাহিদা থাকে। তবে গত কয়েক বছর পয়লা বৈশাখ ও ঈদ কাছাকাছি পড়ায় বৈশাখের আলাদা বাজার নেই। আগামী তিন–চার বছরও একই অবস্থা থাকবে।

রঙে–নকশায় সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা টাঙ্গাইল শাড়ির বৈশিষ্ট্য
মডেল: নিদ্রা, ছবি: সুমন ইউসুফ

টাঙ্গাইল শাড়ির বৈশিষ্ট্য কী

যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী এবং টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাকের দোকান ও বাড়ি চণ্ডী গ্রামে। তিনতলা বাড়িতে লিফট রয়েছে। নিচতলার সামনের অংশে দোকান। রঘুনাথ বসাক বসে আছেন দোকানের কাউন্টারে। টেবিলে একটি প্রাচীন গ্রামোফোন, এখনো সচল। সেখানে বসে শুরুতেই জিজ্ঞেস করলাম, টাঙ্গাইল শাড়ির বৈশিষ্ট্য কী? রঘুনাথ বসাক বললেন, ‘পদ্ধতির কারণে উৎপাদন ধীর। হাত বা হস্তচালিত তাঁতে তৈরি না হলে সেটা টাঙ্গাইল শাড়ি হবে না। যখন দ্রুত শাড়ি উৎপাদন হবে, তখন আর সেটা টাঙ্গাইল শাড়ি না।’

আরও কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বললেন রঘুনাথ, ‘ধোয়ার পরও টাঙ্গাইল শাড়ি হাতে–বহরে (দৈর্ঘ্যে–প্রস্থে) কমবে না। টাঙ্গাইল শাড়ি প্রথমে ১০ হাত (১৫ ফুট) দৈর্ঘ্যের হতো। এরপর ১১ হাত, ১২ হাত হয়ে বর্তমানে ব্লাউজ পিসসহ এই শাড়ি দৈর্ঘ্যে ১৪ হাত। বহর বা প্রস্থে ৪৭ ইঞ্চি বা আড়াই হাতের একটু বেশি। এখন প্রস্থ ৪৬ ইঞ্চিও রাখা হয়।’

শাড়ি উৎপাদক বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা জানা গেল, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে টাঙ্গাইল শাড়ি। নিজেকে বদলে নিতে পারে সময়োপযোগী করে। শত বছরের বেশি সময় ধরে বংশপরম্পরায় যে শাড়ির বুননরীতি টিকে আছে, তার কারণ এটাই। রং, নকশা, উপকরণ—সব যুগেই আধুনিক থেকেছে এই শাড়ি। ফ্যাশন হাউসগুলোর সংগ্রহের দিকে তাকালেও সেটা বোঝা যায়। সব সময়েই বেশির ভাগ ফ্যাশন হাউসের সংগ্রহের একটা বড় অংশের উৎস টাঙ্গাইল শাড়ি। প্রায় চার দশক ধরে এ ধারা অব্যাহত ও বেগবান।

সুতির পাশাপাশি সিল্কসহ নানা উপকরণে তৈরি হয় টাঙ্গাইল শাড়ি
মডেল: সায়রা, শাড়ি: সীতানাথ রঞ্জিত বসাক, ছবি: সুমন ইউসুফ

টাঙ্গাইল শাড়ির আদিবাড়ি পাথরাইল

‘বসা কাজ করে বিধায় বসাক।’ পাথরাইলে টাঙ্গাইল শাড়ির পত্তন এই বসাক সম্প্রদায়ের হাত ধরে। বসা কাজ বলতে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বসে হাত দিয়ে তাঁতে কাপড় বোনার কাজটাকে বোঝানো হয়েছে। এখনো টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপাদন ও বিপণনের প্রায় পুরোটা এই তাঁতি সম্প্রদায়ের হাতে। বংশপরম্পরায় তাঁরাই ধরে রেখেছেন টাঙ্গাইল শাড়ির গুণমান ও ঐতিহ্য।

