৭৪তম কান চলচ্চিত্র উৎসব
বাঁধনের কান লুক এবং আড়ংয়ের জামদানি
বর্তমানে দেশজুড়ে ইতিবাচক আলোচনাগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ‘রেহানা মারিয়াম নূর’ ছায়াছবি এবং এর কুশীলব। তাঁদের মধ্যে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করেছেন ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয়কারী আজমেরী হক বাঁধন। বাংলাদেশের বয়ন ঐতিহ্য জামদানিকে তিনি দিয়েছেন বিশেষ মর্যাদা। তাঁর পোশাক আর লুক তৈরির ইতিবৃত্ত ও তাঁর প্রতিক্রিয়া নিয়ে এ নিবন্ধ সাজিয়েছেন শেখ সাইফুর রহমান ও জিনাত শারমিন।
ভূমধ্যসাগরের তীরে ফ্রান্সে কান চলচ্চিত্র উৎসবের মূল ভবন প্যালে ডে ফেস্টিভ্যাল। ৭ জুলাই, বাংলাদেশ সময় বিকেল পাঁচটা। বিশাল স্ক্রিনে চলছে ক্রেডিট লাইনস। হলভর্তি দর্শক দাঁড়িয়ে পড়েছে, হাততালির থামাথামি নেই। সেই হলের মধ্যমণি আজমেরি হক বাঁধন তখন কাঁদছেন। সেই কান্না দেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্তকেই ইঙ্গিত করে। উদ্বোধনী প্রদর্শনী হলো বাংলাদেশের সিনেমা ‘রেহানা মারিয়াম নূর’–এর।
প্রথমবারের মতো কানের অফিশিয়াল সিলেকশনে আঁ সার্তেঁ রিগায় সিনেমাটি দেখানো হয়। ওই দিন বাঁধন পরেছিলেন জামদানি। ফ্রান্স থেকে বাঁধনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে বহুল আলোচিত ও প্রশংসিত সেই শাড়ি আর তাঁর ওই দিনের সাজ নিয়ে। এরই ফাঁকে শাড়ি, ব্লাউজ আর গয়না নিয়ে বিস্তারিত জানা হয়েছে দেশের জনপ্রিয় লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড আড়ংয়ের কাছ থেকে।
এই সাজ ও পোশাক মিলিয়ে যে লুকটা বাঁধন তৈরি করেছেন, এর কৃতিত্ব অবশ্যই তাঁর। কারণ, এ ধরনের একটি মর্যাদাপূর্ণ অনুষ্ঠানে জামদানি পরার আগ্রহটা তিনিই পোষণ করেন। এর সঙ্গে ছিল আনুষঙ্গিক বিষয়। পুরো আইডিয়া আড়ংয়ের সঙ্গে শেয়ার করলে তারা বাঁধনকে এ ব্যাপারে সর্বতো সহায়তা করেছেন।
আজমেরী হক বাঁধন লালগালিচায় আমাদের জামদানির ঐতিহ্যকে তুলে ধরে গোটা বাংলাদেশকেই গর্বিত করেছেন বলে মনে করেন আড়ংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তামারা হাসান আবেদ। তিনি বলেন, ‘কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে বাঁধনকে সাপোর্ট করতে পেরেছি। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বয়ন ঐতিহ্য জামদানি বয়নশিল্প নিয়ে দেশ ও বিদেশের মানুষের মধ্যে দারুণ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য আমরা দারুণ আনন্দিত।’
আড়ং যে জামদানি শাড়ি তৈরি করে দিয়েছে, সেটি নানা কারণে গুরুত্ববহ। কারণ, শাড়িটি তৈরি হয়েছে সোনারগাঁয়ে। ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফটস কাউন্সিল এ উপজেলাকে ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফট সিটির মর্যাদা দিয়েছে। শাড়িটি হাফসিল্ক জামদানি। অর্থাৎ, এ শাড়ি তৈরি হয়েছে সিল্ক ও সুতি সুতায়। শাড়ির টানায় দেওয়া হয়েছে সিল্কের সুতা আর বানায় দেওয়া হয়েছে ১০০ কাউন্ডের সুতি সুতা। নিখুঁত এ বয়ন আমাদের দেশের জামদানি বয়নশিল্পীদের পক্ষেই করার সম্ভব।
এই শাড়ির জমিন, পাড় ও আঁচলে রয়েছে নানা ধরনের মোটিফ, যেগুলো সোনালি জরির সুতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ শাড়ির পাড় হলো শাল ও ইঞ্চি পাড়। সেখানে রয়েছে রাখনলী ফুলের মোটিফ। আঁচলজুড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সুরমাদানি গাছ মোটিফ। এ মোটিফ আবার নানা নামে পরিচিত। কেউ বলেন বাঘের পাড়া আবার কেউ বলেন ইয়ারিং ফুল। এ ধরনের শাড়ি বুনতে টানায় অন্তত ২২০০ থেকে ২৪০০ বা তার বেশি সুতা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে এই শাড়িতে ধারণা করা যায় অন্তত ২৪০০ সুতা ব্য়বহার করা হয়েছে। এটাকেই বয়নশিল্পীরা তাঁদের ভাষায় ২৪০০ সানা বলে থাকেন।
