দেশি ফ্যাশনে রঙিন বিজয়ের উৎসব
৫৪ বছরে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে রূপবদল ঘটে গেছে অনেক। বিশেষ করে পোশাকে। তবে একটি বিষয় অপরিবর্তিত। বিজয়ের মাসে পতাকার লাল-সবুজ রং চলে আসে আমাদের বসনে–ভূষণে।
এ কথা কমবেশি সবারই জানা আছে, আমাদের পতাকার লাল বৃত্তটার মধ্যে শুরুতে হলুদ রঙে বাংলাদেশের একটা মানচিত্র ছিল। কিন্তু দেখা গেল পতাকার উভয় পাশ থেকে মানচিত্রটিকে ঠিকঠাক দেখা যায় না, এক পাশ ঠিক থাকলে অপর পাশে দেখা যায় উল্টো। কিন্তু পতাকায় উল্টো মানচিত্র তো আর মেনে নেওয়া যায় না। আর মানচিত্রসহ পতাকা বানানোটাও বেশ কঠিন। তাই ঠিক হলো পতাকার নকশা হবে এমন যাতে সব পাশ থেকেই একই রকম দেখা যায় আর বানানোও যায় সহজে। পটুয়া কামরুল হাসান পতাকা থেকে শুধু হলুদ রঙের বাংলাদেশের মানচিত্রটা উঠিয়ে দিলেন। ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়ে গেল এই নকশা। ৫৪ বছর ধরে সেই লাল-সবুজ পতাকাই বিজয় দিবসের ফ্যাশনকে সবচেয়ে গভীরভাবে প্রভাবিত করে আসছে!
পতাকার আয়তক্ষেত্রের সবুজ রংটি মূলত সবুজ প্রকৃতি ও তারুণ্যের প্রতীক। অন্যদিকে লাল বৃত্তটা উদীয়মান সূর্য ও স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারীদের রক্তের প্রতীক। লাল ও সবুজ দুটিই মৌলিক রং। দৃশ্যমান আলোর ভেতর লাল রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে দীর্ঘ। আর ঠিক এ কারণেই লাল রং সবচেয়ে দূর থেকে দেখা যায়। ঘরে অনেক মানুষ থাকলে লাল পোশাক পরা মানুষটির ওপর সবার আগে নজর পড়ে। ঠিক এসব কারণেই সারা বিশ্বেই উৎসবের রং হিসেবে লালের আলাদা কদর রয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রে সেই লাল–সবুজের সঙ্গে মিশে আরও বেশি মাহাত্ম্য নিয়ে উপস্থিত!
লাল একটি শক্তিশালী রং, যা উত্তেজনা, ক্ষমতা ও শক্তির মতো তীব্র আবেগ জাগাতে পারে। অন্যদিকে সবুজ রং প্রায়ই প্রকৃতি ও প্রশান্তির সঙ্গে যুক্ত। লাল-সবুজ একসঙ্গে একটি ভারসাম্যপূর্ণ উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করে, পরিধানকারীর ভেতরে জাগায় উদ্যাপনের অনুভূতি।
২
কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি থেকে বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন আমার প্রবাসী ননাশ। যত দিন ঢাকায় ছিলেন, কেনাকাটা করতে বের হয়েছেন প্রায় প্রতিদিন। ৯ বছরের একমাত্র কন্যা রিসলিয়ার জন্য নিলেন কয়েকটি শাড়ি ও সালোয়ার–কামিজ। প্রতিটি পোশাকের সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস আর ঐতিহ্য। আর বিজয় দিবসের জন্য যে শাড়িটা নিলেন, সেটা মূলত সাদা, ভেতর লাল গোলাপ আর সবুজ পাতার নকশা আঁকা। তিনি জানালেন, প্রবাসী বাংলাদেশিরা মিলে বিজয় দিবসের যে আয়োজন করবেন, সেখানে রিসলিয়া ওই শাড়িটা পরেই যাবে। তিনি বললেন, ‘যে প্রজন্ম বাংলাদেশের বাইরে জন্ম নিয়েছে, বেড়ে উঠছে, বিজয় দিবসের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোয় পোশাকের ভেতর দিয়েই তাঁদের জাতীয়তাবোধ আর দেশপ্রেম ফুটে ওঠে।’ এ ছাড়া বাংলা কবিতা লেখা শীতের চাদর, মণিপুরি আর জামদানি শাড়ি, রিকশা পেইন্টের একটা জ্যাকেট আর দুটি নকশিকাঁথা আর একটা হারিকেনের স্যুভেনিরও নিলেন। এগুলোই দেশের বাইরে নীরবে সুস্পষ্টভাবে দেশের অস্তিত্বের জানান দেয়।
