উৎসবে রংবেরঙের 'বউ'

আয়ুশ-নকশা বিয়ে উৎসবের সমাপনী দিনে ফ্যাশন শো। ছবি: সাইফুল ইসলাম
আয়ুশ-নকশা বিয়ে উৎসবের সমাপনী দিনে ফ্যাশন শো। ছবি: সাইফুল ইসলাম

স্কুটি চালিয়ে মঞ্চের নিচে এসে ঘ্যাচ করে ব্রেক কষলেন বউ। পেছনের আসনেই ছিলেন হেলমেট পরা বর। অ্যাকোর্ডিয়ানে বাজছিল ‘আমার গরুর গাড়িতে’ গানের সুর। স্কুটি থেকে নেমে তাঁরা গিয়ে ওঠেন বিয়ে উৎসবের মঞ্চে। বর-বউ সেজে বিয়ে উৎসবের বিশেষ আয়োজন উপস্থাপনা করেন মডেল ও অভিনেত্রী মুমতাহিনা টয়া এবং শিল্পী ইমরান মাহমুদুল। এমন চমক দিয়েই শুরু হয় আয়ুশ-নকশা বিয়ে উৎসব-২০১৮-এর আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে পর্বটি। তবে এখানেই শেষ নয়, বিয়ে উৎসবের এই পর্বে মঞ্চে এসেছিল রংবেরঙের বউ।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ওয়েসিসে শুরু হয় ‘আয়ুশ-নকশা বিয়ে উৎসব-২০১৮ ’। দুই দিন ধরে সেখানে চলে বিয়ের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে মেলা। উন্মুক্ত মাঠ ও খোলা আকাশের নিচের মঞ্চে সারা দিন বেজেছে বিয়ের গানবাদ্যি। শুক্রবার সন্ধ্যায় সেখানে রংপুরের বিয়ের গীত পরিবেশন করেছে আরশিনগর ও বাদশা আলমের দল। লোকগান গেয়েছে সায়েম, ইমরান। এ ছাড়া ছিল সমীর কাওয়ালের কাওয়ালি। সন্ধ্যায় আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য হোটেলের বলরুমে ছিল ফ্যাশন শো ও বিয়ের ভোজ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন ফ্যাশন ও বিনোদন অঙ্গনের তারকা ও বিশিষ্টজনেরা।

আয়ুশ-নকশা বিয়ে উৎসবের সমাপনী দিনে তরুণদের পাশপাশি শিশুদের ফ্যাশন শো। ছবি: সাইফুল ইসলাম
আয়ুশ-নকশা বিয়ে উৎসবের সমাপনী দিনে তরুণদের পাশপাশি শিশুদের ফ্যাশন শো। ছবি: সাইফুল ইসলাম

আলো ঝলমলে বলরুমে সরাসরি সানাই বাজিয়ে বিয়ের আবহ ধরে রেখেছিলেন শিল্পী মুর্তজা কবির মুরাদ। অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীন বলেন, ‘প্রথম আলো কেবল একটি দৈনিক পত্রিকার দায়িত্বই পালন করে না, পাশাপাশি বাংলার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে আরও আধুনিক ও রুচিশীল করে তুলতে কাজ করে। তারই একটি অংশ হিসেবে এই বিয়ে উৎসব। প্রতি সপ্তাহে আমরা প্রকাশ করি নকশার মতো ক্রোড়পত্র, সারা বছর প্রকাশ করি বর্ণিল কয়েকটি ম্যাগাজিন।’

