এক বিস্ময়কর ফ্যাশন তারকা

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের প্রশংসাপত্রছবি: গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস

নারীদের দাড়ি–গোঁফ থাকে না এবং সেটাই স্বাভাবিক। আর কারও কারও খুব হালকা রেখার মতো খানিকটা থাকলেও থাকতে পারে। তবে তা সীমা ছাড়িয়ে পুরুষদের মতো দাড়ি-গোঁফ গজাতে শুরু করলে তখনই তা বিপত্তি ডেকে আনে। এমনই খুবই অনভিপ্রেত বিপত্তি ঘটেছিল হরনাম কৌর নামের শিখ বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এক বালিকার জীবনে।

হরনাম কৌর
হরনাম কৌরের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল

জন্ম ১৯৯০ সালের ২৯ নভেম্বর দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের বার্কশায়ারের স্লাও অঞ্চলে। তখন তাঁর মাত্র ১১ বছর বয়স। খুব মিষ্টি চেহারার এক কিশোরী। তবে এই বয়সেই কোমল, স্নিগ্ধ মুখখানি ঢেকে যেতে শুরু করে একরাশ অযাচিত শ্মশ্রুতে।

চিকিৎসকেরা বলে দিয়েছেন, বিরল ধরনের ‘‌পলিসিস্টিক ওভারি’‌ রোগের কারণেই এই বিপত্তি। তাঁরা রোগ নির্ণয়ের সঙ্গে আরও খানিকটা তথ্য জুড়ে দেন, তা হলো এমন হরমোনজনিত ব্যাধিতে ৫ থেকে ১০ শতাংশ নারী আক্রান্ত হতে পারেন।

হরনাম কৌর নিয়মিত দাড়ি-গোঁফ কামাতে শুরু করেও কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। লোকজনের সামনে যতটুকু পারেন মুখের কিছুটা অংশ হাত দিয়ে ঢেকে রাখতেন। তারপরও দাড়ি–গোঁফের আড়ালে মেয়েলি চেহারা হারিয়ে যেতে থাকলে জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। বিশেষ করে প্রতিদিন স্কুলের পথে পা বাড়াতে মোটেই মন চাইত না। কারণ, সহপাঠীদের নোংরা বিদ্রূপ, মানসিক ও শারীরিক নিপীড়ন, নিষ্ঠুরতা সকল সভ্যতা-ভব্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে দিন দিনই চরমে উঠতে শুরু করে। একপর্যায়ে তিনি স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দেন। এমনকি আত্মহত্যা করার কথাও ভাবেন।

অবাঞ্ছিত লোম বিড়ম্বনায় আত্মহত্যা করার কথাও ভাবেন হারমান
ছবি: গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস

শরীরের অবাঞ্ছিত লোম ঘন ঘন চেঁচে ফেলায় ত্বকের ক্ষতি হতে থাকে। হরনাম কৌর সিদ্ধান্ত নিলেন প্রকৃতি তাঁকে যেমনটি করে তৈরি করেছে, তা মেনে নিয়ে জীবন থেকে পালিয়ে নয়, সামনে থেকেই জীবনের মোকাবিলা করবেন। মা-বাবাকে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। তাঁরা মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেন। ভাবলেন, তাঁদের একান্ত আদরের মেয়েটির বিয়ে কিংবা চাকরি হবে না এবং সারাটি জীবন এমন এক অস্বস্তিকর ‘অস্বাভাবিকতা’ নিয়ে কাটাতে হবে।

অথচ ২০১৫ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে বিশ্বের কনিষ্ঠতম এবং দীর্ঘতম (৬ ইঞ্চি) শ্মশ্রুধারী নারী হিসেবে হরনাম কৌরের নাম গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পায়। তিনি এমন সম্মানে উজ্জীবিত হন, নিজের ওপর তাঁর আস্থা বেড়ে যায়।

জীবন থেকে পালিয়ে নয়, সামনে থেকেই মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নেন
ছবি: গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস

এরপর ২০১৬ সালে লন্ডনে রয়্যাল ফ্যাশন ডেতে বিখ্যাত গয়না নকশাকার মারিয়ানা হরুতুনিয়ানের ফ্যাশন শো চলাকালে হরনাম কৌর পৃথিবীর প্রথম শ্মশ্রুধারী নারী মডেল হিসেবে সবার নজর কেড়ে নেন। এর ফলে নামকরা সব সংবাদমাধ্যম ও ফ্যাশন পত্রিকার খবর হয়েছিলেন হরনাম। তিনি তাঁর লালিত স্বপ্ন পূরণের আনন্দে নিজের ইনস্টাগ্রামে ৫৪ হাজার অনুসারীকে জানিয়েছিলেন তাঁর জীবনের সাফল্য এবং সার্থকতার কথা। লিখেছিলেন, যারা তাঁকে ‘মোটা’ এবং দেখতে ‘বিশ্রী’ বলে নিগ্রহ করেছে, তারা নিশ্চয়ই এখন তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে।

হরনাম কৌর দেখলেন, তিনি শুধু একা নন, শারীরিক বা মানসিক গঠনের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কাজের জায়গায় এবং এমনকি নিজ পরিবারের মধ্যে অনেকেই তাঁর মতো নিপীড়নের শিকার। স্বাভাবিকের তুলনায় খানিকটা মোটা, কালো, খাটো বা লম্বা হলে অনেকেই অনেক রকম দায়িত্বহীন, নেতিবাচক মন্তব্য ছুড়ে দেয়, যা কিনা দীর্ঘ মেয়াদে কিশোর–তরুণদের মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়। এমন নিগ্রহ আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশেও চরম অন্তরায় ঘটায়। এর ফলে শুধু ব্যক্তিজীবনই নয়, সমাজ এবং দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

২০১৬ সালে পৃথিবীর প্রথম শ্মশ্রুধারী নারী মডেল হিসেবে সবার নজর কাড়েন
ছবি: হরনাম কৌরের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল

তিনি নিজে এমন ভুক্তভোগী বলেই তাঁর মনে দাগ কাটে এবং সে কারণেই আত্মবিশ্বাসে ভর করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি নীরব ঘাতকের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। এতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিনি বিপুল সাড়া পান। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে অনেক নারী তাঁদের জীবনের করুন কাহিনি, বিড়ম্বনার কথা তাঁকে জানান। তাঁদের অনেকেই তাঁকে দেখে, তাঁর উদ্যম, সাহসিকতা, সৌন্দর্য সম্পর্কে ধারণা জেনে, নতুন করে জীবন শুরু করতে অনুপ্রাণিত হন।

হরনাম কৌর বলেন, ‘আমাদের বুঝতে হবে যে আমরা প্রত্যেকেই একে অন্য থেকে আলাদা। আমরা কেউই নিখুঁত নই। সৌন্দর্যকে একভাবে দেখা বা বিচার উচিত হবে না। আমরা সবাই অনন্য এবং আমাদের স্বতন্ত্রতা আমাদের মহিমান্বিত করেছে। আমি সবার সামনে নিজেকে একজন আলাদা, আত্মবিশ্বাসী, বিচিত্র এবং দৃঢ়চেতা নারী হিসেবে তুলে ধরতে চাই। আর তাই দাড়ি আমার শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই তা কাটি না। বরং নিয়ম করে যত্ন নিই।’

নিজের শারীরিক অসংগতি ও প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করে এগিয়ে চলেছেন হারনাম
ছবি: হারনাম কৌরের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল

তিনি আরও বলেন, ‘অন্যের চোখে নিজেকে না দেখে নিজের চোখেই নিজেকে দেখা উচিত। পোশাক-পরিচ্ছেদ এবং সাজগোছ করতে নিজের ইচ্ছা, পছন্দকেই বেশি প্রাধান্য দিতে হবে।’ আর এ বার্তার প্রধান মর্ম হচ্ছে, আগে নিজেকে ভালোবাসতে হবে। জীবনে সুখ, আনন্দ, ভালোবাসার জন্য অন্য কারও ওপর ভরসা না করে নিজেকেই তা খুঁজে নিতে হবে।

হরনাম কৌর তাই-ই করেছেন। নিজের শারীরিক অসংগতি ও প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করে এগিয়ে গিয়েছেন। তিনি বর্তমানে একজন সেলিব্রেটি মডেলকন্যাই শুধু নন, অগণিত অবহেলিত, উৎপীড়িত নারী-পুরুষের জন্য একজন মডেল হিসেবে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছেন।