সুরভিত জোনাকি

বাংলাদেশের প্রথম ফাইন ফ্রেগ্রান্স জোনাকিছবি: জোনাকি
সৌরভের সৌন্দর্যই হলো সে হৃদয়ের কথা বলে, যেমন আপনার, তেমন অন্যেরও।
এলিজাবেথ টেলর

সৌরভ প্রশান্তিদায়ক; পরিচয় নির্ণয়ক; ব্যক্তিত্বের স্বরূপ প্রকাশকও। এ জন্যই হয়তো শ্যানেল কিঞ্চিৎ রূঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, সুগন্ধি ব্যবহার না করা নারীদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আর তিনিই তো বিশ্বের প্রথম নারী ফ্যাশন ডিজাইনার, যিনি বাজারে এনেছিলেন সুগন্ধি। শ্যানেল ফাইভ নামের এমন এক সুরভি, যা আজও ভুবন মাতিয়ে চলেছে।

ছবি: জোনাকি

যা হোক, আপনার পাশ দিয়ে হঠাৎ কেউ চলে গেল সুবাস ছড়িয়ে, আপনি বিমোহিত হলেন। কিংবা কোনো সুগন্ধে আপনি ঠিকই চিনে নিলেন তাকে। সুগন্ধির এটাই তো বিশেষত্ব। চমৎকারিত্বও বটে। ‘আ জুয়েলারি স্টোর নেমড ইন্ডিয়া’; সুজি কাসেমের কবিতাটির শেষ দুটো লাইন আমাকে মুগ্ধ করে, ‘টু দ্য ভাইব্রেশনস/ অব দ্য পারফিউমড/ উইন্ড।’ দারুণ না? সুরভিত বাতাস।

সুরভি নিয়ে এত কথার কারণ, কিছুদিন হলো বাংলাদেশের বাজারে এসেছে সুগন্ধির দেশি ব্র্যান্ড। নামটাও ষোলআনা দেশি—জোনাকি। এই উদ্যোগের নেপথ্য ব্যক্তিত্ব নাসরীন জামির। বাংলাদেশের প্রথম ব্যাকরণসিদ্ধ অন্দর–নকশাবিদ। এই সুগন্ধি, তাঁর ভাষায়, বাংলাদেশের নয়নাভিরাম নিসর্গের মহিমাকীর্তন। সঙ্গে যোগ করতে ভোলেননি যে তিনি বাংলাদেশের বাজারে নিয়ে এসেছেন ফাইন ফ্রেগ্রান্স। যেটা এর আগে আর কেউ করেনি।

নাসরীন জামির
ছবি: জোনাকি

অন্দর–নকশাবিদ থেকে কেনই–বা সৌরভ ছড়ানোর প্রয়াস—এ প্রশ্ন নাসরীন জামিরকে সচরাচর শুনতেই হচ্ছে। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে অভিন্ন প্রসঙ্গে চমৎকার একটি ঘটনার অবতারণা করেন তিনি। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর, নিজের অফিসে বসে এক ফরাসি বন্ধুর সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গেই আসে পারফিউম তৈরির বিষয়টি। কারণ, বন্ধুটি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আর কী করতে চান তিনি।

উত্তর ছিল, পারফিউম বাজারে আনবেন।

বিষয়টি নাসরীন জামির গুরুত্বসহকারে নিয়েছিলেন। সে জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দেন সে বছরের ডিসেম্বরেই। চলে বিস্তর খোঁজখবর নেওয়া। আর তথ্য–উপাত্ত ঘাঁটাঘাঁটি। এরপর শুরু করেন অনলাইনে শিক্ষাগ্রহণ। টানা দুই বছর নিজেকে নিয়োজিত রাখেন সুগন্ধিসংক্রান্ত গবেষণা ও পারফিউমের সৌরভ নির্ধারণ, আধার ও মোড়ক নকশায়।

এর মধ্যে নাসরীন জামির বিভিন্ন দেশের সুগন্ধি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে গেছেন। ঘুরে দেখেছেন। কথা বলেছেন। তারপর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তাঁর সব ডিজাইন তিনি নিজের স্টুডিওতে বসেই করেন। তারপর চলে যান মালয়েশিয়ায়। সেখানেই তৈরি হয় সুগন্ধি। তারপর বোতলজাত হয়ে আসে বাংলাদেশে।

কিছুদিন হলো বাংলাদেশের বাজারে এসেছে সুগন্ধির দেশি ব্র্যান্ড। নামটাও ষোলআনা দেশি—জোনাকি। এই উদ্যোগের নেপথ্য ব্যক্তিত্ব নাসরীন জামির। বাংলাদেশের প্রথম ব্যাকরণসিদ্ধ অন্দর–নকশাবিদ।

তবে সেই ২০১৫ সালে নাসরীন জামির জোনাকির যে ছবি এঁকেছিলেন অন্য কাজের জন্য, সেটাই চার বছর পরে এসে হয়ে যায় তাঁর নতুন উদ্যোগের পরিচয়চিহ্ন, লোগো। প্রায় দেড় দশক আগে তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুবাদে এটুকু অন্তত জানি, তিনি ভীষণই পারফেকশনিস্ট। ফলে, এখানেও সে পরিচয় মেলে। বেশ জোর দিয়ে তাই বললেন, জোনাকি কোনো ক্লোন সুগন্ধি নয়, বরং একেবারে নতুন। এর মান আন্তর্জাতিক আর দাম সাধ্যের মধ্যেই।

