চল রে ‘চল’!

ট্রেন্ড শব্দের বাংলা অর্থ কী? একটু মাথা চুলকাতেই হবে। এই যেমন ধরা যাক প্রথা, ধারা বা চল। এভাবে সমশব্দ খুঁজতে খুঁজতেই জন্ম ফ্যাশন ব্র্যান্ড চল-এর। তারা ট্রেন্ডি পোশাক উপহার দিতে চায়। সে পোশাক হবে টেকসই ও নৈতিক; সমাজবদলের মাধ্যম।

চল-এর শীতসংগ্রহছবি: জাকিউল দ্বীপ
কারিগরদের ক্ষুধা আর বিষাদে ম্লান হয়ে যায় সেরা কাপড়ের সৌন্দর্যও
মহাত্মা গান্ধী

ট্রেন্ড শব্দের বাংলা অর্থ কী? একটু মাথা চুলকাতেই হবে। এই যেমন ধরা যাক প্রথা, ধারা বা চল। এভাবে সমশব্দ খুঁজতে খুঁজতেই জন্ম ফ্যাশন ব্র্যান্ড চল-এর। তারা ট্রেন্ডি পোশাক উপহার দিতে চায়। এখানে থেকে প্রসঙ্গান্তরে গেলে চল সম্পর্কে কিছুই জানানো হয় না।

আকৃতি বর্ণ আর লিঙ্গ নিরপেক্ষ পোশাক
ছবি: জাকিউল দ্বীপ

অথচ এরই মধ্যে কয়েকজন তরুণের ছোট্ট উদ্যোগ বাংলাদেশকে বিশেষভাবে গর্বিত করার প্রয়াস পেয়েছে। আর এই উদ্যোগের নাম চল। এটা যেমন-তেমন একটা ফ্যাশন ব্র্যান্ড নয়, বরং টেকসই ও নৈতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড। ফ্যাশন অনুরাগীদের পোশাকের মধ্যে দিয়ে সমাজ ও পরিবেশসচেতন করে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি ব্র্যান্ড। তবে গল্পটাকে এগিয়ে নিতে হলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে।

স্বপ্ন উদ্যোগ

চল টেকসই উদ্যোগ বর্ণ ও লিঙ্গ নিরপেক্ষ
ছবি: জাকিউল দ্বীপ

বদলে যাচ্ছে পৃথিবী। নানাভাবে মেরুকরণ হচ্ছে। সভ্যতার এই অগ্রগতির বিপরীতে বাড়ছে বিশ্বের বিপণ্নতা। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এমনই প্রেক্ষাপটে বছর দশেক আগে পটবদলের সদিচ্ছায় কয়েকজন তরুণ শুরু করেছিলেন তাঁদের স্বপ্ন উদ্যোগ ‘পারা’।

এঁরা সব সময়ই ভেবেছেন এবং গবেষণালব্ধ ভাবনার বাস্তবায়ন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন টেকসই যাপন আর উন্নয়ন নিশ্চিত করতে। প্রতিটি উদ্যোগেই তাঁরা সম্পৃক্ত করেছেন প্রান্তিক মানুষদের। পারা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাচ্ছিলেন রুহুল আবদিন।
পারার বেশির ভাগ উদ্যোগই টেকসই যাপন ও স্থাপত্যবিষয়ক। তবে ২০১২ সালে একটি ছোট উদ্যোগ ছিল তাদের ফ্যাশন নিয়ে। এই প্রকল্পের নাম ছিল ‘ফ্যাশন: অল সিল্ক ইয়ার্ডস অব বেনারসি’। এরপর গড়িয়েছে অনেক জল। পারা আবার ফ্যাশন নিয়ে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রথম প্রকল্প অবশ্যই ছিল নিরীক্ষামূলক। আর এবারের প্রকল্প স্থায়ী, যেখানে নিরীক্ষার সমান্তরালে চলছে বাণিজ্যিকভাবে পোশাক তৈরি ও বিক্রয়, বাজার সন্ধান ও বিস্তারের প্রক্রিয়া।

এবার ‘চল’

