বাংলাদেশের দুস্থদের চোখের চিকিৎসায় ইউক্রেনের ডিজাইনারের অর্থ সাহায্য

ইউক্রেনিয়ান ফ্যাশন উইকে সংগ্রহ উপস্থাপনার আগে চলছে মেকআপছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের রক্তচোখ উপেক্ষা করেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ইউক্রেনিয়ান ফ্যাশন উইক স্প্রিং-সামার ২০২১। তবে করোনা জুজু যে যায়নি, সেটা সচেতনভাবেই মাথায় রেখেছেন ডিজাইনাররা। তাই মাস্ক হয়ে গেছে ডিজাইনারদের সংগ্রহের অংশ। ফলে পোশাকের সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে মাস্ক প্রদর্শিত হয়েছে রানওয়েতে। এই আসরের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সম্মানিত অতিথি ফ্যাশন ডিজাইনার অ্যানেট গোরৎজের ‘মেডফর’ কালেকশন। এই সংগ্রহ বিক্রির একাংশ ব্যয় হবে বাংলাদেশের চোখে ছানিপড়া দুস্থ মানুষের চিকিৎসায়।

তরুণ ডিজাইনাদের ফ্যাশন সংগ্রহে স্থান পেয়েছে মাস্ক
ছবি: রয়টার্স

৩১ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এই আসরে ১৭ জন শীর্ষ ডিজাইনারের পাশাপাশি ভবিষ্যতের ডিজাইনারদের অংশগ্রহণও ছিল উল্লেখযোগ্য। ইউক্রেনিয়ান ফ্যাশন স্কুলের ছেলেমেয়েরা উপস্থাপন করেছেন তাঁদের মেধাবিচ্ছুরিত ফ্যাশনসৃজন। এ বছর প্রতিষ্ঠিতদের পাশাপাশি আরও ছিল ফ্যাশন অ্যাকসিলেটর কর্মসূচি থেকে বাছাই করা ৯ জন ডিজাইনারের উপস্থাপনা। এঁদের মধ্যে ছিলেন আনাস্তাসিয়া পোদালতা, ইউলিয়া ব্রিজিদা, ক্যাটারিনা হেল্লা, ইয়ানা মার্কোভস্কায়া, ইউলিয়া পসতুশনা, মেলনিচেঙ্কো কারিনা, সোলোমিয়া বুতকোভস্কা ও ইয়াদভিগা নেতিকস্কায়া। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এঁদের মধ্যে সবাই না হলেও কয়েকজন অন্তত আগামী দিনে বিশ্ব মাতাবেন।

ইউক্রেন ফ্যাশন উইক শুরু সেই ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে। তখন এটাই ছিল পূর্ব ইউরোপের প্রথম পেশাদার ফ্যাশন ইভেন্ট। সময়ের পরিক্রমায় এই আসর পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক মানে। পরবর্তী সময়ে বছরে দু্বার করেই অনুষ্ঠিত হয়ে আসা এই ফ্যাশন উইক ইউক্রেনের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য রীতিমতো চালিকাশক্তি হিসেবেই কাজ করছে। এমনকি ইউক্রেনের ফ্যাশনকে বৈশ্বিক মঞ্চে পৌঁছে দিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।

এলেনা বুরেনিনার বসন্ত-গ্রীষ্মে সংগ্রহে উপস্থাপিত দৃঢ়, স্বাধীনচেতা অথচ সফল নারীর প্রতিরূপ
ছবি: রয়টার্স

প্রথম দিনের ডিজাইনারদের মধ্যে বিশেষভাবে নজর কাড়ে এলেনা বুরেনিনার কাজ। তিনি আসছে বসন্ত-গ্রীষ্মের জন্য বেছে নিয়েছেন দৃঢ়, স্বাধীনচেতা অথচ সফল নারীর প্রতিরূপ; যিনি কিনা আবার আবেদনময়ীও। শিল্প আর স্থাপত্যের প্রতি যার রয়েছে অনুরাগ। আসলে এই রূপের সন্ধান এলেনা পেয়েছেন এমা রেকির মধ্যে। ‘আই অ্যাম লাভ’ ছায়াছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র। ২০০৯ সালের এই ছবিতে এমা রেকির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন টিলডা সুইনটন।

এলেনার সংগ্রহ এক কথায় আভিজাত্যময়। রঙের প্যালেটে মন ভালো করা সব নরম শেডের উপস্থিতি। যেন কোনো শিল্পীর ক্যানভাসে বোলানো জলরং। গেল বছর থেকে এলেনা অবশ্য মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদের পোশাকে বিশেষ নজর দিয়েছেন। তাঁর এবারের সংগ্রহেও সেটা স্পষ্ট ছিল। শার্ট আর জ্যাকেটের নিখুঁত কাজ ছিল নজরকাড়া।

প্রথম দিনের উপস্থাপনায় আরও ছিল ইউক্রেনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ডিজাইনার ইয়াসিয়া মিনোচকিনা।

সোফিয়া রুসিনোভিচের ব্র্যান্ড রোশিন নিয়ে উপস্থিত ছিলেন দ্বিতীয় দিনে। রঙের খেলা তিনি দেখিয়েছেন। পাশাপাশি ছিল পরিবেশ রক্ষার বার্তা। পুনর্ব্যবহারযোগ্য টেপ আর শতভাগ বায়োডিগ্রেডেবল গোগ্রিন ব্যাগ ছিল এই উপস্থাপনার বিশেষ আকর্ষণ। ডিজাইনার সোফিয়ার বক্তব্যই ছিল, বর্জ্য নিয়ে আমাদের বদ্ধমূল মনোভাব বদলাতে হবে। বর্জ্য পুনর্ব্যবহার, নতুন করে প্রক্রিয়াজাত করে কার্যকর পণ্যে পরিণত করা সম্ভব। এ জন্যই তিনি প্লাস্টিককে বর্জ্য নয় বরং কার্যকর উৎস হিসেবেই নিয়েছেন।

