মিশ্র উপস্থাপনায় সৃষ্টির সৌন্দর্য্য

ফ্যাশন শো ফ্রোজেন ইন টাইমছবি: খালেদ সরকার

কাপড় নিয়ে খেলা করতে পছন্দ করেন বিশ্বনন্দিত ফ্যাশন ডিজাইনার গ্রেস মুন। তাঁর সৃষ্টিপ্রেরণার মূলেই কাপড়। সেখানে প্যাটার্ন আর রঙের মাধুর্যে পোশাক অবয়ব পায়। ধারাবাহিকভাবে করা তাঁর সংগ্রহে সেটা স্পষ্ট। এবার ঢাকাও থাকল সাক্ষী। বাড়তি পাওনা হলো ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের অন্যতর রূপদর্শন।

পাঞ্জাবি নিয়ে নিজের মতো করেই কাজ করেছেন গ্রেস মুন
ছবি: খালেদ সরকার

কারণ, ২৭ ডিসেম্বরে হোটেল আমারির বলরুমে অনুষ্ঠিত ফ্যাশন শো ‘ফ্রোজেন ইন টাইম’-এ কোরিয়ান-আমেরিকান ফ্যাশন ডিজাইনার মুন কেবল তাঁর দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হ্যানবক নয়, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পাঞ্জাবিকেও নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন।

করব্যানের সহযোগিতায় লাইফস্টাইল সাময়িকী আইস টুডে আয়োজিত এই ফ্যাশন শোয়ের প্রথম পর্ব ছিল উভয় দেশের চিরাচরিত পোশাকের আধুনিক ও মিশ্র প্রদর্শন। ফ্যাশন ডিজাইনের শিক্ষার্থীদের কাছে দারুণ শিক্ষণীয় হতে পারে মুনের এসব পোশাক। এই পর্বের কয়েকটি পোশাকের কাপড়, নকশা আর প্যাটার্ন স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁর নিউইয়র্ক অভিযাত্রা। ২০১৭ সালের নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকের শোতে এই ধরনের কাপড় ছিল তাঁর সংগ্রহে। সিল্ক দিয়েই তিনি সংগ্রহ করেন। এখানেও সেই ধরনের পোশাক দেখা গেল, সিল্কের কাপড়ে তৈরি।

হ্যানবক স্টাইলে তৈরি পোশাকে শেকড় উপস্থাপনা প্রয়াস
ছবি: খালেদ সরকার

হ্যানবক স্টাইলকে ভেঙেচুরে নানা আকার দিয়েছেন। টপ আর বটম উভয়ে পোশাক। হেমলাইনে ছোট ছোট কাজ চোখ টানে। প্রতিটি পোশাক করা হয়েছে নানা রঙের সিল্ক কাপড়ে। কোনো কোনো পোশাকে একাধিক রঙের উপস্থিতিও ছিল। বাদামি, বেস, হলুদ, সবুজ, পার্পল, ধূসর ইত্যাদি রঙে তৈরি হয়েছে টপস। এর বিপরীতে বটমগুলো একেবারেই অফ হোয়াইট। এই ধরনের কাজ তিনি নানা সময়ে করে থাকেন নিজের শিকড়-পরিচিতির দায় থেকে। এখানেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।

তবে কিছু পোশাকের কাপড়ে রঙের উপস্থিতি, জ্যামিতিক নকশা মিল খুঁজে পাওয়া যায় ইভস সাঁ লোরের সৃজনের।

মুনের ডিজাইন করা মেয়েদের এই পোশাকের আঙ্গিকে মেলে ইভস সাঁ লোরের ছায়া
ছবি: খালেদ সরকার

গত বছর প্যারিস ফ্যাশন উইকে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরা এই ফ্যাশন ডিজাইনারের হাতে পাঞ্জাবি পেয়েছে বিশেষ মাত্রা। কাট আর প্যাটার্নে যেমন, তেমনি ভ্যালু এডিশনেও তিনি পাঞ্জাবিকে নতুনত্ব দিয়েছেন, যা পাঞ্জাবির নতুন যাত্রার সূচক হয়ে থাকবে

শোয়ের দ্বিতীয় পর্ব আক্ষরিক অর্থেই ছিল যুগলবন্দী। কারণ, এখানে আলাদা করে নয়, বরং গ্রেস মুন এবং এজেড (মডেল আজিমে উদদৌলার ব্র্যান্ড) যৌথভাবে সংগ্রহ উপস্থাপন করে। উভয়ের পোশাকের ধরন আর বৈশিষ্ট্যে বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি কোনটি কার।

