ঈদের জমকালো শাড়ি

যে কোনো উৎসবেই জামদানির আবেদন চিরন্তন
মডেল: শিরিন শিলা, শাড়ি: বেগম বাহার, টপ: যাত্রা, গয়না: কনক, সাজ: পিয়া’স বিউটি এসেনশিয়াল, ছবি: সুমন ইউসুফ

প্রতিটি ফ্যাশন হাউসের থাকে নিজস্ব ভাবনা, যেটা ফুটে ওঠে পোশাকের ওপর নকশা হিসেবে। ঈদের চেয়ে বড় কোনো আয়োজন নেই আমাদের এবার, তাই দেশি ফ্যাশনের ট্রেন্ড ঈদে সবচেয়ে ভালো বোঝা যায়। একই সময়ে একটি দেশের ভেতর একেক ডিজাইনার তাঁর ভাবনা একেকভাবে তুলে ধরেন। ফ্যাশনের এটাই মজা। একই কাটের টপ একেকভাবে উপস্থাপন করেন একেক ডিজাইনার। তাই ক্রেতারা এক দোকানের ডিসপ্লে থেকে আরেক দোকানে গেলে খুঁজে পান নতুন কিছু। একই কথা খাটে শাড়ির বেলাতেও। শাড়ি হয়তো একই স্টাইলে পরেন কমবেশি সবাই। কিন্তু নকশা থাকে ভিন্ন। ছয় গজের লম্বা কাপড়টির ওপর এবার ডিজাইনারদের ভাবনা কী, সেটা জানার চেষ্টা করা হয়েছে এ লেখায়।

উপকরণের সম্ভারে

চলতি ধারায় কোনো একটি বিশেষ নকশা কেন্দ্র করে শাড়ির নকশা করছেন না ডিজাইনাররা। এ কারণে ক্রেতারা জামদানি, মসলিন, কাতান, সুতি কিংবা সিল্কের ওপর খুঁজে পাচ্ছেন স্বতন্ত্র নকশা। বাজার ঘুরে দেখা গেল, রাজশাহী সিল্কের পাশাপাশি পিওর ক্রেপ সিল্ক, অ্যান্ডি সিল্ক, মলমল কাপড়, চান্দেরি, পাতলা খাদি, কোটা, তাঁত, জর্জেট ও শিফনের শাড়ি এবার কিনছেন ক্রেতারা। ১২ হাতের শাড়িতে কখনো একটি নকশা হয়তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলেছে। কখনোবা প্রথম নকশাটি থামিয়ে দিয়েছে দ্বিতীয় কোনো নকশা। কোনো কোনো শাড়ি দুটির বদলে তিন ধরনের নকশায় সাজানো হয়েছে।

মডেল: তাবিন্দা, শাড়ি ও গয়না: কনক
ছবি: প্রথম আলো

নকশার ভিড়ে

পুরো শাড়িতে পেটানো কাজ থাকছে। মসলিনের ওপর এ ধরনের কাজ থাকার সুবিধা হলো, শাড়ি পরার পর ফুলে থাকে না। শাড়ির ওপর এবার যে ধরনের নকশা দেখা যাচ্ছে, কয়েক মাস ধরে এসব নকশার দেখা মিলেছে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন রানওয়েতে। ফুলের নকশা তার মধ্যে একটি। বসন্ত চলে গেলেও আন্তর্জাতিকভাবে ফুলের নকশা এখনো জনপ্রিয়। এসব ফুলের গন্ধ না পেলেও উপস্থিতি ঠিকই টের পাবেন আপনি। আরেকটি বিষয় দেখা গেল, আশি ও নব্বইয়ের দশকের বেশ কিছু নকশা এ বছর ঘুরেফিরে আসবে, উপস্থাপন করা হবে নতুনভাবে—জানালেন কে ক্র্যাফটের প্রধান উদ্যোক্তা শাহনাজ খান। পাশাপাশি আছে স্ট্রাইপ আর পলকা ডটের নকশা।

