টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে বাংলাদেশের আইনি লড়াইয়ের যত উপায়

বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়িকে ভারত তাদের জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) পণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের এখন কী করণীয়? আইনি রাস্তায় এ ব্যাপারটি চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ রয়েছে।

নেটিজেনরা অনেকেই অনলাইনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন; কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কাজটির প্রতিবাদ কীভাবে করা যায়, আইনিভাবে এর সমাধান কী, এসব ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তেমন কোনো আলোচনা নেই।

ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টাঙ্গাইল শাড়িকে তাঁদের জিআই পণ্য হিসাবে ঘোষণা করেন ৪ জানুয়ারি। তখনই আসলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, শিল্পনকশা ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত ছিল। অথচ ১ ফেব্রুয়ারি ভারতের সাংস্কৃতিক দপ্তরের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে খবরটা প্রচার হওয়ার আগ পর্যন্ত বিষয়টি আমরা জানতেই পারিনি। তার পরপরই নেটিজেনরা অনলাইনে সরব হতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনলাইনে ভাইরাল ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় টাঙ্গাইল শাড়ি।  

জিআই পণ্যের স্বীকৃতি নিয়ে নেওয়ার আইনি ও বাণিজ্যিক তাৎপর্য অনেক। জিআই স্বীকৃতি ভারতের থাকার মানে হলো, এখন থেকে টাঙ্গাইল শাড়ি বাইরের কোনো দেশে রপ্তানি করা হলে আমাদের টাঙ্গাইল শাড়ির চেয়ে ভারতের টাঙ্গাইল শাড়ির দাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বা কখনো কখনো আরও বেশি পাবে। ভারতের টাঙ্গাইল শাড়ি ‘প্রিমিয়াম প্রোডাক্ট’ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে আর আমাদেরটা হয়ে যাবে ‘কপি প্রোডাক্ট’। তাছাড়া বিভিন্ন দেশে ওই প্রোডাক্ট রপ্তানির ক্ষেত্রেও ভারত অগ্রাধিকার পাবে। এর আগেও জামদানি, শীতলপাটি, ফজলি আমের মতো আমাদের নিজস্ব জিনিসগুলোকেও ওদের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি নিয়ে নিয়েছে। শেষমুহূর্তের চেষ্টায় জামদানির জিআই ভাগাভাগি হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইনবিশেষজ্ঞ। টাঙ্গাইল শাড়ির বিষয়টি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হলো। এই টাঙ্গাইল শাড়ি ইস্যুতে বাংলাদেশ কীভাবে প্রতিবাদ জানাতে পারে, সেই বিষয়ে তার একটি গবেষণা আছে।

এর আগে ভারত যখন জামদানির জিআই স্বীকৃতি পেয়েছিল, তখন বাংলাদেশ এই ক্রসবর্ডার জিআই প্রটেকশন ইস্যু কীভাবে কাজে লাগাতে পারে, সেই সম্পর্কে তৌহিদুল ইসলামের একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ওয়েবসাইটে তার পেপারটি ডকুমেন্টেড আছে। ওই লেখার শিরোনাম ‘ক্রসবর্ডার জিআই প্রটেকশন: চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড রেমিফিকেশন ফর বাংলাদেশ’। ওই লেখায় তিনি বাংলাদেশের জন্য যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, টাঙ্গাইল শাড়ি ইস্যুতেও ঠিক ওই প্রক্রিয়া অনুসরণ করার সুযোগ রয়েছে বলে মতামত দেন।

আপাতসাধারণ এই সুতির শাড়িও হয়ে উঠতে পারে উৎসবে ফ্যাশনের ধারক ও বাহক
ছবি: কবির হোসেন

বাংলাদেশের এখন উচিত হবে দ্রুততার সঙ্গে ভারতের জিআই অ্যাক্ট, ১৯৯৯–এর সেকশন ২৭ অনুযায়ী ওদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি বাতিল করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করা।

আবেদন মঞ্জুর না হলে আপিল করা যাবে ওই আইনের দ্বারা গঠিত আপিল বোর্ডে। এখন এই আবেদনগুলো কতটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে তা নির্ভর করবে আমাদের দেশের পক্ষ থেকে কতটা শক্ত কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে।

