ফ্যাশনে দিগ্‌বিজয়ী নারীরা

ছবি: ল্যাকমে ফ্যাশন উইকে

বিশ্বব্যাপী ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে বিগত শতকের শুরুর দিকে, তার পেছনে অসামান্য অবদান আছে ফ্যাশন সচেতন নারীদের। বিগত শতকগুলোতে নারীরা যখন চারদেয়ালের বাইরে বেরিয়ে কর্মশক্তিতে পরিণত হলেন, তখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় সব ঘটনা ঘটে যেতে থাকল। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিও বাদ গেল না। সে সময় অর্থনৈতিক মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে পোশাকেও মুক্তি আর শক্তির প্রতীকী উপস্থাপনা তুলে ধরতে লাগলেন ফ্যাশন ডিজাইনাররা। নারীর মুক্তি, জাগরণ আর ক্ষমতায়নের সঙ্গে ফ্যাশনের আছে ওতপ্রোত সম্পর্ক।

কোকো শ্যানেল (১৮৮৩-১৯৭১)

কোকো শ্যানেল
ছবি: কোকো শ্যানেল

নারী নেতৃত্বে ফ্যাশন বিপ্লবের ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে কোকো শ্যানেলের নাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে নারীর পোশাকে অবাক করা পরিবর্তন এনে নিজের ফ্যাশন হাউস শ্যানেল চালু করেন ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার কোকো শ্যানেল। তিনিই প্রথম নিখুঁত শারীরিক মাপের করসেট বা বন্ধনীর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়ে নারীদের জন্য আরামদায়ক, বাস্তবতাবোধসম্পন্ন, সহজাত ও স্বাভাবিক জামাকাপড় ডিজাইন করার ব্যাপারে ব্রত নিয়েছিলেন। তাঁর লিটল ব্ল্যাক ড্রেস, খোলামেলা পোশাকের ওপরে পরা টুইড জ্যাকেট ইত্যাদি ছিল নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রে একেকটি মাইলফলক। তিনি নারীদের কর্মক্ষেত্রে প্যান্ট–স্যুটের প্রচলন শুরু করেছিলেন। জার্সি বা ভিস্কোস কাপড়ে পোশাক ডিজাইন করাও তাঁর এক অনন্য পদক্ষেপ ছিল। নারীদের বনেতের বদলে হ্যাটের ব্যবহার শুরু করা অনেকটা শানেলেরই কীর্তি। তাঁর ডিজাইনগুলোকে বলা হতো ফিউচারিস্টিক বা ভবিষ্যৎকামী।

ভিভিয়েন ওয়েস্টউড (জন্ম: ১৯৪১)

ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের মাধ্যমে প্রথা ভাঙার গল্প বলতে গেলেই ভিভিয়েন ওয়েস্টউড হবেন সেই গল্পের নায়িকা। ইংরেজ এই ফ্যাশন ডিজাইনার ফ্যাশনকে ঢেলে সাজিয়েছেন বিশ্বের সামনে। তাঁর ডিজাইনে সত্তর দশকের পাংক কালচারের প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। ছেঁড়া–ফাটা জিনস, বড় বড় আপাত দৃষ্টিকটু তালি মারা বা কাপড়ের ওপরের দিক হতেই দৃশ্যমান সেলাই করা ব্যাগি ট্রাউজার, এমন সব অদ্ভুতুড়ে পোশাকের প্রবক্তা ভিভিয়েন। বিদ্রোহী, মারমুখী এই ফ্যাশনের ধারাকে তিনি উপস্থাপন করেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য সেক্স’ নামের ফ্যাশন হাউসের ট্রেডমার্ক অ্যান্টি ফ্যাশন নামে।

ভিভিয়েন ওয়েস্টউড
ছবি: সংগৃহীত

সত্তর ও আশির দশকের বিভিন্ন পাংক ও রক মিউজিক ব্যান্ডের সদস্যরা তাঁর এমনতর বল্গাহারা মনোভাবের পোশাকের ধারণাটি লুফে নিয়েছিলেন। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি রাতারাতি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ফ্যাশনে নবধারার প্রবর্তক হয়েছে। তিনি পশ্চিমা সমাজের বিয়ের পোশাকেও ব্যাপক বিবর্তন আনেন। ভিক্টোরিয়ান গাউনের বদলে আধুনিক পোশাকে বিয়ের কনেরা সাজতে শুরু করেন তাঁরই প্রভাবে। তিনি নিজের বিয়ের ড্রেসও নিজেই ডিজাইন করেছিলেন। বাঁধা না মানা, নিয়ম–অনুশাসনের কড়াকড়ি ভেঙে চুরে তারুণ্যের জয়গান গাওয়া ভিভিয়েন তাই তো সব আধুনিক ফ্যাশন ডিজাইনারের কাছেই অনুসরণীয়।

রেই কাওয়াকুবো (জন্ম: ১৯৪২)