পারার নতুন এই প্রকল্প ‘চল’। এই প্রকল্পে কোলাবোরেটিভ ডিজাইনার হিসেবে আছেন শামা কুন। তিনি এথিকাল ও সাসটেইনেবল ফ্যাশন ও প্রোডাক্ট ডিজাইনার। ফ্যাশন রেভল্যুশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শামা সব সময়ই টেকসই ফ্যাশন নিয়ে কাজ করে আসছেন। তাঁর কাজেও এর প্রতিফলন ঘটে। বেশ কয়েক বছর তিনি ফ্যাশন হাউস ‘যাত্রা’র জন্য পণ্যনকশা করেছেন।

‘চল’ প্রকল্পের সূচনা-সংগ্রহের মূল ভাবনায় রয়েছে পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই ফ্যাশনের উপস্থাপন, পরিবেশ সুরক্ষা, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সুচিশিল্প এবং কাঁথাশিল্পকে মাধ্যম হিসেবে ফ্যাশনেবল পণ্য তৈরির উপাদানে পরিণত করা, একই সঙ্গে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর নারীদের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তাঁদের স্বনির্ভর করে তোলা ও ফ্যাশনে স্বচ্ছতা ও নৈতিকতাকে প্রতিষ্ঠা করা আর ফাস্ট ফ্যাশনকে নিরুৎসাহিত করা।

ফ্যাশন ব্র্যান্ড হিসেবে ‘চল’ সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়েই আত্মপ্রকাশ করেছে। ফলে তাদের উদ্দেশ্যই হলো পোশাকের মধ্যে দিয়ে মানুষকে ফ্যাশনেবল করে তোলার সমান্তরালের সচেতন করে তোলা। পাশাপাশি ফ্যাশন নিয়ে যে চলমান ধারণা রয়েছে, সেটা ভেঙে দেওয়া।

পরিবেশ বাঁচাতে পুনর্ব্যবহার

কড়াইল বস্তির নারীরা করছেন কাাঁথার কাজ
ছবি: জাকিউল দ্বীপ

কিন্তু শুরুতেই কাঁথা কেন? এমন প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। এ প্রসঙ্গে শামা বললেন, এ যেন একপ্রকার তাঁর শিকড়ে ফেরা। ছোটবেলায় দাদির দেওয়া কাঁথা তাঁকে বারবারই বাংলাদেশকে মনে করায়।

এই বিষয় নিয়েই আলোচনা এগোয়। বস্তুত বাংলাদেশের কাঁথা তৈরি ও ব্যবহারের চর্চা বহুদিনের। আর আজকে যে পুনর্ব্যবহার নিয়ে বিশ্ব উত্তাল, বাঙালির কাঁথা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এটাও তাঁরা মাথায় রেখেছেন। একই সঙ্গে কড়াইল বস্তির নারীদের এই কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে সমান্তরালে। তবে কাঁথা সেলাই বলতে নকশিকাঁথার যে সূক্ষ্ম সেলাই আমরা বুঝি, সেই সেলাই নয়, বরং সাধারণ ব্যবহার্য কাঁথার সেলাই বা রানিং স্টিচকেই ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে চল-এর অটাম-উইন্টার ২০২০ কালেকশন।

যেখানে বেসিক ম্যাটেরিয়াল হিসেবে নেওয়া হয়েছে পুরোনো শাড়ি; যা বেগমবাজার থেকে কিনে সেগুলোকে ভালো করে ধুয়ে তবেই ব্যবহার করা হয়েছে। এর সঙ্গে কিছু নতুন হ্যান্ডলুম শাড়ি, বাদ দেওয়া ডেনিম ম্যাটেরিয়াল আর লুঙ্গিও ব্যবহার করা হয়েছে এই সংগ্রহের ৩২টি পোশাক তৈরি করতে।