রঘুনাথ বসাকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম ‘যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড সন্স’। যজ্ঞেশ্বর বসাক রঘুনাথের পিতা। এখন রঘুনাথের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তাঁর ছেলে খোকন বসাক। রঘুনাথ বসাক শোনালেন পাথরাইলে বসাক, তথা টাঙ্গাইল শাড়ির পত্তনের শ্রুত ইতিহাস। সেই ইতিহাস এমন, ৫০০ বছর আগে সনাতন ধর্মের প্রচারক গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু (শ্রীচৈতন্য) ভারতের মায়াপুর (নবদ্বীপ) থেকে সিলেট অঞ্চলে আসেন। তিনি মোটা কাপড় পরতেন। তাঁর অনুসারীরা হস্তচালিত তাঁতে কাপড় বুনতেন। তাঁরাই বসাক সম্প্রদায়, যাঁদের তাঁতি বলা হতো। তন্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত তাঁতি। সেই বসাকদের একটা অংশ মুর্শিদাবাদ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে বাংলাদেশ অঞ্চলে এসেছিল। হস্তচালিত তাঁতে শাড়ি, কাপড় বোনার জন্য যে আবহাওয়া প্রয়োজন, তার খোঁজ করতেন তাঁরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কিশোরগঞ্জ, ঢাকার তাঁতীবাজার, ধামরাই হয়ে টাঙ্গাইলের পাথরাইলে বসত গড়েন বসাকেরা। এখন যেটা পাথরাইল, সে সময় সেখানে ধলেশ্বরী নদীর শাখা ছিল লৌহজং। এটি ২৫০ বছর আগের কথা। তখন থেকে এই শাড়ির নাম ছিল টাঙ্গাইল শাড়ি। বসাক ছাড়াও পাথরাইলে অন্য সম্প্রদায়ের তাঁতি, উদ্যোক্তা রয়েছেন। হাতে গোনা কয়েকজন মুসলমান উদ্যোক্তাও রয়েছেন।

টাঙ্গাইল শাড়ির পত্তন বসাক সম্প্রদায়ের হাত ধরে
ছবি: সুমন ইউসুফ

 জিআই বিতর্ক

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ টাঙ্গাইল শাড়ির ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি পাওয়ায় সম্প্রতি আবার আলোচনার কেন্দ্রে টাঙ্গাইল শাড়ি। ভারতে তো টাঙ্গাইল বলে কোনো স্থানই নেই। তাহলে পশ্চিমবঙ্গ কেন এটির জিআই পেল, এ নিয়ে প্রশ্ন আছে, ক্ষোভও রয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে পাথরাইল থেকে বসাক সম্প্রদায়ের অনেকে মূলত পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া, বর্ধমান জেলায় দেশান্তরি হয়েছেন। এরপর কখনো কম, কখনো বেশি হারে এই দেশত্যাগের ঘটনা ঘটছে। দেশান্তরির তিনটি কারণের কথা বললেন রঘুনাথ বসাক। এক. সরাসরি অত্যাচার, দুই. উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে লাভ না পাওয়া এবং তিন. নিজেদের মধ্যে রেষারেষি। পাথরাইলের বর্তমান প্রজন্মের অবস্থা দেখলে বোঝা যাবে না, কী কষ্ট তাঁদের পূর্বপুরুষদের করতে হয়েছে। দেশভাগের পর এক বেলা খেয়ে না খেয়ে কাটাতে হয়েছে। দেশান্তরি হয়ে যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন, তাঁরা সেখানে পুরোই বিপরীত চিত্র পেয়েছিলেন।

এ কথা পাথরাইলের সবাই স্বীকার করলেন, ১৯৮০–এর দশকে মুনিরা ইমদাদের টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের হাত ধরে টাঙ্গাইল শাড়ির পুনর্জাগরণ। টাঙ্গাইল শাড়ির অপূর্ব বুননশৈলীকে, উপকরণের আরামকে রাজধানীর নাগরিক ফ্যাশনে তুলে ধরার পরই ঘুরে দাঁড়ায় টাঙ্গাইল শাড়ি। বদলে যায় পাথরাইল আর বসাক সম্প্রদায়ের অবস্থা। এই পুনর্জাগরণের নেপথ্যে রুবি গজনবী ও বিবি রাসেলের অবদানের কথাও বললেন একাধিক প্রবীণ উদ্যোক্তা।

জিআই হাতছাড়া হওয়ার প্রসঙ্গে রঘুনাথ বসাক প্রথমে আত্মসমালোচনা করতে চাইলেন। তিনি বলেন, ‘২০২০ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক টাঙ্গাইল শাড়ি দিয়ে টাঙ্গাইলের ব্র্যান্ডিং করেন। তখন এই শাড়ির জিআই চাইলে আজ আর বিরোধ তৈরি হতো না। জেলা প্রশাসন টাঙ্গাইল শাড়ির ব্র্যান্ডিং করল, কিন্তু জিআই চাইল টাঙ্গাইলের চমচমের। তবে এটাও ঠিক আমার সম্পদ আমি চাইনি, ওরা কেন এটা চাইবে। সেটা তো অন্যায় করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিশ্ব বাংলা প্রথমে “টাঙ্গাইল শাড়ি” নামে জিআই আবেদন করে। সেখানে টাঙ্গাইল নামে কোনো স্থান না থাকায় সেই আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর তারা বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি (টাঙ্গাইল শাড়ি অব বেঙ্গল) নামে জিআই আবেদন করে এবং পেয়ে যায়।’

