বিয়েতেও থাকুক দেশের প্রতি ভালোবাসা

বাংলাদেশের বিয়ের বাজারের ৯৫ শতাংশ দখলে বিদেশিদের। একটু সম্পন্ন পরিবার হলেই বিয়ের শপিংয়ে ছুটতে হয় ভিনদেশে। আর যাঁরা দেশেই কেনাকাটা করেন, তাঁরাও দেশি পণ্যে নৈব নৈব চ। এর মধ্যে কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা দেশি পণ্যে আস্থা রাখেন। আর কিছু ডিজাইনার আছেন, তাঁরা স্রোতের বিপ্রতীপে হাঁটেন দেশের কথা ভেবে। তাঁদের নিয়েই এই নাতিদীর্ঘ ধারাবাহিক। তৃতীয় পর্বে থাকছে এমদাদ হকের তৈরি ওয়েডিং কালেকশন।

পানচিনির পোশাক: কনে: মেজেন্ডা রংয়ের ভারী শিফন শাড়িতে এম্ব্রয়ডারি ও স্টোনের কাজ। বর: হালকা মেজেন্ডা রংয়ের মিরপুরের কাতান শাড়ি দিয়ে তৈরি শেরওয়ানি ও ভেজিটেবল ডাই করা শাল
মেকআপ; পারসোনা; গয়না: রিমঝিম; মডেল: বুশরা শাহরিয়ার ও সুজন ; ছবি: নীরব আদ্র

বড় হওয়া পুরান ঢাকায়। তাই ঢাকার ঐতিহাসিক এই এলাকার প্রতি অন্য রকম টান তাঁর। যেটা আজও মলিন হয়নি, বরং সর্বদাই একাত্মতা বোধ করে থাকেন। ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে কাজের সূচনার দিনগুলোয় তিনি তাঁর অনুরাগীদের টেনে নিয়ে যেতেন তাঁর এলাকায়; পুরান ঢাকার উর্দু রোডে। কারণ আর কিছুই নয়, ডিজাইনারের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। সেই ধারায় ছেদ পড়লেও ফ্যাশন ডিজাইনার এমদাদ হক তাঁর মতো করেই কাজ করে চলেছেন শারীরিক অসুস্থতার কারণে সাময়িক বিরতির পর। অন্য সব কাজের মধ্যে অব্যাহত আছে ওয়েডিং কালেকশন তৈরি।

এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, বিয়ের বাজার বরাবরই অন্য দেশের দখলে ছিল। আর ডিজাইনার্স ওয়েডিং কালেকশন ছিল স্বপ্নের মতো। অথচ সেই ১৯৮৫ সালেই এই কঠিন কাজ শুরু করেছিলেন এমদাদ হক। তখনো তিনি পুরোপুরি এই পেশায় আসেননি, বরং সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় ফ্যাশনবিষয়ক লেখালেখির পাশাপাশি বিয়ের পোশাক তৈরি শুরু করেন তাঁদের উর্দু রোডের বাড়িতে।

পরবর্তী সময়ে এই ধারায় অনেকেই যুক্ত হন এবং বাংলাদেশের বিয়েতে দেশি পোশাক পরার ধারা নতুন করে তৈরি হতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করে সোশ্যাল মিডিয়ার দখলদারি আর উপগ্রহ চ্যানেলের বাড়বাড়ন্তে এই বাজার চলে গেছে অন্য দেশের কবজায়। বাংলাদেশের বিয়েতে তাই আর বাঙালিয়ানা খুঁজে পাওয়া যায় না, খেদের সঙ্গে বলছিলেন এমদাদ হক।

হলুদের পোশাক : কনে: বাসন্তী রংয়ের সিল্ক শাড়িতে স্ক্রিন প্রিন্ট ও গ্লাসওয়ার্ক বর: বাসন্তী রংয়ের সিল্ক পাঞ্জাবিতে গয়না মোটিফের কারচুপি, সঙ্গে মিরপুর কাতানের উত্তরীয়
মেকআপ; পারসোনা; গয়না: রিমঝিম; মডেল: বুশরা শাহরিয়ার ও সুজন ; ছবি: নীরব আদ্র