শামার সঙ্গে কথা বলার সময় প্রসঙ্গ অনুযায়ী খেই ধরিয়ে দিচ্ছিলেন শারারা খান। শারারা পেশায় একজন স্থপতি হলেও পারার একজন পরিচালক ও চল প্রকল্পের নেতৃত্বে রয়েছেন। পুরান ঢাকার বেগমবাজারের পুরোনো শাড়ির বাজার থেকে শাড়ি কেনার চমকপ্রদ গল্পও শোনালেন তিনি। বললেন, এই সংগ্রহের পোশাকগুলোতে শ্রেণি, পেশা, শরীরের গড়ন, ত্বকের রং এবং লিঙ্গ নিরপেক্ষতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দু-একটা পোশাক ছাড়া বাকিগুলো নারী-পুরুষনির্বিশেষে পরতে পারবেন। এমনকি ফ্যাশনের জিরো ফিগার স্টেরিওটাইপকেও ভেঙে ফেলা হয়েছে।

চল-এর শীত সংগ্রহ তৈরি হয়েছে টেকসই ফ্যাশনের আদর্শ অনুসরণে
ছবি: জাকিউল দ্বীপ

এই প্রকল্প শুরুর আগে তারা বিভিন্ন শ্রেণি, বয়স, লিঙ্গ ও পেশার অন্তত ১৫০ জনের মধ্যে জরিপও করেন। সেই ফলকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়েছে, বললেন শারারা।
জানা গেল, কিছুদিন আগে এই পোশাকগুলো নিয়ে একটা ফ্যাশন শো হয়, যেটাকে ক্যাটওয়াক বলতে নারাজ শারারা। বললেন, ফ্যাশন প্যারেড। আসলেই তাই। এই শোর জন্য পুরোনো শাড়ি দিয়ে কিছু মাস্ক তৈরি করে দেয় মামুনুর রহমানের প্রতিষ্ঠান এলা। এই প্রতিষ্ঠানও টেকসই বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকে। নিটের ঝুট থেকে তৈরি এলার মাস্ক এখন বিভিন্ন দেশেও যাচ্ছে।

যা হোক, পারার এই পোশাক তাঁদের জন্য, যাঁরা বিশ্বকে ফ্যাশন বর্জ্যের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত করতে চান, কমাতে চান কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ।

সূচনা-সংগ্রহ এবং…

দূষণমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্নে বিভোর চল
ছবি: জাকিউল দ্বীপ

তাঁদের এই হেমন্ত-শীত সংগ্রহ এরই মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে। ৩২টি পোশাকের মধ্যে রয়েছে ট্রেঞ্চকোট, বম্বার জ্যাকেট, জাম্পস্যুট, ব্লাউজ, টিউনিক, পেনসিল স্কার্ট, কিমোনো, কিমোনো কামিজ ও ট্রাউজার,পাফড স্লিভ কামিজ ও ট্রাউজার, হুডি কামিজ ও ট্রাউজার, বাইকার জ্যাকেট, পঞ্চো জ্যাকেট, ছেলে ও মেয়েদের ব্লেজার, রেট্রো ডেনিম, ক্রপড টপ ও হারেম প্যান্ট, টি-শার্ট, ছেলেদের শার্ট ও কুর্তা। কোনো কোনো পোশাক আবার দুদিকে পরা যাবে।

ফেসবুক (https://www.facebook.com/chol.store/) আর ইনস্টাগ্রামের (https://instagram.com/chol.fashion?igshid=ifnr5n1vtiz) মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে। আসছে সপ্তাহ থেকে ভার্চ্যুয়াল স্টোরেও (https://chol.paraa.org.uk/) পাওয়া যাবে চল-এর পোশাক।

তবে এই ৩২টি পোশাকেই শেষ নয়; বরং চল-এর এই ট্রেন্ডি পোশাক যে কেউ পছন্দ করে বানিয়ে নিতে পারবেন। আবার স্টকে থাকলে সরাসরি কেনাও যাবে। আসলে পুরোনো কাপড় তো একই রকম একাধিক পাওয়া যায় না; তাই কোনো পোশাকই একাধিক হবে না। বরং হুবহু একই ডিজাইনের পোশাক অন্য কাপড় দিয়ে বানিয়ে নিতে পারা যাবে, বললেন শামা, ফলে যে কেউ কাস্টম মেড পোশাক পেয়ে যাবেন।
জানালেন তাঁদের বিক্রয়-পরবর্তী সেবা সম্পর্কেও, পুরোনো কাপড়ে তৈরি। তাই ছিঁড়ে বা ফেঁসে যেতে পারে। তেমন হলে তাঁরা পোশাক রিপেয়ার করে দেবেন। তাতে আবার নতুন লুকও মিলবে। এ জন্য কেবল দিতে হবে যৎসামান্য অর্থ। যেটা পাবেন কারিগর বা সুচিশিল্পী।