হালকা জলপাই রঙের এই হাফসিল্ক জামদানি শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে ব্লাউজ। শাড়িটি তৈরি করতে বয়নশিল্পীরা তিন মাস সময় নিয়েছেন বলে জানিয়েছে আড়ং। এ শাড়ি ছাড়াও বাঁধনের টোটাল লুকের একটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল গয়না। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের গয়নাশিল্পীদের মুনশিয়ানা।
কারণ, শাড়ি ও ব্লাউজের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি পরেছিলেন রুপার গয়না। বাংলাদেশের অলংকারশিল্পীদের সুনিপুণ দক্ষতায় হাতে তৈরি এ গয়না বিশেষত একটি চোকার; যার আকর্ষণ হলো পাথর বসানো প্রসারিত অংশটি, যেটা পিঠের মাঝ বরাবর নেমে গিয়ে ব্লাউজের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে।
আর সাজের পুরো কৃতিত্বই তাঁর নিজের। তিনি মেকআপের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। তা ছাড়া কোনো মেকআপ আর্টিস্ট এখান থেকে নিয়ে যাওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব যেমন ছিল না, তেমনি ওখানে কাউকে দিয়ে মেকআপ করানোর ঝুঁকিটাও তিনি নিতে চাননি। বরং তিনি নিজের মতো করেই ঠিক করেছেন নিজের মেকআপ আর হেয়ার। তিনি বাঙালি হিসেবে, বাংলাদেশি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপনের জন্য যেটা করার, সেটাই করেছেন।
এমন বিশেষ দিনে আমি অন্য কেউ হতে চাইনি: বাঁধন
তাঁর এই লুক এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে আমাদের কথা হয়েছে বাঁধনের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, অমন বিশেষ দিনে তিনি অন্য কেউ হতে চাননি। সেটাই বরং শোনা যাক তাঁর মুখ থেকে।
প্রথম আলো: অভিনন্দন। প্রিমিয়ারে পরার জন্য কেন জামদানি শাড়ি বেছে নিলেন?
আজমেরী হক বাঁধন: আমাদের আসাটা খুবই অনিশ্চিত ছিল। ভিসার পরেও ইমিগ্রেশন অ্যালাও করবে কি না, কেউ যদি আবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি...সব মিলিয়ে খুব অল্প সময়ের ভেতর আমাকে সিদ্ধান্ত আর প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। পোশাক নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য জামদানি শাড়ির চেয়ে ভালো কিছু আর হয় না। আমার আর কিছু মাথায়ই আসেনি। মানে, প্রিমিয়ারে অন্য কিছু পরব, এটা আমি কখনোই ভাবিনি। তারপর আমি ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ ভাইয়াকে বিষয়টি জানিয়ে বলি, আমি আড়ংয়ের জামদানি পরতে চাই।
উনি সঙ্গে সঙ্গে আড়ংয়ের মার্কেটিং টিমকে বলেন। তাঁরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমার আইডিয়া শোনেন। আমি জানিয়েছিলাম যে আমি শাড়িটা সাধারণভাবে শাড়ির মতো করেই পরতে চাই। অন্যভাবে না। তো ডিজাইনার তপতী আপু (তপতী হাসান) ব্লাউজের আইডিয়া নিয়ে আসেন। খুবই অল্প সময়ে ওনারা ব্লাউজটা বানিয়ে দেন। দিনরাত কারিগরেরা কাজ করেছেন। এই শাড়ি আর ব্লাউজ বানাতে যে সময় লাগার কথা, তার বোধ হয় পাঁচ ভাগের এক ভাগ সময় নিয়েছেন তাঁরা। শাড়িতে আমাকে সবচেয়ে সুন্দর লাগে। আর আমি শাড়িতে খুবই কনফিডেন্ট। তাই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কানের রেড কার্পেটে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আমি ঠিক এ রকম একটা পোশাকই চেয়েছিলাম।
প্রথম আলো: মেকআপ, হেয়ার কীভাবে হলো?