রেই কাওয়াকুবো
ছবি: উইকিপিডিয়া

জাপানি বংশোদ্ভূত ফ্যাশন ডিজাইনার রেই কাওয়াকুবোর খ্যাতি ফ্যাশনের সূতিকাগার প্যারিস অবধি মাতিয়ে দিয়েছে। ‘কম্ম দে গারসোঁ’ নামে তাঁর ফ্যাশন হাউসটি তারুণ্যের জয়গান গেয়েছে বরাবর। প্রথাগত ফ্যাশনকে ভেঙেচুরে ডি কনস্ট্রাক্টেড গাউনের প্রচলন করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর কাজে কখনই শিল্পের নামে অবাস্তব বা অস্বস্তিকর পোশাক পাওয়া যায় না। কালো রং নিয়ে কাজ করতে পারদর্শী এই ডিজাইনার পোশাকে অতিনারীসুলভ ছোঁয়া আনেননি কোনো দিন। হালের জেন্ডার ফ্লুইড পোশাক তাঁরই অবদান।

ডোনা ক্যারান (জন্ম: ১৯৪৮)

ডোনা ক্যারান
ছবি: উইকিপিডিয়া

এ যুগের নারী সবকিছুতেই পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে অংশ নিচ্ছেন। তাই তো ফ্যাশন এখন শুধু চোখের সৌন্দর্য দিলেই হয় না, কাজে লাগার উপযোগী ও আরামদায়ক হতে হয়। অ্যাথলেটিক আর স্পোর্টি ফ্যাশনের ক্ষেত্রে আমেরিকান ফ্যাশন ডিজাইনার ডোনা ক্যারান শক্তিশালী ভূমিকা রাখছেন। সহজে পরিধেয়, রাত–দিননির্বিশেষে পরা যায়, এমন আন্তর্জাতিক আবেদনসম্পন্ন পোশাক ডিজাইনে ডোনার জুড়ি মেলা ভার। বর্তমান সময়ের ক্রেজ নিটওয়্যার আর নেট ফ্যাব্রিকে তাঁর কাজগুলো সবার কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ডিকেএনওয়াই নামে তাঁর ফ্যাশন লেবেল এখন বিশ্বব্যাপী কর্মক্ষেত্রে পরার ওয়ার্ক ওয়্যার এবং ক্যাজুয়াল পোশাকের ক্ষেত্রে অনন্য এক নাম।
ফ্যাশন শুধু কাপড় বা অলংকার নয়। ফ্যাশনে ফুটে ওঠে ব্যক্তিত্ব, আত্মবিশ্বাস। ফ্যাশন আমাদের স্বপ্ন দেখতে শেখায়, উঠে দাঁড়াতে শেখায়, সফলতার কাছে নিয়ে যায়। ফ্যাশনে দিগবিজয়ী এই নারীদের আজকের দিনের নারীজাগরণের প্রতীক বললে একটুও ভুল হয় না।

মিউসিয়া প্রাদা (জন্ম: ১৯৪৯)

মিউসিয়া প্রাদা
ছবি: উইকিপিডিয়া

অসামান্য রকমের বিখ্যাত ইতালিয়ান প্রাদা ফ্যাশন হাউসের মালিক মারিয়া প্রাদার ছোট নাতনি মিউসিয়া প্রাদা এখন প্রাদার প্রধান ডিজাইনার। কোকো শ্যানেল যেমন করসেট থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন নারী সমাজকে, মিউসিয়া তেমনি বাধ্যতামূলক অস্বস্তিকর স্টিলেটো হিলকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে প্ল্যাটফর্ম হিল বা ব্লক হিল পরান তার মডেল ও গ্রাহকদের। প্রথাগত সুন্দরের বাইরে গিয়ে মনমতো আরামদায়ক পোশাকই তাঁর ডিজাইনের বিশেষ দিক। শুধুই খুব নারীসুলভ পরিপাটি ফ্যাশনের ঘোর বিরোধী মিউসিয়া। ১৯৯০–এর দশকে তিনি আগলি শিক নামের একটি বিপ্লবী লাইন আনেন তাঁর ফ্যাশন হাউসে। এখানে তথাকথিত সুন্দরকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মুক্তির আনন্দে নিজের মতো করে নিজস্ব ফ্যাশন ধরে রাখার কথা বলা হয়েছে।

দোনাতেল্লা ভারসাচি (জন্ম: ১৯৫৫)

দোনাতেল্লা ভারসাচি
ছবি: উইকিপিডিয়া

ফ্যাশান বিশ্বের সফল নারীদের একজন দোনাতেল্লা ভারসাচি। বড় ভাই জিয়ান্নি ভারসাচির মৃত্যুর পরে ভারসাচি ফ্যাশন সাম্রাজ্য তিনি একাই সামলাচ্ছেন। ইতালিয়ান এই ফ্যাশন জাদুকর নারী উজ্জ্বল রং, চোখধাঁধানো ঝলমলে ফেব্রিক নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। স্ট্রিট স্টাইল ফ্যাশনকে তিনি অভিজাত রূপ দিয়েছেন আপন প্রতিভায়। মানবাধিকার রক্ষা, ক্যানসার সচেতনতা, প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতাবিরোধী আন্দোলন- মানবকল্যাণের প্রায় সবদিকেই দেখা যায় তাঁর সরব উপস্থতি।