সীমানা ছাড়িয়ে

লন্ডনের দুটি বিখ্যাত ডিপার্টমেন্ট স্টোর লিবার্টি ও সেলফরিজেজ বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছে
ছবি: জাকিউল দ্বীপ

এবারের কালেকশনের কয়েকটি পোশাক কতুর হয়ে গেছে বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন শামা। বাংলাদেশের মধ্যম ও উচ্চ আয়ের মানুষদের জন্যই এই পোশাক এখন তৈরি করা হচ্ছে। আর বিদেশি ক্রেতাদের কথাও মাথায় রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য আর কানাডা থেকে সাড়া পাওয়া গেছে। বিশেষত লন্ডনের দুটি বিখ্যাত ডিপার্টমেন্ট স্টোর লিবার্টি ও সেলফরিজেজ বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানা গেল। আসলে পণ্য নয়, এর গল্পটাই হৃদয়গ্রাহী। বিদেশি ক্রেতারা সেটাতেই আকর্ষিত হচ্ছে, জানালেন শামা।

এ ছাড়া এথিকাল ফ্যাশন ফোরামও তাদের বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী। ফ্যাশন রেভল্যুশনের ওপেন স্টুডিওতে এই সংগ্রহ প্রদর্শনের পরিকল্পনা তাঁদের আছে বলেও জানা গেল উভয়ের কাছে।

গল্প বলে ‘চল’

এভাবেই তৈরি হচ্ছে পোশাকে জীবনের গল্প
ছবি: জাকিউল দ্বীপ

বস্তুত চল-এর পোশাক তৈরির নেপথ্যে নৈতিক বিষয়ই বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এখানে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের কাজের সুস্থ পরিবেশ আর সঠিক মজুরিও নিশ্চিত করা হচ্ছে। একটা পোশাক তৈরির জন্য কাকে কত মজুরি দিতে হচ্ছে, কী পরিমাণ খরচ হচ্ছে উপকরণ সংগ্রহে, সবই তারা তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এভাবে একটি পরিবেশবান্ধব, জনবান্ধব টেকসই ও নৈতিক ব্র্যান্ড হিসেবে চল-কে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে।

ভাবনা পরম্পরা

টেকসই পোশাক
ছবি: জাকিউল দ্বীপ

এরই মধ্যে তাঁদের কথা হচ্ছে আরেকজন ফ্যাশন ডিজাইনারের সঙ্গে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার রুকিয়া বেগম। পরবর্তী প্রকল্প বা পরবর্তী সংগ্রহ হয়তো তিনি করবেন। এভাবে বিভিন্ন সময় দেশি-বিদেশি ডিজাইনারের সঙ্গে কাজ করবে চল।

আগামী ২০২৫ সালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্যের অন্তত ১৫ শতাংশ টেকসই পণ্য থাকতে হবে। এই নিয়ম চালু করতে যাচ্ছে জার্মানি। এই তথ্য দিয়ে শারারা বললেন, ‘আমরা সেই কাজটা আগে থেকেই শুরু করেছি। ফলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য আমরা মডেল এবং সহায়কও হতে পারি।’

নৈতিকতার সঙ্গে নান্দনিকতার সহাবস্থানেই সম্ভব যেকোনো উদ্যোগ কিংবা প্রক্রিয়ার টেকসই হয়ে ওঠা। ‘চল’-এ চলেছে সেই অভিমুখেই। একগুচ্ছ স্বপ্নময় তরুণের এই অভিযাত্রা পাবে অভীষ্ট লক্ষ্য। বাংলাদেশ হবে গর্বিত।