প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারের বার্তা ছিল সোফিয়া রুসিনোভিচের কালেকশনে
ছবি: রয়টার্স

ঘটমান বর্তমানে নিজের সৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ না থেকে বরং অতীতে ফিরে গেছেন ডিজাইনার মারিনা রিবালকো। তাই তাঁর ‘টাইম’ শিরোনামের সংগ্রহের প্রেরণা হয়েছে ভিক্টোরিয়ান ড্রেস আর স্প্যানিশ পুরুষের রেনেসাঁ কস্টিউম।

‘টাইম’ শিরোনামের সংগ্রহে অতীতাশ্রয়ী হয়েছে মারিনা রিবালকো
ছবি: রয়টার্স

দ্বিতীয় দিনে উপস্থাপিত মারিনার পোশাকে এ জন্যই আঁটোসাঁটো শিলুয়েটের সঙ্গে ঢিলেঢালা বিন্যাসে মাত্রা দিয়েছে র‌্যাফেল, মুক্তো। বৃত্তাকার হাতা এই পোশাককে করেছে দৃষ্টিনন্দন। সুতি, লিনেন, লন, পপলিনের মতো পুরোপুরি প্রাকৃতিক তন্তুতে তৈরি কাপড় ব্যবহার করেছেন তিনি। হ্রস দৈর্ঘ্যের পোশাকে তাঁর নিরীক্ষাসঙ্গী হয়েছে অ্যাসিমেট্রি আর জটিল কাট। মোনোক্রোমের মধ্যেই সাদা আর কালোর উদ্ভাস ছিল চোখে পড়ার মতো।

অ্যানেট গোরৎজের ‘মেডফর’ কালেকশন বিক্রির একাংশে বাংলাদেশে চোখের ছানি পড়েছে, এমন দুস্থ মানুষকে সহায়তা করা হবে আন্ধেরি হিলফের দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।

তৃতীয় দিনে সম্মানিত অতিথি অ্যানেট গোরৎজ উপস্থাপন করেন তাঁর ‘মেডফর’ শিরোনামের অটাম-উইন্টার ২০-২১ সংগ্রহ। ‘মেডফর’ আরও একাধিক কারণে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। বস্তুতন্ত্র, মানুষের হাতে তৈরি বিষয় আর সেই পণ্যের প্রতি আমাদের আচরণের প্রতিফলনকে তুলে ধরা হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, এই কালেকশন বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটা অংশ দেওয়া হয়ে থাকে আন্ধেরি হিলফে নামের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে, যারা ভারত ও বাংলাদেশের দুস্থ মানুষকে নানা ধরনের সেবা ও সহায়তা দিয়ে থাকে। এবার এই অর্থ আন্ধেরি হিলফের মাধ্যমে বাংলাদেশে চোখের ছানি পড়েছে, এমন দুস্থ মানুষকে সহায়তা করা হবে। এই মেড ফর সংগ্রহকে বলাই হচ্ছে সম্পূর্ণ আপনার জন্যই তৈরি।

তরুণ ডিজাইনারদের সৃজন উপস্থাপনা
ছবি: রয়টার্স

সমাপনী দিনের বিশেষ আকর্ষণ অবশ্যই ছিল ‘লাইন অব লাইটস’ কালেকশন। একঝাঁক তরুণ ডিজাইনার তাঁদের সৃজন উপস্থাপন করেছেন ইউক্রেনিয়ান ফ্যাশন কাউন্সিলের সহায়তায়। তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় কাপড় সরবরাহ করেছে তারা। এই কালেকশনের মূল বিষয় ছিল কিয়েভ নগরীর সন্ধ্যা গড়ানো রাত। গোধূলির আকাশ। সন্ধ্যার দিকচক্রবাল, রাতের নগরী, ব্যস্ত রাস্তায় জ্বলে ওঠা নিয়নবাতি আর চলমান গাড়ির আলো মিলিয়ে যে অদ্ভুত দৃশ্যকল্প, তারই প্রতিফলন যেন ঘটেছে কাপড়ের ক্যানভাসে।

এদের মধ্যে আবার তরুণ প্রতিভাবান ডিজাইনার আনা গাইওভার চিরাচরিত ধারণাকে নস্যাৎ করে উপস্থাপন করেছেন তাঁর সৃজনকর্ম। গেল বছরের ‘সেফ ফ্যাশন’ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী গাইওভার তাঁর কেজো পোশাককে কতখানি আকর্ষক, দৃষ্টিনন্দন আর লোভনীয় করে তোলা যায়, তা দেখিয়েছেন অনবদ্য মুনশিয়ানায়।

তরুণ প্রতিভাবান ডিজাইনার আনা গাইওভার চিরাচরিত ধারণাকে নস্যাৎ করে উপস্থাপন করেছেন তাঁর সৃজনকর্ম
ছবি: রয়টার্স

তবে এবারের আসরের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল ‘বি সাসটেইনেবল’ শিরোনামের ফ্যাশন সামিট। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি ইউক্রেনের ফ্যাশন ও ক্লোদিং ইন্ডাস্ট্রির বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এবারের সামিটের পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র সরকার।

তথ্যসূত্র: ইউক্রেনিয়ান ফ্যাশন কাউন্সিল