
পশ্চিমা পোশাক, দেশি ডিজাইনারদের হাতে পেয়েছে নতুন আকৃতি। ভারী মেকআপ ছেড়ে সহজাত বা ন্যাচারাল লুকেই মজে থাকা। চুলের স্টাইলে মুক্তা-পাথরের ব্যবহার বা চেনা শাড়িতেই নতুন নতুন নকশা। ছেলেদের পোশাকে প্রিন্টের ছড়াছড়ি। ভাত-ডালের পাশাপাশি পিৎজা, পাস্তা বা সু্যপ খেয়ে স্বাদ বদল। ঘরে তৈরি খাবার ছাড়াও বাইরে খাওয়ার ট্রেন্ড—এসবই ছিল ২০১৫ সালের পরিচিত জীবনধারা। বছরের শেষ দিকে এসে তাই একবার ফিরে দেখা যেতে পারে দেশের ফ্যাশন আর জীবনযাপনের এই দিকগুলো। ডিজাইনার শাহরুখ আমিন জানালেন, পুরো বছরই এবার রঙের খেলা প্রাধান্য পেয়েছে৷ পোশাক, গয়না, জুতা, ব্যাগ বা রোদচশমা—সবকিছুতেই সেটা দেখা গেছে৷ মূলত ষাটের দশকের ফ্যাশন ধারা ধরেই চলেছে পুরো বছর৷ সবকিছুতেই ঢোলা ও ওভার সাইজ বিষয়টা মাথায় রেখেছে৷ ফুলেল নকশার ছিল জয়জয়কার৷

জাম্প স্যুট, গাউন, ম্যাক্সি ড্রেসের মতো পোশাকগুলো দেশি ফ্যাশনে দাপিয়ে বেড়াল পুরো বছর। তবে সেটা হুবহু পশ্চিমা ধাঁচে নয়, ডিজাইন পাল্টে দেশে পরার উপযোগী করেছেন ডিজাইনাররা। ম্যাক্সি ড্রেসের ক্ষেত্রে কাপড়ে উজ্জ্বল রং ছিল। আর কোমরের দিকে দেখা গেছে রাবারের ব্যবহার। স্ট্রিং ও বেল্ট দিয়েও কোমর জুড়ে রেখেছে কোনো কোনো ড্রেস। সুতি, সিল্ক, অ্যান্ডি সিল্ক, খাদি, মসলিন, তাঁত, রেশমি ইত্যাদি কাপড়ের চাহিদা ছিল বছরের বিভিন্ন সময়ে। ঋতুভেদে পাল্টে গেছে এসব পোশাক। তবে সব ধরনের পোশাকেই ঢিলেঢালা ভাবটা ছিল। পাড়ওয়ালা শাড়ি চলেছে এই বছর। শাড়ির জমিনের সঙ্গে পাড় বা আঁচলে বিপরীত রং দেখা গেছে।

ব্লকপ্রিন্টের চল দেখা গেছে শাড়িতে। বাটিক, ভেজিটেবল ডাই, এমব্রয়ডারি, স্ক্রিনপ্রিন্টসহ নানা ধরনের কাজ চলেছে। অনেক শাড়ির আঁচল ও পাড়ে দেখা গেছে ভিন্ন ধরনের কাপড়ের যোগ। কামিজের ওপর কটি চলেছে। পালাজ্জো আর কুঁচির সালোয়ার ছিল চাহিদার শীর্ষে। ছেলেদের শার্টে নানা ধরনের প্রিন্ট চলেছে ষাটের দশকের মতো। টি-শার্টেও প্রিন্ট দেখা গেছে। জ্যামিতিক নকশা বা ডট প্রিন্ট ছিল বেশ জনপ্রিয়। বর-কনের বিয়ের পোশাকে এবার নানা ধরনের রং দেখা গেছে। অনেকেই সম্পূর্ণ লালের বাইরে এসে বেছে নিয়েছেন নীল, বেগুনি, কমলা, গোলাপি, সবুজ বা জলপাই রঙের পোশাক। টিউন ফিটের লম্বা পাঞ্জাবি চলেছে নানা উজ্জ্বল রং নিয়ে। শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে ব্লাউজ পরার মতো ধরাবাঁধা বিষয়টা এবার ছিল না।