মুনের কাজ
ছবি: খালেদ সরকার

মেটালিক, সিল্ক, স্যাটিন ভেলভেটসহ নানা ধরনের কাপড়ে মুন দেখিয়েছেন তাঁর সৃজনের মুনশিয়ানা। মেটালিক কাপড়েরও ছিল নানা ধরন। লং ড্রেস, প্যান্ট, ট্রাউজার, স্কার্ট-টপস, ব্লেজার, জ্যাকেট, হুডি, লংকোট, গাউন, প্যান্ট-টপস, ড্রেস, পাঞ্জাবি আর পাঞ্জাবি প্যাটার্নের ড্রেস মিলিয়ে আশিটির মতো পোশাক উপস্থাপিত হয়েছে।
মুনের প্রতিটি পোশাকের শিলুয়েট ছিল দেখার মতো। কাট আর প্যাটার্নের সৌন্দর্যের সঙ্গে চোখ টেনে রাখে ছোট ছোট কাজ।

এরই মধ্যে ঝলক ছিল আজিমের ব্র্যান্ড এজেডের পোশাকের। এই শো দিয়ে মূলত আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো এজেডের। আজিমের ব্র্যান্ড এজেডের সংগ্রহে ছিল নিটের শর্টস, লেদার জ্যাকেট, প্যান্ট, ট্রাউজার ইত্যাদি। এজেড পুরুষ পোশাক নিয়ে সচেতনভাবেই মাথা ঘামাচ্ছে, সেটা পোশাকগুলো দেখে বেশ বোঝা যায়। ব্র্যান্ড হিসেবে কেবল দেশেই নয়, বরং বিদেশেও পরিচিত করাতে চান আজিম। ফলে প্রস্তুতিটা শুরুতেই নিয়ে রাখছেন। এমনকি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন ডিজাইনারের সঙ্গে কাজ করার নেপথ্যেও রয়েছে তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য।

র‌্যাম্পে এজেডড-এর পোশাকে মডেল
ছবি: খালেদ সরকার

এখানে বলে রাখা ভালো, মডেল হিসেবে এক দশক পেরোনো আজিম নিজের ক্যারিয়ার অব্যাহত রেখেই একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড লঞ্চ করেন গত বছর ঈদে। একেবারেই পুরুষ পোশাক নিয়ে তাঁর এই ব্র্যান্ডের যাত্রা শুরু। বাংলাদেশের এথনিক ওয়্যার বলতে যেটা বোঝায়, সেই পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি ইত্যাদি দিয়েই শুরু হয়েছিল। পরে যোগ হয়েছে ওয়েস্টার্ন ওয়্যার।

শো শেষে মুন আর আজিমের মঞ্চে উপস্থিতি এবং এরও পর মুনের বক্তব্য এ ক্ষেত্রে বিশেষ অর্থবহ।

ক্যাটওয়াক শেষে অভিবাদন গ্রহণ করছেন আজিম ও গ্রেস মুন
ছবি: খালেদ সরকার

গ্রেস মুন স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘এটা আসলে নিজের সংগ্রহের উপস্থাপনা নয়, বরং একসঙ্গে কাজ করার আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া, যাতে বিপ্রতীপ, বিষণ্ন সময়ে আমরা সবাই এই সুখস্মৃতিকে লালন করতে পারি। বিষাদ ভুলে যেতে পারি। অনাবিল এই স্মৃতি স্থায়ী হবে বলেই তো এই আনন্দসন্ধ্যার নাম ফ্রোজেন ইন টাইম।’

উদ্যোগী আর সম্ভাবনাময় তারুণ্যের পরিচর্যা প্রয়োজন, প্রয়োজন পিঠে হাত রাখা, হাত ধরে পথটা চিনিয়ে দেওয়া। মুন আদতে অগ্রজের ভূমিকায় থেকে সে কাজই করলেন। অনায়াসেই সরিয়ে রাখতে পারলেন তাঁর ক্লাস, তাঁর খ্যাতি আর জনপ্রিয়তা। মহত্ত্বের দারুণ নজির স্থাপন করে বাংলাদেশের এক তরুণের হাত ধরে ক্যাটওয়াক শেষে হেঁটে বাড়িয়ে দিলেন তাঁর আত্মবিশ্বাস। আর এভাবেই তিনি আমাদের কাছে হয়ে থাকলেন ধন্যবাদার্হ।