কথায় কথায় নাসরীন জামির জানালেন, এই আয়োজনে রয়েছে তাঁর শৈশবস্মৃতি। চট্টগ্রামে ছেলেবেলায় দেখা পাহাড় আর বনানীর মিতালি, জোনাকিদের বিচরণ, বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির এই সৌন্দর্যকেই যেন তিনি বোতলে ভরে উপহার দিচ্ছেন সুগন্ধিপ্রিয় বাঙালিকে। নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই রয়েছে জোনাকি। নারীদের জন্য ফুল ও লেবুর সতেজতার পাশাপাশি পুরুষের জন্য রয়েছে বন্য, কস্তুরিময় সৌরভ।

ছবি: জোনাকি

আপাতত পাঁচ ধরনের সুগন্ধি রয়েছে বাজারে। মেয়েদের জন্য নেরোলি ব্লসম, ফ্রেসিয়া নাইটস আর ওরিয়েন্টাল জেসমিন এবং ছেলেদের জন্য আমারেত্তো ও স্যান্টাল টাবাক।

সুগন্ধির তিনটি স্তর থাকে। টপ নোট, মিডল নোট আর বেস নোট। টপ নোটকে হেড নোট আর মিডল নোটকে বা হার্ট নোটও বলা হয়। এখানে সংগীতের সেই অস্থায়ী, অন্তরা আর আভোগের যেন মিল পাই। টপ নোট বস্তুত কোনো সুগন্ধি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেয়। এটা দ্রুত মিলিয়ে যায়। মিডল নোট বা হার্ট নোট নিজেকে মেলে ধরে টপ নোট মিলিয়ে যাওয়ার পর। আর মধ্যম মেলাতে মেলাতেই এসে পড়ে আভোগ বা বেস নোট। এটাই দীর্ঘস্থায়ী হয়।

ছবি: জোনাকি

জোনাকির পারফিউমেও এই নোটগুলোয় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তিন নোটের পর্যায়ক্রম: ফ্লোরোলা ব্লসমে হলো সিট্রাস নেরোলি-মাস্ক-সিট্রাস ফ্লোরাল, ফ্রেসিয়া নাইটসে ফ্রেসিয়া-বারগ্যামট-রোজ-ওয়াটারলিলি-মাস্ক, ওরিয়েন্টাল জেসমিনে বারগ্যামট-স্যান্ডলউড-পাচুলি, আমেরেত্তোতে সিট্রাস, ব্ল্যাকপেপার, নেরোলি-রোজমেরি, আমেরেত্তো-লেদার, সেডারউড, ভেটিভার আর স্যান্টাল টাবাকে জেরানিয়াম, বেসিল-ল্যাভেন্ডার, সাইপ্রেস, টোব্যাকো-স্যান্ডলউড, ল্যাবডানাম, মাস্ক।

আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করার সব চেষ্টাই নাসরীন জামির করেছেন। তাই মোট ১২টি নমুনা থেকে তিনি প্রাথমিকভাবে বেছে নেন ৫টি। প্রতিটি ৫০ মিলির বোতল। তাঁর এই সুগন্ধি অউ ডি টয়লেট হলেও পারফিউম ওয়েলের পরিমাণের নিরিখে অনায়াসেই পারফিউম হিসেবে গণ্য করা চলে।

বর্তমানে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করলেও জোনাকির ওয়েবসাইটে (https://jonakifragrance.com/) লগইন করে কেনা যাবে অনায়াসে। বিনা মূল্যে পৌঁছে দেওয়ার অফার ৩১ আগস্ট শেষ হয়ে গেলেও সেপ্টেম্বরজুড়ে বিনা মূল্যে প্রতিটি বোতলের সঙ্গে মিলবে ৮ মিলির বোতল।

সুগন্ধির তিনটি স্তর থাকে। টপ নোট, মিডল নোট আর বেস নোট। টপ নোটকে হেড নোট আর মিডল নোটকে বা হার্ট নোটও বলা হয়। এখানে সংগীতের সেই অস্থায়ী, অন্তরা আর আভোগের যেন মিল পাই।

সুগন্ধের রয়েছে প্রাণিত করার অদ্ভুত শক্তি, যা শব্দ, উপস্থিতি, আবেগ বা ইচ্ছার চেয়েও শক্তিশালী। সুগন্ধের এই ক্ষমতা অপ্রতিরোধ্য। ফুসফুসে প্রশ্বাস প্রবেশের মতো ভেতরে ঢুকে আমাদের সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে ফেলে। তখন আর এর থেকে যেন বের হওয়া যায় না। প্যাট্রিক সাসকাইন্ডের ‘পারফিউম: দ্য স্টোরি অব আ মার্ডারার’–এর এই বর্ণনা যেকোনো সুগন্ধির ক্ষেত্রেই সত্যি। জোনাকিও এর বাইরে নয়।