নীল পোশাক শুধু ফ্যাশন নয়

ফ্যাশন হয়ে উঠুক অন্ত্রের ক্যানসারের বিরুদ্ধে সচেতনতার প্রতীক। প্রতীকী ছবিছবি: ম্যাথিউস বার্তেল্লি, পেকজেলস ডট কম

জীবনের কোনো না কোনো সময়ে নীল কাপড় পরেনি—এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া আসলেই দুষ্কর। নবজাতক শিশুটিকে মায়ের নিজে হাতে বোনা আকাশ–নীল উলের নরম পোশাকে জড়িয়ে নিই আমরা। কখনোবা প্রেয়সীর ঘন নীল শাড়ি-চুড়িতে নিজেকে হারাই। নীল শার্ট বা স্যুটে অমিত সম্ভাবনায় উদীয়মান গবেষক তাঁর গবেষণাপত্রটি সেমিনারে সবার সামনে তুলে ধরেন আরও সপ্রতিভভাবে।

জীবনের কোনো না কোনো সময়ে নীল কাপড় পরেনি—এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর
ছবি: কটনব্রো, পেকজেলস ডট কম

নীল রং মানেই সাফল্য, আশা, ভালোবাসা আর অমিত সম্ভাবনার প্রতীক। অসীম ও উদার নীল আকাশ আর অপূর্ব সুন্দর গভীর নীল সমুদ্র, প্রকৃতির মধ্যেই নীলের এই প্রাচুর্য আমাদের যুগে যুগে নীল বসনে নিজেকে সাজাতে শিখিয়েছে। নীল রংটিরও এত বিচিত্র ধরনের রূপ আর শেড আছে যে তা বিস্ময় সৃষ্টি করে। গভীর রাতের আকাশের রং মিডনাইট ব্লু, প্রাকৃতিক ইনডিগোর রাজকীয় রয়্যাল ব্লু, দিনের মেঘমুক্ত আকাশের আসমানি রং স্কাই ব্লু—এক নীলের সঙ্গে আরেক নীলের যেন কোনো মিলই নেই! আরও আছে জনপ্রিয় নেভি ব্লু, প্রুসিয়ান ব্লু, টারকোয়েজ বা ফিরোজা নীল, ইলেকট্রিক ব্লু ইত্যাদি।

নীল রঙের কাপড়ের ইতিহাস কিন্তু অত্যন্ত প্রাচীন। গবেষণাপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, মিসরীয়রাই প্রথম কাপড় রাঙানোর নীল রং আবিষ্কার করেছিল। মূলত, তারা খনি থেকে পাওয়া আজুরাইট বা ‘লাপিস লাজুরি’ নামের খনিজ মিনারেল চূর্ণ করে এই রং তৈরি করত। মূলত, আফগান অঞ্চলে এই খনিজ পদার্থ পাওয়া যায় প্রাচীনকাল থেকে। তবে ইউরোপে উয়োডগাছের পাতা গাঁজিয়ে, শুকিয়ে, পানিতে মিশিয়ে যেমন প্রাকৃতিক নীল রং পাওয়া যেত, এশিয়া ও আফ্রিকায় তেমন ইনডিগো থেকে পাওয়া যেত নীল রং। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে উয়োড চাষ বন্ধ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ‘নীল’ বা ইনডিগো চাষ করিয়ে তা থেকেই নীল রং তৈরি করা হতো। এর কুখ্যাত অত্যাচারের ইতিহাস সবারই জানা।

নীল রঙের কাপড়ের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন
ছবি: মাকরান্দ সাওয়ান্ত, পেকজেলস ডট কম

প্রথম দিকে কিন্তু নীল কাপড় শুধু সাধারণ মানুষই ব্যবহার করতেন। সমাজের উচ্চবর্গীয় লোকেরা বরং সাদা, কালো, বেগুনি, লাল ইত্যাদি রঙের পোশাক পরার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। এরপর দ্বাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সের রাজা নবম লুই, যিনি সেন্ট লুই নামে বেশি পরিচিত, তিনিই প্রথম এই নীল রংকে রাজকীয় মর্যাদা দেন। সমাজে তার প্রভাব এতই বেশি ছিল যে এই ক্ষমতাধর ও জনপ্রিয় রাজার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরবর্তী সময়ে এই নীল রংই পদমর্যাদা, উচ্চ সামাজিক অবস্থান ও আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে।