এ দুটো নকশা যে একই সময়ে একই পোশাকের ওপর নিজেদের সৌন্দর্য তুলে ধরতে সক্ষম, সেটা ক্লাব হাউসের শাড়িগুলো দেখলে সহজে বোঝা যাবে। ক্লাব হাউস এবার তিন ভাগে দুই ধরনের উপকরণের শাড়ি তৈরি করেছে। শিফন শাড়িগুলো মূলত মোগড়া নামক সংগ্রহের। পেস্তাবাদাম আর সাদা রঙের মিশ্রণে করা শাড়িগুলোতে মেটালিক রুপালি রঙের স্ট্রাইপ নকশা দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে আছে পলকা ডটের নকশায় সাজানো ব্লাউজ। পাশাপাশি আশির দশকের গায়িকাদের পরা শাড়ি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সাজানো হয়েছে জর্জেটের শাড়ির সংগ্রহ।

জরির সূক্ষ্ণ কাজের শাড়ির সঙ্গে কেইপ, পুরো আভিজাত্যে মোড়া ঈদের সাজ
পোশাক: ড্রেসিডেল

মাঝে চুমকি লাগানো পোশাকের ধারা একেবারে চলে গিয়েছিল। চুমকি ব্যবহার করেও যে শাড়িতে অভিজাত ও রুচিশীল ধারা নিয়ে আসা সম্ভব, সেটা এখনকার ডিজাইনারদের না দেখলে বিশ্বাস হতো না। পুরো শাড়িতে চুমকির পেটানো কাজ থাকলেও দেখতে অতিরিক্ত লাগছে না; বরং হালকা রঙের চুমকি যখন পুরো শাড়িতে বিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে স্নিগ্ধতার আরেকটি উদাহরণ তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি শাড়িতে কাচের ব্যবহার এ বছর বৃদ্ধি পাবে। ছোট-বড় কাচ চারপাশে সুতা দিয়ে সেলাই করে বসানো হচ্ছে আরেকটি নকশার ওপরে।

টাঙ্গাইলের তন্তুজ শাড়িতে আরাম মিলবে সারা দিন
শাড়ি: টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির, ছবি: প্রথম আলো

কোনো শাড়িতে যখন নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়, কাজ করে অনেকগুলো মাধ্যম। প্রথমত, শাড়ি বুননের সময় কিছুটা নকশা বুনে দেওয়া হয়। সেটা শাড়ির শেষ প্রান্তের পাড় হোক কিংবা জমিনের ওপর ফুটে ওঠা কোনো নকশা। এর ওপর ব্লক বা স্ক্রিনপ্রিন্ট করা হচ্ছে। তার ওপর আবার করা হচ্ছে কারচুপি বা জারদৌসির কাজ। সব শাড়িতে এমন করা হচ্ছে, বিষয়টি তা নয়। কোনো কোনো শাড়ি সাজানো হচ্ছে শুধু একটি নকশায়, যেমন টাই–ডাই বা মোম বাটিক। চিকন পাড় দেওয়া সিল্ক, মসলিন কিংবা সুতির ওপর টাই–ডাইয়ের নকশা দেওয়া হচ্ছে। যেটা এ বছর আধুনিক তরুণীরাও কিনছেন।

আরেকটি নকশা এবার নজর কাড়ল। চার কোনা ঘর দিয়ে শাড়ি সাজাচ্ছেন অনেকে। এমনকি মিরপুরের বেনারসিপল্লিতে কাতান শাড়িতেও পাওয়া যাচ্ছে এমন নকশার শাড়ি। বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক ২০২৩–এর প্রথম দিন ডিজাইনার কুহু প্লামন্দনের শাড়িতেও চার কোনা ঘরের সঙ্গে ফুলের উপস্থাপনা ছিল দেখার মতো। কাতান শাড়ির মধ্যে হালকা নকশার শাড়িগুলো ক্রেতারা বেশি কিনছেন বলে জানালেন লা রিভের ডিজাইন অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ দলের ডেপুটি ম্যানেজার মারুফা ইয়াসমিন।