বাঁধন: আমাদের কিন্তু ওভাবে কোনো সাপোর্ট নেই। আমাদের টিকিটের টাকাটা স্পনসরড। তা ছাড়া, আমরা এখানে নিজেদের খরচে আছি। খুব বেশি বিলাসিতা করার সুযোগ নেই। তাই মেকআপ বা হেয়ারের জন্য কাউকে আনা সম্ভব হয়নি। আর আমার আশপাশের মানুষ জানে যে আমি পোশাক, মেকআপ, হেয়ারের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ খুঁতখুঁতে। এখানে আমি কাউকে চিনি না, জানি না। অনেক টাকা খরচ করে একটা মেকআপ নেওয়ার পর কী অবস্থা হবে, আমি জানি না। আমি তাই সেই ঝুঁকি নিইনি। নিজেই মেকআপ করেছি। আমি ভীষণ ভালো মেকআপ করতে জানি। হেয়ারও করতে জানি। এটা একেবারেই আমার নিজের করা। খুবই সিম্পল সাজ দিয়েছিলাম।
ওই দিন আমরা খুবই টেনশনে ছিলাম। আমার তো পরীক্ষার রেজাল্টের দিনের মতো ভয় ছিল। তাই খুব বেশি ঝুঁকি নেওয়ার অপশনই ছিল না। আর আমি নিজেকে নিয়ে খুবই আত্মবিশ্বাসী। আমার যা আছে, তা নিয়েই খুশি। আমি খুবই হালকা একটা বেজ দিয়েছি। হালকা একটা লিপস্টিক ব্যবহার করেছি। আমার কাজল প্রিয়। তাই চোখ ভরে কাজল দিয়েছি। নিট করে চুলটা করব, এটা তো আমি ব্লাউজের ডিজাইন দেখেই ঠিক করেছিলাম। যেটা হয় যে আমি তো প্রতিদিন নিজেকে শাড়িতে দেখি। অনেকটা এ রকমই লাগে। তাই আমি নিজে বুঝতে পারছিলাম না যে আসলে ভালো হয়েছে কি না। পরে আমি যখন বের হয়েছি, সবাই বলতে শুরু করল, ‘ইউ আর লুকিং অ্যামেজিং।’ সবাই আমার শাড়ি, শাড়ি পরার ধরন, সাজগোজ আর শাড়ির প্রশংসা করেছে।
প্রথম আলো: কানে বিশ্বের সেরাদের মধ্যে নিজেকে ক্যারি করতে কেমন লাগছে?
বাঁধন: নিজেকে আমি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ক্যারি করতে জানি। আমি বিশ্বাস করি, কোন ব্র্যান্ডের জামা পরলাম, কোন ব্যাগ নিলাম, সেটা আমার সৌন্দর্য ডিফাইন করে না; বরং নিজেকে ওন করার মাধ্যমে নিজের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। আমি ফুটপাত থেকে কেনা জিনিসও পরতে পারি। আবার শখ করে কেনা একটা নামী ব্র্যান্ডের দামি জিনসও পরতে পারি। এটা বলতে আমার কোনো সংকোচ নেই। কখনো এটা নিয়ে লজ্জাবোধ করি না যে আমি কোথাকার কাপড় পরছি বা কত টাকার কাপড় পরছি।
প্রথম আলো: প্রিমিয়ারের জন্য এই লুক তৈরির পেছনে কি কারও অনুপ্রেরণা ছিল?
বাঁধন: আমি কেবল নিজেকে নিয়ে ভেবেছি। আমি এই লুকে খুবই আত্মবিশ্বাসী। এটা আমার একটা কমন লুক। এমন বিশেষ দিনে আমি অন্য কেউ হতে চাইনি। আমি কেবল আমি হতে চেয়েছি। আমি কাউকে ফলো করা পছন্দ করি না। নিজের যে পরিচয়, সেটাতে পরিচিত হওয়াই সবচেয়ে গৌরবের।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের প্রথম অভিনেত্রী হিসেবে কানে প্রতিনিধিত্ব করছেন, কেমন লাগছে?
বাঁধন: আমি বাংলাদেশের প্রথম হয়ে কানের লালগালিচায় হাঁটতে পেরেছি, এটা ইতিহাসে লেখা থাকবে। এটা আমার জন্য ভীষণ আনন্দের, গর্বের, সৌভাগ্যের। আমাকে এখানে সবাই যেভাবে অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে, সেটা আমি বোঝাতে পারব না। ওরা তো সব সময় গাউন দেখে, বিভিন্ন রকম কাপড় দেখে, অনেক ব্র্যান্ডের জিনিস দেখে। কিন্তু এই জামদানি শাড়ির লুকটা ওদের খুবই ভালো লেগেছে। এটা একেবারেই মুম্বাই স্টাইলের শাড়ি ছিল না, ভারতীয়রা যেভাবে শাড়ি পরে, ওভাবেও পরা হয়নি। একেবারেই বাঙালি, বাংলাদেশি সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে কানের লালগালিচায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছে।
প্রথম আলো: আপনার শাড়ি দেখে ওখানকার সবাই কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাল?
বাঁধন: অনেকেই আমাকে বলেছে যে ওরা বলিউডের নায়িকাদের অনেককে শাড়িতে দেখেছে। কিন্তু এটার সঙ্গে ওরা সবচেয়ে বেশি কানেকটেড হতে পেরেছে। সব মিলিয়ে এটা একটা ‘লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স’, যেটা খুব কম অভিনেত্রীর জীবনে আসে।
ছবি: বাঁধনের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল ও আড়ং