এরপর কৃত্রিম নীল ‘ডাই’ বা রঞ্জক পদার্থ আবিষ্কার হতে লাগল সব দেশে। সেই মিসরীয়রাই প্রথম চুনাপাথর, তুঁতে ইত্যাদি ক্ষারে গুলিয়ে নীল পেইন্ট বানালেও তা কাপড় রাঙানোর জন্য খুব একটা উপযোগী ছিল না। কৃত্রিম বা সিনথেটিক নীল রং উনিশ শতকের দিকেই ব্যবহার হওয়া শুরু হয়। স্যার উইলিয়াম হেনরি পারকিন নামক এক ব্রিটিশ রসায়নবিদ এনিলিন থেকে এই উজ্জ্বল নীল রং তৈরি করেন।

এরপর বাণিজ্যিকভাবে নীল কাপড় তৈরি হওয়ায় এ সময়ে নীল পোশাক ছেলে-বুড়োসহ সমাজের সর্বস্তরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সামরিক ও বেসামরিক ইউনিফর্মের ক্ষেত্রে বিশেষ করে নীল রং পছন্দের শীর্ষে চলে আসে। অনেক দেশে আদালত ও রাজদরবারের দাপ্তরিককাজেও কালোর বদলে নীল পোশাক পরার প্রচলন হয়। নীল রং তো এখন সবার পরনে দেখা যায়। নীল রঙের পোশাকে আভিজাত্য, সৌন্দর্য, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, মুক্তি ও শান্তি—এ সবকিছুই খুঁজে পাই।

কিন্তু বিশেষভাবে নীল রঙের পোশাক পরিধান করার মতো একটি দিবসের জন্ম হলো কেন? এর গোড়ায় ক্যানসারের মতো একটি ভয়ংকর রোগ নিয়ে সচেতনতার বিষয় জড়িত।

আনিতা মিচেল
ছবি: এক্সাক্টসায়েন্স ডট কম

প্রতিবছর মার্চ মাসের প্রথম শুক্রবার (এ বছর ৫ মার্চ) বিশ্বব্যাপী নীল পোশাক পরে অন্ত্রের ক্যানসার বা ‘কোলোরেকটাল’ ক্যানসারের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা চলে আসছে ২০০৯ সাল থেকে। আনিতা মিচেল নামের একজন মার্কিন নারী, যিনি নিজেই এই রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন এবং এই একই রোগে স্বজন হারিয়েছিলেন, তাঁরই অনুপ্রেরণা ও উদ্যোগের ফসল এই ‘ওয়্যারিং ব্লু ডে’ বা নীল পোশাক পরিধান দিবস।

সারা বিশ্বে এই অন্ত্রের ক্যানসারে শুধু ২০১৮ সালেই ১ দশমিক ৮ মিলিয়নের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন।

এ রোগে আক্রান্ত মানুষের এই সংখ্যা দিন দিন শুধু বেড়েই চলেছে। এটি যত ধরনের ক্যানসারে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে, তার মধ্যে পুরুষদের মধ্যে তৃতীয় ও নারীদের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। প্রক্রিয়াজাত ও জেনেটিক্যালি মোডিফাইড খাদ্য গ্রহণ, ব্যায়ামের অভাব, জীবনযাপনের অস্বাস্থ্যকর ধরন—এ সবকিছুকেই এই ক্যানসারের জন্য দায়ী করা হয়। তাই বিশ্বব্যাপী সবার মধ্যে এ বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্যই ফ্যাশনের মাধ্যমে পৃথিবীর সবার কাছে জীবন বাঁচানোর এই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য নীল পোশাক পরিধান দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অন্ত্রের ক্যানসারের বিরুদ্ধে সচেতনতার প্রতীক হয়ে উঠুক নীল রঙের পোশাক। প্রতীকী ছবি
ছবি: কটনব্রো, পেকজেলস ডট কম

নীল যেমন আনন্দের রং, ঠিক তেমন সেই নীল আবার বেদনার রং। এই নীল বেদনা অত্যাচারী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীলকরদের নীলকুঠিতে হাজারো নিপীড়িত কৃষকের নির্যাতনের গল্প বলে। আবার এই নীল বেদনা, রোগযন্ত্রণা আর স্বজন হারানোর অসহায় করুণ গাথাও বর্ণনা করে। নীল পোশাক পরিধান দিবসে আমাদের উদ্দেশ্য হোক সঠিক খাদ্যাভ্যাস আর স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন রীতির ব্যাপারে ব্যাপক সচেতনতা গড়ে তোলা। এতে অন্ত্রের ক্যানসারের মতো ভয়াবহভাবে বেড়ে চলা প্রাণঘাতী রোগটির প্রকোপ অনেকটাই কমিয়ে আনা যাবে পৃথিবীতে।