চিরায়ত শিল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ হ্যান্ডলুম টেক্সটাইল

তারামতি। গৌরাঙ্গের সর্বশেষ সংগ্রহ। ভার্চুয়ালি প্রদর্শিত হবে ২১ অক্টোবর, ল্যাকমে ফ্যাশন উইকেছবি: গৌরাঙ্গের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল

ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী সব বয়নশিল্পীকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিশেষভাবে সমাদৃত প্রখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার গৌরাঙ্গ শাহ। ২০ অক্টোবর শুরু ল্যাকমে উইকের আগে প্রথম আলোকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি নানা বিষয়ের সঙ্গে আলোকপাত করেছেন তাঁর এবারের সংগ্রহ তারামতী সম্পর্কে।

ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের পোস্টার
ছবি: গৌরাঙ্গের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল

প্রথম আলো: ‘ল্যাকমে ফ্যাশন উইক’ এবার ভার্চ্যুয়াল। প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রদর্শিত হবে আপনার সৃষ্টিকর্ম। এই ভার্চ্যুয়াল শো-র জন্য কি বিশেষ কোনো প্রস্তুতি নিতে হয়েছে?

গৌরাঙ্গ: ডিজিটাল মাধ্যমে উপস্থাপনা আমার কাছে নিশ্চয় এক নতুন এবং ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা। তবে পোশাক নকশার প্রক্রিয়া আমি আগেই শুরু করে দিয়েছিলাম। আশা করব আমার এবারের সৃষ্টিকর্মকে সবাই সাদরে গ্রহণ করবেন। আর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কারণে অনেক বেশি ফ্যাশন অনুরাগীদের কাছে পৌঁছে যাওয়ার ব্যাপারেও আমি আশাবাদী।

হস্তচিালিত তাঁতে বোনা শাড়ি। গৌরাঙ্গের সৃষ্টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য
ছবি: গৌরাঙ্গের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল

প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন যে বৈদ্যুতিক তাঁতের আগ্রাসনের যুগে ‘হস্তচালিত তাঁত’ বজায় থাকবে?
উত্তর: আমি মনে করি ‘হস্তচালিত তাঁত’ চিরায়ত শিল্পের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এই ধারা আজও আমাদের ভারতীয় ফ্যাশনের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। যেকোনো উৎসব এবং কনের পোশাকের ক্ষেত্রে আজও অনেকে হস্তচালিত তাঁতের বুনন বেছে নেয়। ডিজাইনাররা এখানে প্রতিনিয়ত নানান উদ্ভাবনের নেশায় মেতে থাকেন। আমরা ২০ জন বয়নশিল্পীকে নিয়ে এক সফর শুরু করেছিলাম। সেটা বেড়ে এখন ৮০০ জন হয়েছে। এই বয়নশিল্পীদের নিয়েই আমাদের বৃহত্তর পরিবার।। তাই আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, হ্যান্ডলুম কখনোই ম্লান হবে না।

প্রশ্ন: এবারের ল্যাকমে ফ্যাশন উইকে আপনার আয়োজনে কী কী বিশেষত্ব থাকছে?
উত্তর: এবারের ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আমার সংগ্রহের শিরোনাম ‘তারামতী’। গোলকোন্ডা যুগের হাতে বোনা শাড়ি নিয়ে আমার এই আয়োজন। গোলকোন্ডার সপ্তম সুলতান আবদুল্লা কুতুব শাহর সুন্দরী গণিকা তারামতীর দ্বারা অনুপ্রাণিত আমার এবারের সংগ্রহ। কেবল রূপে নয়, তারামতীর সুরেলা কণ্ঠের মৌতাতে মুগ্ধ ছিলেন সুলতান। তারামতীর মাধ্যমে আমি হায়দরাবাদের সেই হারিয়ে যাওয়া শিল্পধারাকে পুনরায় জীবন্ত করেছি। এই সংগ্রহে শাড়িতে ব্যবহার করা হয়েছে রেশম, রুপা, সোনাসহ আরও অনেক ধরনের সুতা। ফলে প্রতিটি শাড়িই হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয়। এই সংগ্রহের প্রতিটি শাড়ির মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক নতুন শিল্পকথা। বিভিন্ন কিংবদন্তি শিল্পকে আমি পুনরায় জীবন্ত করেছি। হ্যান্ড এমব্রয়ডারি, আরি, চিকনকারি, পেট-পয়েন্ট, কাসুটি, শিবোরি, কাঁথাস্টিচ, কচ্ছ, পার্সিসহ আরও অনেক কিছু অন্য রূপে ফিরিয়ে এনেছি, যা আগে কখনো কেউ দেখেনি।