মঞ্চে মজার খুনসুটি জুড়ে দেন বর-বউ সেজে আসা ইমরান ও টয়া। কবে বিয়ে করছেন তাঁরা? এমন প্রশ্ন উঠলে তাঁরা বলেন, তাঁরা দুজন কেবলই বন্ধু। আজ বর-বউ সাজলেও কখনোই একে অন্যকে বিয়ে করবেন না। একপর্যায়ে মঞ্চে আহ্বান করা হয় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে। তিনি বলেন, ‘যখন আমরা এ বিয়ে উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন ইতালির একটি দ্বীপে গিয়ে বিয়ে করে ফেললেন বলিউড তারকা দীপিকা পাড়ুকোন ও রণবীর সিং। সেটা শেষ হতেই আমরা দেখলাম প্রিয়াঙ্কা চোপড়া ও নিক জোনাসের বিয়ে। বিশ্বজুড়ে আলোচিত এক বিয়ে উৎসবের রেশ এখনো শেষ হয়নি। সেটা হচ্ছে ভারতীয় ধনী মুকেশ ও নীতা আম্বানির মেয়ে ইশা আম্বানির বিয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে সেই বিয়ের খাবার, কেক ও চকলেট এসেছে। বিশ্বের সেরা পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সেই বিয়ের পোশাক তৈরি করে দিয়েছে।

বিয়ে উৎসবের আলো ঝলমলে মঞ্চে তারকারা। ছবি: সাইফুল ইসলাম
বিয়ে উৎসবের আলো ঝলমলে মঞ্চে তারকারা। ছবি: সাইফুল ইসলাম

আমরা সেই খবরগুলো প্রকাশ করেছি, খুব আগ্রহ নিয়ে আমি সেই খবরগুলো পড়েছি। এত হইচইয়ের ভেতর ঢাকায় আমরা একটি বিয়ে উৎসবের আয়োজন করেছি। আমরা জানি, আমাদের দেশের বিয়ে উৎসবগুলো ক্রমশ আরও জমকালো হয়ে উঠছে। আবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার ধরনও একেক রকম। এ ছাড়া আদিবাসী, মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টানদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাও ব্যতিক্রম। এই বিয়ে উৎসের প্রতি আমাদের আগ্রহের কারণ, আমরা সব সময় চেয়েছি আমাদের দেশের বিয়েগুলো যেন দেশীয় সংস্কৃতিতে দেশীয় পণ্যের মাধ্যমেই হয়। এ বছর পঞ্চমবারের মতো এ আয়োজন করছি আমরা, ভবিষ্যতেও করব। এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বলব, আসুন, আমরা বিয়ের বাজার দেশেই করি। এই চর্চা ও অভ্যাস আমাদের মাঝে গড়ে উঠুক। কারণ, আমরা সত্যিকার অর্থেই সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজয় দেখতে চাই।’ এ আয়োজনের সঙ্গে থাকার জন্য ইউনিলিভারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন তিনি।

আয়ুশ-নকশা বিয়ে উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠান ‘গালা রাউন্ডে’ শুরুতে কোনালের বিয়ের গানের সঙ্গে দলীয় নাচ। ছবি: আবদুস সালাম
আয়ুশ-নকশা বিয়ে উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠান ‘গালা রাউন্ডে’ শুরুতে কোনালের বিয়ের গানের সঙ্গে দলীয় নাচ। ছবি: আবদুস সালাম

অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে ছিল সংগীত। ‘আজ কন্যার বিয়া’ গান নিয়ে মঞ্চে আসেন শিল্পী কোনাল। তাঁর গানের তালে তালে বর-বউ সেজে নাচ করে একদল তরুণ-তরুণী। প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা আমজাদ হোসেনের স্মরণে তাঁর চলচ্চিত্রের ‘আমি আছি থাকব’ গানের দুটি লাইন গেয়ে শোনান কোনাল। উপস্থাপক ইমরানও বাদ যাননি। গিটার বাজিয়ে ‘দিয়েছি তোকে দিল দিল দিল’ গানটি শুনিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া অনুষ্ঠানের শেষে ‘আমার প্রাণ ধরিয়া মারো টান’ গেয়ে শোনান চিরকুটের ইমন চৌধুরী।

ছবি তোলার জন্য বর-কনের বাহারি সাজ। ছবি: আবদুস সালাম
ছবি তোলার জন্য বর-কনের বাহারি সাজ। ছবি: আবদুস সালাম

