রংবেরঙের হ্যাটের বাহার

হ্যাট এখন বিশ্ব ফ্যাশনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গছবি: টমি হুয়াং, পেকজেলস ডট কম

বর্তমান পৃথিবীতে এত ধরনের টুপি দেশে দেশে প্রচলিত আছে যে তা গুনে শেষ করতে দিন কাবার হয়ে যাওয়ার কথা। মানুষ প্রধানত ঝড়, বৃষ্টি, রোদ থেকে বাঁচতে মাথা ঢাকার প্রয়োজনীয়তা বোধ করার কারণেই যে টুপির ব্যবহার শুরু করেছে, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন, বিভিন্ন গুহাচিত্র এমনকি গ্রিক প্যাপিরাসের চিত্রকথন বা হায়ারোগ্লিফিক্সেও টুপির দেখা মেলে। সেই টুপিগুলো শুরুতে হয়তো কলাপাতা দিয়ে তৈরি, ঘাস বা খড়ের বিনুনিতে বোনানো অথবা পরবর্তী সময়ে মাপমতো চামড়া, কাঠ, ধাতুর পাত দিয়েও বানানো হয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে, এই প্রয়োজন মেটানোর অনুষঙ্গই একসময় শোভা বর্ধন ও ফ্যাশনের প্রতিনিধিত্বকারী হয়ে আত্মপ্রকাশ করল

টুপি বা হ্যাট সংস্কৃতির উদ্ভব

সেই ৩২০০ খ্রিষ্টপূর্বে গ্রিসের থিবসের এক বাঁধানো কবরের দেয়ালে খড়ের টুপি পরা এক লোকের ছবি পাওয়া যায়। সারা পৃথিবীতেই টুপির বিভিন্ন প্রতীকী তাৎপর্য আছে। ধর্মীয় পরিচয়, যুদ্ধে প্রতিরক্ষা, সামাজিক বা দাপ্তরিক পদমর্যাদা প্রকাশ করতে বিভিন্ন রকমের টুপি বিভিন্ন দেশে যুগে যুগে পরিধান করা হয়েছে।

নারীদের হ্যাট ফ্যাশনের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ আইকনিক চরিত্র। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, ২০১৫
ছবি: উইকিপিডিয়া

দেবতা মারকারির পরনে দেখা গেছে খড়ের টুপি, সেই রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম দিকে বানানো তাঁর মূর্তিতে। প্রাচীন ইউরোপ আর এন্টোলিয়া অঞ্চলের গ্রামীণ সমাজের মানুষের মধ্যে গাছের তন্তু বা খড় দিয়ে নানা রকম টুপি পরার ইতিহাস জানা যায়। এ ছাড়া প্রাচীন চীনা সমাজ ও মায়া সমাজে খড়ের টুপির চল ছিল। এর পরে ফেল্ট আবিষ্কার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হ্যাট শিল্পে এক বিপ্লব ঘটে যায়। প্রাচীনকালের রোমান ও গ্রিক সমাজে ফেল্টের তৈরি ডিম্বাকৃতির হ্যাট পরা হতো বলে জানা যায়।

পুরুষের হ্যাট ফ্যাশন

পুরুষের ফ্যাশনে কাউবয় হ্যাট
ছবি: ব্রেট সিলেস, পেকজেলস ডট কম

পশ্চিমা বিশ্বে পুরুষেরা বিশেষ রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে যে হ্যাটগুলো পরিধান করে থাকেন, তার বেশির ভাগই ফেল্ট দিয়ে তৈরি। ফেল্ট হচ্ছে যেকোনো প্রাকৃতিক তন্তু চেপে চেপে আঠালো কোনো কিছুর সাহায্যে দুই দিক থেকে সমান পুরুত্বে তৈরি করা শিট। ফেল্টের টুপিতে রং ও ডিজাইনের বৈচিত্র্য দেখা যায়। ফেল্টের টুপির এক বিশেষ উদাহরণ হচ্ছে বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল সাহেবের হম্বার্গ হ্যাট। তাঁর পরিচয় আর প্রতিকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাওয়া এই টুপি এখনো জনপ্রিয়। একই সঙ্গে চলে আসে কিংবদন্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের লম্বা কালো ফ্ল্যাট টপ হ্যাট। এখন সেই টুপিকেই সাধারণভাবে বোউলার বা ডার্বি হ্যাট বলা হয়।