টাঙ্গাইল শাড়ি
ছবি: সুমন ইউসুফ

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে

২০০৯ সাল থেকে বেশ কবার পাথরাইলে গিয়েছি। প্রতিবারই পাথরাইলের পরিবর্তন, টাঙ্গাইল শাড়ির রং–নকশার আধুনিকতা দেখেছি। আশির দশকে যে পুনর্জাগরণ, সেটির ধারাবাহিকতা নজরে আসে টাঙ্গাইল শাড়িতে বিভিন্ন সময়। টাঙ্গাইলে অনেক আগেই শেষ হয়েছে সাদামাটা ডুরে শাড়ির দিন। নব্বইয়ের দশকে শুরু হয় টাঙ্গাইল শাড়িতে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার। টাঙ্গাইল বালুচুড়ির প্রবর্তনও সে সময় প্রয়াত মনমোহন (ভাষা) বসাকের হাত ধরে। ২০০৯ সালেই তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনিই তখন টাঙ্গাইল শাড়ির মূল নকশাকার। গ্রাফ কাগজে নকশা আঁকতেন, তারপর মোটা কাগজে পাঞ্চ করে গর্ত তাঁতের জ্যাকার্ডে তোলা হতো সেই নকশা। এই পদ্ধতি এখনো চলছে। তবে চিত্তরঞ্জন তাঁতে জ্যাকার্ড বসানোর কারিগরি দিকসম্পন্ন হওয়ায় দ্রুত উৎপাদন করা যায় শাড়ি।

পাথরাইলে সবই মূলত পাইকারি বিক্রির দোকান। খুচরা বিক্রি যে হয় না, তা নয়, তবে নগণ্য। ফ্যাশন হাউস আড়ংয়ের ৪০ বছর পূর্তিতে আজীবন সম্মাননা পাওয়া তাঁতশিল্পী, উদ্যোক্তা রাধাবল্লভ অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী সুশীল বসাক বললেন, উৎসব অনুযায়ী শাড়ির নকশা করা হয়। ফ্যাশন হাউসগুলোর ডিজাইন ধরেও তৈরি হয়। এভাবেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে টাঙ্গাইল শাড়ি। তবে শাড়ি বিক্রি করার পরিসর ছোট হয়ে আসছে।

নকশা তৈরির প্রক্রিয়ায়ও এসেছে পরিবর্তন। সুবীর ও পলাশ বসাক জানান, এখন তো কম্পিউটারে নকশা হয়। বেশ কিছু গ্রাফিক ডিজাইনার আছেন, যাঁরা নকশা করে দেন, অবশ্যই চাহিদা অনুযায়ী। কম্পিউটারে নকশা করার পর সেটা প্রিন্ট করে জ্যাকার্ডের জন্য পাঞ্চ কার্ড (ছিদ্রযুক্ত কাগজ) তৈরি করা হয়। এরপর ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত বসা তাঁতে বোনা হয় শাড়ি।

পাথরাইলে উদ্যোক্তাদের শোরুমের সংখ্যা যত বেড়েছে, সে হারে কমেছে তাঁতের সংখ্যা। পাথরাইলে এখন শ চারেক হস্তচালিত তাঁত রয়েছে। বাকি তাঁতগুলো দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল সদর, কালিহাতী, বাসাইল ও নাগরপুর উপজেলার গ্রামগুলোতে। এখন তিন ধরনের তাঁতে টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি হয়—হাতে চলা গর্ত তাঁত (পিটলুম), আধা স্বয়ংক্রিয় (চিত্তরঞ্জন তাঁত) ও  বিদ্যুৎ–চালিত তাঁত (পাওয়ার লুম)। উপকরণেও আছে বৈচিত্র্য। মূলত টাঙ্গাইল শাড়ি বলতে সাধারণ সুতি শাড়িই বোঝায়। এই সুতির শাড়ির একটি একটু কড়কড়ে, আর মার্চরাইজড সুতির শাড়ি একটু কোমল। পাকিস্তান আমলে ছিল বিটি নকশা। সেটার নাম এখন টাঙ্গাইল বুটি। এই নকশা দেখলেই বোঝা যায়, এটি টাঙ্গাইল শাড়ি। সুতি ছাড়া হাফ সিল্ক, সিল্ক, অ্যান্ডি, কৃত্রিম সিল্কের (সিনথেটিক) শাড়িও বোনা হয় টাঙ্গাইলে। টাঙ্গাইল শাড়ির নকশা মূলত জ্যামিতিক। ফুল–লতা–পাতা, যা–ই হোক। আবার জামদানির নকশাও ফুটিয়ে তোলা হয়। উপকরণ নারায়ণগঞ্জের আসল জামদানি থেকে ভিন্ন। শুধু নকশার মোটিফ জামদানি। চাহিদার কারণে এসব শাড়িও তৈরি হয় টাঙ্গাইলে।