প্রশ্ন: একজন ডিজাইনার টেকসই বিষয়কে কীভাবে বজায় রাখেন?
উত্তর: হাতে বোনা কাপড় মানেই তো সেটা সব সময় টেকসই। তবে এটা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো এই ধরনের ফ্যাশনের স্থায়িত্ব নির্ভর করে গ্রাহকের ওপর। নিত্যজীবনে তাঁরা কতটা ব্যবহার করেন, উৎসব বা বিয়েতে এই ধরনে পোশাককে কতটা অগ্রাধিকার দেন, সেটাও বিবেচ্য হয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে আনন্দের বিষয়, দীর্ঘদিন ধরে ডিজাইনাররা প্রথার বাইরে এসে হ্যান্ডলুম টেক্সটাইলকে ফ্যাশনের মূল স্রোতের অংশ করেছেন। দেশে, এমনকি বিদেশেও হ্যান্ডলুমের চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

গৌরাঙ্গের আগের সংগ্রহ
ছবি: গৌরাঙ্গের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল

প্রশ্ন: আপনি জামদানি বুনন নিয়ে কাজ করেন। ভারতীয় ও বাংলাদেশি জামদানির বুনন প্রক্রিয়াটির মধ্যে কি কোনো পার্থক্য রয়েছে?
উত্তর: আমার চোখে দুই দেশের পদ্ধতি এক, তবে বুননের ধরনটা আলাদা। আসলে বয়নশিল্পীদের আধুনিক শৈলী এবং পদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তা করার জন্য কেবল বুননের প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। এটি একটি বহুমুখী বয়নশিল্প। তবে বয়নশিল্পীরা এর বৈচিত্র্য সম্পর্কে প্রশিক্ষিত হয়ে উঠলে এটি ফ্যাশন বিশ্বে আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হবে।

প্রশ্ন: শিল্পী হিসেবে আপনি কীভাবে এই কোভিড পরিস্থিতির বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠলেন?
উত্তর: এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। আর এই পরিস্থিতি থেকে কেউই রেহাই পায়নি। তবে এই সময়টায় ব্যবসার জন্য আমাদের সামনে অনেক দরজা উন্মুক্ত করেছে নতুনভাবে। আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্মকে আরও বেশি করে ডিজিটাল আঙিনায় নিয়ে এসেছি। আমরা এক্সক্লুসিভ ই-স্টোর লঞ্চ করেছি। এখানে হাতে বোনা কাপড়ে তৈরি নানান পোশাক পাওয়া যাবে। সম্প্রতি আমি পুরুষ আর শিশুদের জন্য পোশাক লাইন নিয়ে এসেছি।

প্রশ্ন: এই চলমান মহামারি থেকে আপনি কি ইতিবাচক কিছু খুঁজে পেয়েছেন?
উত্তর: এটাই নতুন, এটাই এখন স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ। এটাকে এখন আমাদের সৃষ্টি এবং ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছি এবং আমরা একে আমাদের জীবন এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছি। অনলাইনের সাহায্যে আমরা অনেক সংযোগ গড়ে তুলতে পারছি। এই দুনিয়া আরও উন্মুক্ত হয়েছে।