উনিশ ও বিশ শতকে ব্যবহৃত হওয়া কিছু হ্যাট
ছবি: উইকিপিডিয়া

এ ছাড়া বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পশ্চিমা হ্যাটের মধ্যে নেপোলিয়নের বাইকর্ন টুপির কথা বাদ দিলে কি হয়! দুই কোনাবিশিষ্ট এই বাইকর্নের আরেকটি রূপ হলো তিন কোনাবিশিষ্ট ট্রাইকর্ন। তবে ফরাসিদের আবিষ্কৃত এই সাড়া জাগানো টুপির প্রচলন এখনকার আধুনিক সমাজে এখন আর নেই। বর্তমানে প্রচলিত পুরুষদের পরিধেয় হ্যাটগুলোর মধ্যে আরও আছে নরম ফেল্টের তৈরি ফেডোরা হ্যাট আর ব্যাটারড টপ হ্যাট। এই দুই হ্যাটেই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ খাঁজ আর গর্ত থাকে।

নারীর ফ্যাশনে হ্যাট

পশ্চিমের ফ্যাশনে হ্যাট গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ
ছবি: পিক্সবে, পেকজেলস ডট কম

ষোড়শ শতাব্দীর প্রাক্কালে মেয়েদের যখন ঘরের বাইরে পদচারণ বেড়ে গেল, তখন খালি মাথায় মেয়েদের বের হওয়া সমাজে ভালো চোখে দেখা হতো না। বনেট বা স্কার্ফের সঙ্গে সঙ্গে তখন মেয়েরাও হ্যাট পরা শুরু করেন জীবনের প্রয়োজনে এবং সেই সঙ্গে ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবেও। সেই ধারাবাহিকতাতেই খড়, কাপড় আর ফেল্টের টুপিতে আসল বর্ণিল এমব্রয়ডারি, রঙিন পালক আর চোখ ধাঁধানো কারুকাজ। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথসহ ব্রিটিশ রাজপরিবারের নারী সদস্যদের মনোলোভা ডিজাইনের সব বৈচিত্র্যময় হ্যাট ছাড়া দেখাই যায় না। ইউরোপের অন্যান্য দেশের রাজপরিবারের নারীরাও শৌখিন সব হ্যাট পরে থাকেন। বিভিন্ন বিখ্যাত ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে হ্যাট না পরে অংশই নেন না নারীরা। ১৮৭৫ সাল থেকে চলে আসা বিখ্যাত কেন্টাকি ডার্বি তার মধ্যে একটি।

আমেরিকান কাউবয় হ্যাট

কাউবয় হ্যাট
ছবি: ব্রেট সিলেস, পেকজেলস ডট কম

হলিউডের চলচ্চিত্রের কাউবয় হ্যাটের গল্প বাদ দিলে হ্যাটের সাতকাহন অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে। বর্তমানে স্টেটসন হ্যাট বলে পরিচিত এই টুপির ইতিহাসও কম লম্বা নয়। সেই আদিকালে শিকার করা পশুর চামড়া শুকিয়ে তা দিয়ে এই অদ্ভুত রকমের বাঁকানো পাশওয়ালা হ্যাট বানানো হতো। আধুনিক যে ফেল্ট দিয়ে তৈরি হ্যাট পাশ্চাত্য সমাজে বহুল প্রচলিত, হলিউডের কাউবয় মুভিগুলোর হিরোদের পরিধেয়, সেই বারান্দাওয়ালা টুপি প্রথম তৈরি হয়েছিল সেই ১৭০০ সালের দিকে।

স্টেটসন হ্যাট
ছবি: উইকিপিডিয়া

পরে ১৮৬৩ সালে স্টেটসন কোম্পানি এই হ্যাট তৈরি করে বাণিজ্যিক সফলতা পায়। কাউবয়রা সেই বহু যুগ আগে সত্যি সত্যি এই হ্যাট পরত কি না, তা কেউ না জানলেও আমেরিকার দক্ষিণাংশের প্রদেশগুলো যেমন টেক্সাস, অ্যারিজোনায় এই স্টেটসন হ্যাট এক অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাশন অনুষঙ্গ।

পশ্চিমা হ্যাট সংস্কৃতি এখন আমাদের কাছে খুবই পরিচিত আর জনপ্রিয়
ছবি: ঝু পেং, পেকজেলস ডট কম

বিশ্বের বর্তমান প্রজন্মের কাছে ঐতিহ্যবাহী পশ্চিমা হ্যাটগুলোর প্রতি আগ্রহ অনেকটাই বাড়িয়েছেন ব্রিটিশ রাজপরিবারের ছেলে উইলিয়াম আর তাঁর স্ত্রী কেট মিডলটন। আর কাউবয় হ্যাট বা স্টেটসন হ্যাটের সর্বজনীন আবেদন তো চিরন্তন।

পশ্চিমা হ্যাট সংস্কৃতি এখন আমাদের কাছে খুবই পরিচিত আর জনপ্রিয়। আজকাল বিভিন্ন ফ্যাশন ইভেন্ট বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পশ্চিমা পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে বিচিত্র সব হ্যাটের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে আমাদের উপমহাদেশেও।