‘আগের দিনের সেই গায়েহলুদ, বিয়ে আর বৌভাতের যে মজা ছিল, তা আর এখন নেই। বরং আগাগোড়াই যেন হয়ে গেছে লোকদেখানো বিষয়। অথচ যে সংস্কৃতিতে আমরা প্রভাবিত হচ্ছি, তারা কিন্তু তাদের ঐতিহ্য আর পরম্পরা থেকে সরে আসেনি একটুও। অথচ মাঝখান থেকে আমরা বিসর্জন দিয়েছি আমাদের স্বকীয়তা,’ আক্ষেপ ঝরালেন এমদাদ।

একসময় তিনি জামদানি কাপড় দিয়ে প্রচুর শেরওয়ানি করেছেন, যেগুলোর যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও ছিল। দেশে বিয়ের মৌসুমে নিয়মিতই নিয়েছেন ক্রেতারা। এমনকি তিনি প্রবাসী বাঙালিদের কাছেও অনেক বিক্রি করেছেন।

তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি আলোকপাত করলেন, বিয়ে তো দীর্ঘ লালিত স্বপ্নেরই নামান্তর, যেখানে দুটি জীবনের মিলন। সেখানে গল্প আছে, সামাজিক ও পারিবারিক বিষয় আছে; আছে আত্মিক বিষয়। ফলে এই আয়োজনে প্রাণ প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করতে হবে।

এখন বাংলাদেশে অনেকেই ভালো কাজ করছেন। কিন্তু বাজার নেই বলে হয়তো বিয়ের পোশাক বানাতে সাহস পান না। এ ক্ষেত্রে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে বলেই তাঁর অভিমত।

আসলে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে বিদেশি ডিজাইনারের পোশাক না কিনে দেশের ডিজাইনারদের কাছ থেকে কেনা যেতে পারে। অনেকে আবার বিদেশি ডিজাইনারদের রেপ্লিকা পোশাক কিনে আনেন। অথচ এর চেয়ে ভালো পোশাক দেশেই তৈরি হয়ে থাকে, বললেন তিনি।

সঙ্গে প্রশ্ন রাখেন, ‘দেবদাস’ ছবির জন্য যদি বাংলাদেশ থেকে বেনারসি যেতে পারে, তাহলে কেন আমাদের বেনারসি বিয়ের শাড়ি হিসেবে উপযুক্ত হবে না?
এ ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ নেই, দৈন্য আমাদের ভাবনায়, আমাদের মানসিকতায়। কারণ, এখনো অনেক কাপড় দেশে তৈরি হলেও বিক্রি হচ্ছে ভারতীয় বলে। আর চড়া দামে সেটাই কিনছে মানুষ। সম্প্রতি তেমনই এক অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন এমদাদ।

বিয়ের পোশাক: কনে: ষাট দশকের স্টাইলের লাল বেনারসি, লাল কাতান ওড়না ও উত্তরীয় বর: কালো-সোনালী মিরপুর কাতানের ব্রোকেড শেরওয়ানির সঙ্গে কালো-লাল সিল্ক উত্তরীয়; লাল চুন্দ্রি ও টিস্যু দিয়ে হাতে বানানো পাগড়ির সঙ্গে সোনালি পেশওয়ারি সালোয়ার
মেকআপ; পারসোনা; গয়না: রিমঝিম; মডেল: বুশরা শাহরিয়ার ও সুজন ; ছবি: নীরব আদ্র

বস্তুত বাংলাদেশের বয়নশিল্পীদের ছোট করে দেখার অবকাশ নেই, বরং অনেক ভালো মানের কাপড় বর্তমানে তৈরি হচ্ছে। তাই এসব কাপড় দিয়ে অনায়াসেই হতে পারে বিয়ের কাপড়। বিশেষ করে জামদানি আর বেনারসি এ ক্ষেত্রে আদর্শ। পাশাপাশি টাঙ্গাইল শাড়িও কোনোভাবে উপেক্ষার নয়।