সুন্দর কাট আর নিখুঁত ফিটিং হলেই হলো। হাতাকাটা, বোট নেক, হাই নেক, হল্টার কাট, লম্বা হাতার পাশাপাশি ঘটি হাতার ব্লাউজও দেখা গেছে। লেইসের ব্যবহার আর জমকালো কাপড় এমনই ট্রেন্ড দেখা গেছে ২০১৫ সালের ব্লাউজে। তবে শাড়ির সঙ্গে দেওয়া ব্লাউজের পিস দিয়ে তৈরি ব্লাউজ একদম চলেনি এবার। ব্লাউজে নানা রকম ঘণ্টা ও ঝুনঝুনি দেখা গেছে।
মেকআপ: নো মেকআপ লুক বা ন্যাচারাল লুক অর্থাৎ সহজাত চেহারা—এই ধারণাতেই পুরো বছর সেজেছেন মেয়েরা। তাই ত্বকের কাছাকাছি রং বেছে নিয়ে মেকআপ করতে দেখা গেছে। রূপবিশেষজ্ঞ তানজিমা শারমিন বলেন, ‘মেকআপে চলতি বছরে নতুন ধারণার পাশাপাশি পুরোনো দিনের সাজ দেখা গেছে সমানতালে। ঠোঁটে গাঢ় উজ্জ্বল রঙের পাশাপাশি চলেছে ন্যুড লিপস্টিক। উৎসবের দিনগুলো ছাড়াও কপার বা বাদামি টোনে চোখ সাজাতে দেখাতে গেছে মেয়েদের। এই বছর চোখের সাজে কাজলের ব্যবহার খুব একটা ছিল না। তার বদলে চোখের ভেতরের অংশে সাদা কাজল দিয়ে চোখটা বড় দেখানোর চেষ্টা লক্ষ করা গেছে। সীমার শ্যাডো ব্যবহার করে চোখ সাজানো হয়েছে ২০১৫ সালে।’


চুলের সাজে: নানা ধরনের মুক্তা-পাথর দিয়ে চুল সাজাতে দেখা গেছে মেয়েদের। গলার মালা দিয়ে চুল সেট করে নতুনত্ব আনা হয়েছে। বব কাটের চল ছিল শীত ও গরমের দিনগুলোতে। তবে সেটার ধরনে দেখা গেছে ভিন্নতা। লেয়ারে লেয়ারে বব কাটে চুল ছেঁটেছে মেয়েরা। কার্ল, স্পাইরাল, লুজ বান ইত্যাদি স্টাইল দেখা গেছে ছোট চুলের মধ্যে।
মেয়েদের পাশাপাশি চুলের স্টাইলে কম যায়নি ছেলেরা। ছেলেদের হেয়ার স্টাইলে অবশ্য দেশি-বিদেশি খেলোয়াড় ও অভিনেতাদের প্রভাব দেখা গেছে বেশি। বিশ্বকাপ চলাকালে সাকিব আল হাসানকে দেখা যায় নতুন হেয়ার স্টাইলে। এরপর তা দেখা গেছে সারা দেশের তরুণদের মাথায়।
অনুষঙ্গ: ক্যাটস আই, ক্লাব মাস্টার, মার্কারি রোদচশমা চলেছে বছরজুড়ে। রিস্টব্যান্ড ঘড়ি, চুড়ি, নেইল আর্ট, অলংকারের মতো ব্রোচ পরতে দেখা গেছে মেয়েদের। কানের বাইরের অংশে কাফ পরেছেন ফ্যাশন-সচেতন মেয়েরা। এ ছাড়া নানা রকম আংটি, পাথরের ক্লিপ, বটুয়া, ক্লচ ব্যাগ, বড় ডায়ালের হাতঘড়ি, নানা ধরনের ছবি, স্লোগান বা ইমোটিকনযুক্ত ব্যাজের চল ছিল তরুণ-তরুণীদের কাছে।