টাঙ্গাইল শাড়ি পরে মডেল হয়েছেন সায়রা ও নিদ্রা
পোশাক: রঘুনাথ বসাক অ্যান্ড সন্স, সাজ: অরা বিউটি লাউঞ্জ, ছবি: সমুন ইউসুফ

উৎপাদন কেমন? সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। তবে একটা ধারণা করা যায়। সীতানাথ–রণজিৎ বসাক বছরে গড়ে প্রতি সপ্তাহে এক হাজার শাড়ি তৈরি করেন। পাথরাইলে এমন উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ২০–২৫টি। গড়ে প্রতি সপ্তাহে ২৫ হাজার, মাসের হিসাবে ১ লাখ শাড়ির উৎপাদন হয়। উৎসবের বাড়তি হিসাব ধরেই এই গড়।  

গৌরবের উজ্জ্বলতায়

এই প্রতিবেদনের ফটোশুটে অংশ নিয়েছেন দুই তরুণ মডেল—অভিনেত্রী সায়রা ও নিদ্রা। ছবি তোলার শুরু থেকেই এই প্রজন্মের এই দুই নারীর চোখে–মুখে মুগ্ধতা দেখি টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে। শাড়ি দেখছেন আর মুগ্ধ হচ্ছেন। শাড়িতে হাত বুলিয়ে বারবার অনুভবের চেষ্টা করেন। সন্ধ্যার পর শুটের শেষভাগে সায়রা বলেন, ‘ওই শাড়িটা নিতেই হবে।’ বিস্কুটরঙা শাড়িটা তিনি সংগ্রহও করলেন। ওদিকে মেরুন একটা শাড়িতে নিদ্রার নজর। সেটা তো বটেই, আরও কয়েকটা কিনলেন। দুজনেই জানান দিলেন, আমরা যখন ঢাকায় বিভিন্ন হাউস থেকে কিনি, তখনো টাঙ্গাইল শাড়ির আলাদা বৈশিষ্ট্য টের পাই। সব সময়েই একটা আভিজাত্য, আরাম আর আধুনিকতা থাকে। এটাই টাঙ্গাইল শাড়ির এগিয়ে চলার মূলে।

বংশপরম্পরায় সময়কে ধরতে পেরেছেন পাথরাইলের বসাকেরা, তাঁতশিল্পী ও উদ্যোক্তারা। প্রতিবেদনের কাজ শেষ করতে করতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। শাড়ির দোকানের আলোয় ঝলমলে চণ্ডী ও পাথরাইল গ্রাম। আমরা ফিরতি পথ ধরি। পেছনে ফেলে আসি নিয়ন সাইনে টাঙ্গাইল শাড়ির উজ্জ্বল সব নাম—যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড সন্স, নিউ যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানি, রাধেশ্যাম নীলকমল বসাক, কালাচাঁদ–উত্তম বসাক, রাধাবল্লভ অ্যান্ড সন্স, নিউ রাধাবল্লভ অ্যান্ড কোম্পানি, সীতানাথ-রণজিৎ, দিলীপ বসাক, তারাপদ শাড়িজ, টাঙ্গাইল শাড়িজ, মলয়চন্দ্র বসাক, মনমোহন বসাক অ্যান্ড সন্স, আনন্দ বসাক, মনেমন্টুর শাড়ি, নিউ মনেমন্টুর শাড়ি, আনন্দ বসাক, পার্থ বসাক, তাঁত পল্লী (সোহরাব হোসেন), বটেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানি। কাচঘেরা দোকানগুলো থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে উজ্জ্বল আলো, যেন টাঙ্গাইল শাড়ির শাশ্বত গৌরবের জ্যোতি।