বিয়ের প্রস্তুতি সাধারণত শুরু হয় অনেক আগে থেকেই। কিন্তু বিয়ের পোশাক কেনার বিষয়টিকে তুলে রাখা হয় শেষ সময়ের জন্য। অথচ শুরু থেকেই পোশাকের বিষয়টা বিবেচনায় রাখলে অনেক সময় নিয়ে পোশাক তৈরি করিয়ে নেওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী শাড়ি কিংবা ড্রেস ম্যাটেরিয়াল আগে থেকে বুনিয়ে নিয়ে সেই কাপড়েই পোশাক বানানো যায়। কিংবা সেই দায়িত্বটা ডিজাইনারদের ওপরও ন্যস্ত করা যায় অনায়াসে; আর সেই পোশাক, সন্দেহাতীতভাবেই হবে অনেক উঁচু মানের।

ইদানীংকার বিয়েতে, বিশেষত কনে সব অনুষ্ঠানে শাড়ি পরছেন না। কেবল বিয়ের দিন হয়তো পরছেন। অন্য অনুষ্ঠানে লেহেঙ্গা, গাউন পরছেন। অনেকে আবার বিয়েতেই লেহেঙ্গা পরছেন। ফলে দেশে তৈরি কাপড়ে তাই পছন্দের পোশাক তৈরি করিয়ে নেওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের ডিজাইনাররা এই ভাবনা থেকেই পোশাক তৈরি করছেন।
নতুন করে কাজ শুরু করার পর এবার বেশ কিছু বিয়ের পোশাক তৈরি করেছেন এমদাদ হক। সব পোশাকই তিনি করেছেন দেশি কাপড় দিয়ে।

বৌভাতের পোশাক: কনে: সাদা বলাকা সিল্কে অল-ওভার কারচুপি নকশার শাড়ি ও চওড়া পাড়ের ম্যাচিং ওরগ্যাঞ্জা শাল বর: জুট ও সিল্কে মিশ্রন বুননে ছাই রংয়ের শেরওয়ানিতে গয়না মোটিফের সুক্ষ এম্ব্রয়ডারী; সঙ্গে একই কাপড়ে শাল ও কালো ধুতি সোলোয়ার।
মেকআপ; পারসোনা; গয়না: রিমঝিম; মডেল: বুশরা শাহরিয়ার ও সুজন ; ছবি: নীরব আদ্র

বিশেষ করে শেরওয়ানিগুলো বানানো হয়েছে শাড়ি কেটে। সঙ্গে হাতে বানানো পাগড়িও। ড্রেপিং এমদাদের পছন্দের বিষয়। ফলে তাঁর হালের ওয়েডিং কালেকশনের পোশাকগুলোতে সেই ছাপ লক্ষ করা যায়। তবে তিনি কনের পোশাক হিসেবে বাঙালি ঐতিহ্যকেই এগিয়ে রাখতে চান। এ জন্যই প্রাধান্য দিয়েছেন শাড়িকে। বিয়ের শাড়ি হিসেবে তাঁর বরাবরই পছন্দ বেনারসি। তা–ও লাল। তবে কনের পছন্দকেও তিনি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ফলে রং বদলে আপত্তি থাকে না তাঁর। বৌভাতে ছেলেরা সাধারণ স্যুট পরে থাকেন, এর পরিবর্তে তাঁকে শেরওয়ানিতেও যে মানিয়ে যায়, সেটাকেই তিনি প্রতিপন্ন করেছেন। অন্য অনুষ্ঠানগুলো ততটা গুরুগম্ভীর নয়; বরং সেখানে আনন্দ, উল্লাস, হইচই বেশি থাকে। ফলে সেভাবেই সাজান তিনি তাঁর পোশাক নকশার ভাবনা।