রেডিমেড শাড়ি এবারও দেখা যাবে। শাড়ি: কিউরিয়াস
ছবি: প্রথম আলো

‘আমাদের নিজেদের শাড়ি জামদানির কদর এই ঈদেও থাকবে। তবে সেখানে সমসাময়িক ধারার নকশা স্থান পাবে’—জানালেন কিউরিয়াসের প্রধান ডিজাইনার চন্দ্রশেখর সাহা। তিনি জানান, জামদানি শাড়িতেও দেখা যাচ্ছে নিত্যনতুন ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। ঐতিহ্যের জামদানি শাড়ির বয়ন ও নকশার শুদ্ধতা বজায় রেখে জমিন, আঁচল, পাড়ের কম্পোজিশনে আধুনিকতার গল্প রচনা করা হয়েছে। শাহজাদপুর, টাঙ্গাইল তাঁত, রাজশাহীর সিল্ক ও অ্যান্ডি দিয়ে বোনা শাড়ির ওপর আধুনিক সব নকশা জায়গা করে নিচ্ছে। কিউরিয়াসের শাড়িগুলো এবার ওয়াজেদ আলী শাহর লক্ষ্মী ঘরানার নকশা, পারসিয়ান মোটিফ, ইসলামিক মোটিফ, ফুলের নকশা, প্রাকৃতিক রং এবং ব্লক প্রিন্টের ছাপা নকশার অনুপ্রেরণায় অলংকৃত হয়েছে। যশোর ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের নকশিকাঁথার কাজ তুলে ধরা হয়েছে সিল্কের শাড়ির ওপর। শাড়ির ভুবনে আরও যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল প্রিন্টের আধুনিক সৌরভ। হাতে আঁকা নকশা, শিবোরিও আছে। শাড়ি বোনার সময় ভরনায় সুতার পাশাপাশি জরি সুতার ব্যবহার করেছেন অনেকে। শাড়িতে এবার জরির সূক্ষ্ম কাজ বেশি দেখা যাচ্ছে।

সেটা মসলিন হোক কিংবা সুতি। আরেকটি বিষয়, এবার শাড়ির আঁচলে টার্সেল ব্যবহার করার প্রবণতা বেড়েছে। মসলিন, সিল্ক, অ্যান্ডি সিল্ক, এমনকি বাদ যায়নি সুতির শাড়িও। পাশাপাশি আঁচলের শেষ প্রান্তে ফ্রিল ব্যবহার করা হচ্ছে।

রঙের ঘরে

এবার সাদা রঙের কাপড় বেশি দেখা যাচ্ছে। মহামারির পর এ বছর ঈদ সবার জন্য বেশ উল্লেখযোগ্য বলে মনে করছেন ডিজাইনাররা। এ কারণে শাড়ির ওপর উজ্জ্বল রং ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরা। হালকা রং যেমন মনের ভেতর শান্তি এনে দেবে, একইভাবে উজ্জ্বল রং উদ্দীপনা এনে দেবে উৎসবের দিনে। এটি হচ্ছে এবারের শাড়ির রঙে চলতি ধারা।

মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ। আর সেদিন বাঙালি নারী শাড়িতে সাজবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তাই ঈদ ফ্যাশনের চলতি ধারায় শাড়ির নকশা নিয়ে এবার যে অনেক নিরীক্ষা হয়েছে, সেটা যে কেউ স্বীকার করবেন। ঈদের দিন শাড়িতে সাজুন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রাঙিয়ে তুলুন সেই শাড়ি পরা ছবিতে।

লেখাটি প্রথম আলোর বিশেষ ম্যাগাজিন বর্ণিল ঈদ ২০২৩–এ প্রকাশিত