৫৪ বছরে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে রূপবদল ঘটে গেছে অনেক। বিশেষ করে ফ্যাশনে। গত দুই দশকে আমাদের ফ্যাশনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে দিবসভিত্তিক সাজপোশাক। পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু করে বিজয় দিবস—সব জাতীয় দিবসকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন পসরা নিয়ে সেজে ওঠে দেশীয় ফ্যাশন হাউস।
একই ধারাবাহিকতায় নভেম্বরের মনমরা ভাব কাটিয়ে মহাসমারোহে উৎসবের বার্তা নিয়ে আসে ডিসেম্বর। ফ্যাশনেও লাগে তার ছোঁয়া। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে বহু বছর ধরে একই লাল-সবুজের নকশার একঘেয়েমি দূর করতে সৃজনশীলতার সঙ্গে নতুনত্ব আনতে মনোযোগী হয়েছেন দেশি ফ্যাশন উদ্যোক্তারা। উৎসব বা বিশেষ দিনের পোশাক যেন ‘বিয়ের শাড়ির মতো’ একদিন পরেই তুলে রাখা না লাগে, সেই দিকটিও পাচ্ছে গুরুত্ব! অর্থাৎ বিজয় দিবসের পোশাকটি যাতে ক্যাজুয়াল বা সেমিক্যাজুয়াল হিসেবে পরা যায়, তাই মোটিফগুলো অনেক সময় সরাসরি না করে একটু প্রচ্ছন্নভাবে ব্যবহার হচ্ছে।
৩
লাল-সবুজের বিভিন্ন শেডের পাশাপাশি স্ক্রিন প্রিন্ট ও ব্লক প্রিন্টে ফুটে উঠছে জাতীয় ফুল শাপলার সাদা, বেঙ্গল টাইগারের মুখ বা ডোরাকাটা, ডাকটিকিট, ছড়া-কবিতা, বাংলার প্রকৃতি, জাহানারা ইমামের বই একাত্তরের দিনগুলির লাইন, বিভিন্ন স্থাপনার নকশা, বর্ণমালা, বিভিন্ন জেলার নাম, আঞ্চলিক নানা বুলি, বাংলা ক্যালিগ্রাফ, বাংলা সিনেমার ডায়ালগ, জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ গানের লাইন ইত্যাদি। ২০২৩ সালে ইউনেসকোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার পর থেকে শাড়ি-পাঞ্জাবি-ওড়না, ঘরের পর্দা থেকে শুরু করে চায়ের কাপ, চশমার খাপ সবখানেই ঢুকে পড়েছে রিকশা পেইন্ট। বিজয় দিবস উপলক্ষেও বাজারে এসেছে রিকশা পেইন্টের নতুন নতুন সংগ্রহ। আবার বিজয় দিবস শীতকালে হওয়ায় শীতের পোশাকেও মিলছে বিজয় উৎসবের আঁচ। চাদর বা শালের বাইরে ফিউশনের এ সময়ে নির্দ্বিধায় ডেনিমের জ্যাকেটে উঁকি দিচ্ছেন বাঘমামা অথবা দোয়েল। আবার কখনো সোয়েটারে ফুটে উঠছে শাপলা ফুল বা মাছ!
ডিসেম্বর আসতে না আসতেই পতাকা আর ব্যান্ডানা বিক্রি করা ফেরিওয়ালাদের ব্যস্ততা বেড়েছে। পোশাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উৎসবে পরার অলংকার আর ঘর সাজানোর নানা অনুষঙ্গও বিক্রি হচ্ছে দেদার। অনেকে উপহার দেওয়ার জন্য কিনছেন বিজয়ের দিবসের থিমের এটা-সেটা। সব মিলিয়ে বিজয় দিবসের উৎসব দেশপ্রেমের রঙে রঙিন, তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ভরপুর আর নতুন আশার শক্তিতে উজ্জীবিত!