তারপরও যদি ফলাফল না আসে, তাহলে ডব্লিউটিওর বিতর্ক নিষ্পত্তি দলের (ডিসপিউট সেটলমেন্ট বডি) কাছে আমাদের দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরতে হবে। তবে সবার আগে পণ্যটিকে আমাদের দেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করতে হবে।

 ৬ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম ই-মেইলের মাধ্যমে জিআই সনদের আবেদন করেন। সঙ্গে প্রয়োজনীয় তথ্য, প্রমাণ ও নথি পাঠান। ৭ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) সন্ধ্যায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) এর পক্ষ থেকে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই এর প্রাথমিক স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত করেন। এখন দুই মাসের অপেক্ষা। এরমধ্যে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি যদি আপত্তি না জানায়, তাহলে মিলবে জিআই স্বীকৃতির চূড়ান্ত সনদ।

এটার পর আন্তর্জাতিক আদালতে বাকি প্রক্রিয়াগুলো শুরু করা সম্ভব হবে।

ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনে (ডব্লিউআইপিও) স্বীকৃত জিআই পণ্যের জন্য যে শর্তগুলো নির্ধারণ করে দেওয়া আছে, আমাদের কর্তাব্যক্তিরা গুরুত্বের সঙ্গে তৎপরতা চালালে টাঙ্গাইল শাড়ির একমাত্র অধিকার আমাদেরই পাওয়ার কথা। বাংলাদেশ যদি লিসবন অ্যাগ্রিমেন্টের পার্টি স্টেট হতো, তাহলে এই নিষ্পত্তির ব্যাপারটা লিসবন চুক্তির অধীন গঠিত লিসবনের ওই ফোরামে তোলা যেত। সেটি তুলনামূলক সহজ একটি প্রক্রিয়া হতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো লিসবন চুক্তির পার্টি স্টেট না।

উৎসবেও দেখা যায় টাঙ্গাইল শাড়ির জয়জয়কার
ছবি: কবির হোসেন

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ  তথ্য হলো, ক্রসবর্ডার জিআই প্রটেকশন বিষয়ে ড. তৌহিদের ওই পেপার এর আগে ইতিবাচকভাবে রিভিউ করেছিলেন রাজু নারায়ণ স্বামী, যিনি কেরালা রাজ্য সরকারের মুখ্য সচিব। তা ছাড়া ভারতে এই সেক্টরে আরেকজন স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ জয়শ্রী অটলও ড. তৌহিদের ওই পেপারকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। ভারতের নিজস্ব বিশেষজ্ঞরাই যেহেতু ড. তৌহিদের মতামতকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছেন, এই রেফারেন্সটা বর্তমান টাঙ্গাইল শাড়ির ইস্যুতে আমরা আরও শক্তভাবে ব্যবহার করতে পারি।

দেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন পাস হয় ২০১৩ সালে। ২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিয়ে আসছে ডিজাইন, পেটেন্ট ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। সরকারের এ বিভাগটি ডব্লিউআইপিওর নিয়ম মেনে পণ্যের স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে। ইতামধ্যে আমাদের টাঙ্গাইল শাড়ির স্বীকৃতির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তারপর ওদের স্বীকৃতি বাতিলের লড়াই শুরু করা যাবে।  

পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের মতো বাংলাদেশেরও উচিত নিজেদের ঐতিহ্যের স্বীকৃতি নিজেদের কাছে রাখার জন্য যা করণীয়, তা–ই করা। নেপাল ভারতের সঙ্গে তাদের জিআই বিরোধ আন্তর্জাতিক ফোরামে বহু বছর জিইয়ে রেখেছে। ইউরোপের দেশগুলোও তাদের জিআই স্বত্বের বিরোধ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরে। খামখেয়ালি করে দাবি ছেড়ে দেয় না। কারণ, এর সঙ্গে একটি দেশের ঐতিহ্য এবং অর্থনীতি গভীরভাবে জড়িত।


সাইয়েদ আবদুল্লাহ, সাবেক শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়