গয়না: নানা ধরনের ধাতব গয়না ছিল এ বছর হিট তালিকায়। সেই সঙ্গে কাপড়ের তৈরি গয়না চলেছে এবার। নেকলেসটা পরতে দেখা গেছে গলাজুড়ে।
জুতা: নানা ধরনের উপকরণে তৈরি জুতা পরতে দেখা গেছে ছেলে ও মেয়েদের। আবহাওয়া বুঝে হালকা ও পুরু জুতা বেছে নিয়েছেন অনেকে। ছেলেদের ক্যাজুয়াল মোকাসিনে নানা ধরনের নকশা ও রং দেখা গেছে। মেয়েদের ক্ষেত্রেও একই।

খাবার: খাবার নিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতূহল বেড়েছে। বাসায় অতিথিকে নিজে রেঁধে খাওয়ানোর মতো আয়োজন দেখা গেছে সারা বছর। ঘরের বাইরে রেস্তোরাঁয় পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে খেতে গেছেন অনেকে। বড় বড় শহরে তাই বেড়েছে রেস্তোরাঁর সংখ্যা। নানা ধরনের রান্নার প্রতিযোগিতার আয়োজন চলেছে বছর জুড়ে।

নানা ধরনের আয়োজন: বছরের শুরু থেকেই নানা ধরনের পোশাকের নকশা, অন্দরসজ্জা, ছবি তোলা, বনসাই তৈরি, পোষা প্রাণী, সৌন্দর্যচর্চা, ডায়েট কাউন্সেলিং ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সেমিনার, প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনীর আয়োজন ছিল। ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর মণিপুরিপাড়ায় আয়োজন হয় হস্তশিল্প মেলা। বছরের নানা সময়ে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মেলা, তাঁতবস্ত্র মেলা, জামদানি শাড়ির প্রদর্শনী, আসবাব মেলা, কাবাব উৎসব, বিরিয়ানি ফেস্ট, আইসক্রিম উৎসব, ঢাকা ফুডিজের আয়োজনে সেহ্রি নাইট, বার্গার ফেস্ট, পরিবেশবান্ধব পণ্য নিয়ে যাত্রা আয়োজন করে মাটির মেলা। লাক্সের এক আয়োজনে এবার প্রথম ঢাকায় আসেন বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন, এভারেস্ট একাডেমি আয়োজন করে পর্বত আরোহণ ও প্রতিকূল আবহাওয়ায় টিকে থাকার প্রশিক্ষণ, বিবিয়ানা ফ্যাশন হাউসের আয়োজনে জুন মাসে আয়োজন হয় ‘সিম্ফনি অব নিডল ওয়ার্ক ২০১৫’, সাদাকালো আয়োজন করে ‘সাদাকালো ইন কিউবিজম আর্ট’, সৌন্দর্যসেবা নিয়ে কাজ করেন বা লেখেন এমন নারীদের গ্রুপ পপ অব কালারের আয়োজনে ঢাকায় আয়োজন হয় এক মিলনমেলা। সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলীয় দূতাবাসে আয়োজন হয় কারুশিল্প নিয়ে মেলা ঢাকা ক্র্যাফট বাজার। ডেনিম নিয়ে প্রদর্শনী ছাড়াও চলতি মাসে ঢাকায় ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের আয়োজনে দেশি-বিদেশি ডিজাইনারদের নকশা করা খদ্দর নিয়ে আয়োজন করা হয় দুই দিনের খাদি উৎসব।