প্রথম আলোর অনুষ্ঠানগুলোর মূল মঞ্চটি যেন হয়ে যায় দর্শকসারি। তাই সেখানকার প্রতিনিধিরাও বাদ যাননি। দর্শক সারি থেকে বিয়ে ও সংসার নিয়ে নিজেদের নানা অভিজ্ঞতার কথা বলেন বেশ কজন তারকা। কথা বলেন অভিনেতা আফজাল হোসেন ও তাজিন হালিম দম্পতি, কণ্ঠশিল্পী রফিকুল আলম ও আবিদা সুলতানা দম্পতি, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ ও বিপাশা আইচ দম্পতি, রূপসজ্জাকর ফারজানা মুন্নি, কণ্ঠশিল্পী তপন চৌধুরী, নায়িকা পপি প্রমুখ।

সাইদুজ্জামান রওশনের অণুকাব্য পরিবেশন। ছবি: আবদুস সালাম
সাইদুজ্জামান রওশনের অণুকাব্য পরিবেশন। ছবি: আবদুস সালাম

নাগরিক টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক জানান, স্বামী প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের সঙ্গে তিন দশকের সংসার ছিল তাঁর। ভালো বন্ধু ছিলেন তিনি। তিনি চলে যাওয়ায় স্বামীর অভাব যতটা না অনুভব করেন, তার থেকে বেশি অনুভব করেন বন্ধুর অভাব। রুবানা হক বলেন, ‘আমাদের দুজনেরই দ্বিতীয় বিয়ে ছিল এটি। দুজনেরই দুটি সন্তান ছিল। বিয়ের প্রথম রাতেই বিড়াল মারার মতো আনিস বলেছিল, আমার মা-বাবা ও পরিবারের কাউকে নিয়ে যেন কোনো কথা না বলি। আমি বুঝে গিয়েছিলাম, সে পরিবার–অন্তঃপ্রাণ মানুষ। ওই বাড়ির বড় বউয়ের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে আমাকে।’ নতুন দম্পতিদের উদ্দেশে রুবানা হক বলেন, ‘হৃদয়টাকে বড় করতে হবে। অনেক সমস্যা আসবে। বৈষয়িক কোনো ছোট বিষয়কে কেন্দ্র করে যেন পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধা তৈরি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।’

আয়ুশ-নকশা বিয়ে বিয়ের উৎসবের দ্বিতীয় দিনে নৃত্যদল ভঙ্গিমার দলীয় নৃত্য পরিবেশন। হোটেল সোনারগাঁও, ২১ ডিসেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম
আয়ুশ-নকশা বিয়ে বিয়ের উৎসবের দ্বিতীয় দিনে নৃত্যদল ভঙ্গিমার দলীয় নৃত্য পরিবেশন। হোটেল সোনারগাঁও, ২১ ডিসেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম

অনুষ্ঠানের শুরুতেই বউ সেজে সুরে সুরে মঞ্চে আসেন ইউনিলিভারের ব্র্যান্ড আয়ুশের পণ্যদূত মেহজাবিন চৌধুরী। তিনি জানান, প্রাকৃতিক হারবাল একটি পণ্যের দূত হতে পেরে দারুণ আনন্দিত তিনি। মঞ্চে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে আসেন বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় সেরা ত্রিশে থাকা বাংলাদেশের জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী। ফ্যাশন শো শুরুর আগেই বাদ্য আর আলোর ঝলকানি নিয়ে মঞ্চে আসেন এ অনুষ্ঠানের কোরিওগ্রাফার আজরা মাহমুদ। আর এ অনুষ্ঠানের জন্য একগুচ্ছ বউ সাজানো রূপসজ্জাকর কানিজ আলমাস খান মঞ্চে এসে জানান, কেবল বউ না, সব মানুষকে সাজাতেই ভালোবাসেন তিনি।

আয়ুশ-নকশা বিয়ে বিয়ের উৎসবের দ্বিতীয় দিনের বিকেলে সমীর কাওয়াল ও তাঁর দলের কাওয়ালি পরিবেশনা। হোটেল সোনারগাঁও, ২১ ডিসেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম
আয়ুশ-নকশা বিয়ে বিয়ের উৎসবের দ্বিতীয় দিনের বিকেলে সমীর কাওয়াল ও তাঁর দলের কাওয়ালি পরিবেশনা। হোটেল সোনারগাঁও, ২১ ডিসেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম

এ আয়োজনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশটি ছিল ফ্যাশন শো। সদ্য বিয়ে করেছেন—এমন সব তারকা জুটি আবহসংগীতের সুরে নিজেদের বিয়ের পোশাকে হেঁটেছেন মঞ্চে। এঁদের মধ্যে ছিলেন আয়ুশ-নকশা বিয়ে উৎসব ২০১৮-এর উদ্বোধক নাবিলা-রিম দম্পতি। শবনম ফারিয়া-অপু দম্পতি, সিয়াম-অবন্তী দম্পতি, বাপ্পা মজুমদার-তানিয়া দম্পতি। বিয়ের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগির পাশাপাশি সবার শুভ কামনাও চেয়েছেন তাঁরা।

বিয়ে উৎসবে গাইছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সায়েম। হোটেল সোনারগাঁও, ঢাকা, ২০ ডিসেম্বর। ছবি: দীপু মালাকার
বিয়ে উৎসবে গাইছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সায়েম। হোটেল সোনারগাঁও, ঢাকা, ২০ ডিসেম্বর। ছবি: দীপু মালাকার

বিয়ের অনুষ্ঠান কেবল বর-কনে দিয়েই হয় না; থাকে শালা-শালি ও তাঁদের বাচ্চারা। বর-কনে ছাড়াও তাদের নিয়েও ছিল একটি আলাদা ফ্যাশন শো। বিয়ের অনুষ্ঠানের পোশাকে আবহসংগীতের সঙ্গে মঞ্চে হেঁটেছে শিশু ও তারকা মডেলেরা। ফ্যাশন শোর শিশুদের পোশাক সরবরাহ করেছে নাবিলা, কনের পোশাক অপ্রিয়ানা এক্সক্লুসিভ ও ড্রেসিডেল, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির, নাবিলা ও বেনারসি কুঠি। গয়না কনক দ্য জুয়েলারি প্যালেস। বরের পোশাক সরবরাহ করেছে ওটু ও লুবনান। এদের সবাইকে সাজিয়েছেন নুজহাত খান ও পারসোনা।

দুই বছর আগে বিয়ে হয়েছে দ্বীপময় চৌধুরী ও মিটমিটি চক্রবর্তীর। তাঁরা ফের বর-বউ সেজেছেন। ছবি: মানসুরা হোসাইন
দুই বছর আগে বিয়ে হয়েছে দ্বীপময় চৌধুরী ও মিটমিটি চক্রবর্তীর। তাঁরা ফের বর-বউ সেজেছেন। ছবি: মানসুরা হোসাইন

বিয়ে উৎসব উপলক্ষে প্রতিযোগিতার জন্য আহ্বান করা হয়েছিল বিয়ের ছবি। দুই হাজার ছবি থেকে বাছাই করে তিন দম্পতির ছবিকে পুরস্কৃত করা হয়। প্রথম পুরস্কার ঢাকা-ব্যাংকক-ঢাকার বিমানের দুটি টিকিট পান ঢাকার পেশাজীবী দম্পতি জয়ন্ত দেবনাথ ও প্রিয়াঙ্কা দেবী। দ্বিতীয় পুরস্কার ঢাকা-কাঠমান্ডু-ঢাকা বিমানের দুটি টিকিট পান ঢাকার দম্পতি সৈয়দ মনজুরুল হক ও শামীমা নওশিন এবং তৃতীয় পুরস্কার ঢাকা-কক্সবাজার-ঢাকার বিমানের দুটি টিকিট পান রাজবাড়ীর দম্পতি মো. সাইফুল ইসলাম ও জুলিয়া আফরোজ। এ প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন রুপসজ্জাকর কানিজ আলমাস খান, আফরোজা পারভীন, আলোকচিত্রী চঞ্চল মাহমুদ ও আবীর আবদুল্লাহ, আক্কাস মাহমুদ, সুমন ইউসুফ।