এ ক্ষেত্রে তিনি আরও একটি বিষয় যোগ করলেন, পোশাকের সঙ্গে মেকআপ আর কেশসজ্জা সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া চাই। নাহলে পোশাকের গ্ল্যামার ম্লান হয়ে যায়। এ জন্য ডিজাইনারের সঙ্গে বিউটিশিয়ানের আলোচনা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বর আর কনেকেই সেতুবন্ধের কাজটা করতে হবে।

দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এই ধারা এমদাদ অব্যাহত রাখতে চান। পাশাপাশি দেশের পণ্য কিনতে আগ্রহী করতে চান তরুণদের। কারণ, তিনি মনে করেন, তাহলে এই অর্থ কেবল দেশেই থাকবে না, বরং আমাদের বয়নশিল্পী, দরজি, সুচিশিল্পীরা কাজ পাবেন।

ফিরানির পোশাক: কনে: সবুজ এন্ডি শাড়িতে কাঁথা স্টিচের জমিন অলংকরণ বর: ফোক মোটিফের জমিন অলংকরণ করা অফ হোয়াইট এন্ডি শেরওয়ানির সঙ্গে কাঁথা স্টিচের ম্যাচিং শাল
মেকআপ; পারসোনা; গয়না: রিমঝিম; মডেল: বুশরা শাহরিয়ার ও সুজন ; ছবি: নীরব আদ্র

বিয়ের পোশাক তৈরির আগে তিনি বর ও কনে উভয়ের সঙ্গে কথা বলে নেন। আগে তিনি যখন উর্দু রোডে থাকতেন, তখন সেখানেই আমন্ত্রণ জানাতেন। এখন তিনি সেখানে থাকেন না। পরিবর্তিত বাস্তবতায় তিনিও এখন নতুন ঢাকার বাসিন্দা। অতএব সেখানেই ডাকেন তাঁদের। কথা বলেন। শুনে নেন তাঁদের পছন্দ-অপছন্দ। তারপর পোশাক তৈরির কাজে হাত দেন।

বর্তমানে এমদাদ যে ওয়েডিং কালেকশন তৈরি করছেন, তা কেবল বিয়ে আর বৌভাতই নয়, বরং সব কটি অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে। অর্থাৎ পানচিনি থেকে ফিরুনি বা জামাইবাজার—প্রতিটি অনুষ্ঠানের জন্য সেই অনুষ্ঠানের আবহ আর মেজাজ, বর আর কনের পছন্দ, তাঁদের শারীরিক গড়ন ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি নকশা করছেন ওয়েডিং কালেকশন।

হয়তো একটা বড় অংশের রয়েছে বিদেশি পণ্যের প্রতি মোহ। কিন্তু এর বাইরেও একটা ক্ষুদ্র অংশ দেশের প্রতি আন্তরিক থাকছেন। এটাকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন এমদাদ হক। এমনকি তাঁর মতো আর যেসব ডিজাইনার বিয়ের পোশাক তৈরি করছেন, তাঁদের প্রতিও তিনি সমান শ্রদ্ধাশীল।

তিনি বললেন, এই প্রয়াস আদপে একটা আন্দোলনের মতো। এখানে বিনিয়োগ আছে, ঝুঁকি আছে; তা সত্ত্বেও তিনি মনে করেন, এসব ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে দেশের বাজার ধরে রাখার ঐকান্তিকতা। ফলে আরও বেশি করে ডিজাইনারদের আসা উচিত। এমনকি আমাদের দেশের ফ্যাশন হাউসগুলো এই প্রয়াসে শামিল হলে মানুষ অনেক বেশি অপশন পাবে। তাঁদের উৎসাহ বাড়বে দেশি পণ্যের প্রতি।

বাংলাদেশের বিয়ের বাজারকে চাঙা করতে প্রয়োজন ভোক্তার মানসিকতার পরিবর্তন। আর মানসম্মত ও বৈচিত্র্যময় দেশি পণ্যের অব্যাহত জোগান। তাহলেই বদলে যেতে পারে দৃশ্যপট।