বনসাই করবেন?

৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে বনসাই নিয়ে কাজ করছেন মোহাম্মদ আনিসুল হক
ছবি: কবির হোসেন

পুরান ঢাকার আগামসিহ লেন। পুরোনো ভবনের পুরোনো ধাঁচের সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতেই বিস্ময়! ছাদের সর্বত্র, এমনকি সিঁড়িঘরের ওপরে পর্যন্ত, সারি সারি বনসাই। সব মিলে দেশি-বিদেশি প্রায় ৭০ প্রজাতির পাঁচ শতাধিক হবে। তাদের কচি কচি সবুজ পাতা, টুকটুকে লাল ফুল, কোনো কোনোটা থেকে আবার উঁকি দিচ্ছে ফল। সবচেয়ে বর্ষীয়ান গাছটির বয়স প্রায় ৬০ বছর! পাকুড়গাছের এই বনসাইয়ের দাম ৬ লাখ টাকা! বিশাল বড় বড় গাছের এমন ছোট সংস্করণ যে জাদুকরের হাতের ছোঁয়ায় সম্ভব হলো, আমরা তাঁর কাছেই এসেছি। মানুষটার নাম মোহাম্মদ আনিসুল হক। ‘বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটি’র তিনি সাধারণ সম্পাদক। ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে বনসাই নিয়েই আছেন তিনি। বনসাইয়ের টব সাধারণত ছোট ও মাটির পরিমাণ কম থাকে বলে কিছুটা বাড়তি যত্নের প্রয়োজন পড়ে। কী সেই যত্ন, সেটাই আমাদের হাতে–কলমে দেখাবেন আনিসুল হক।

আরও পড়ুন
প্রথমবারের মতো যাঁরা বনসাই করতে চাইছেন, বনসাইয়ের মৌলিক বিষয়গুলো জেনে নেবেন
ছবি: কবির হোসেন

আনিসুল হক বললেন, ‘আমার শুরুটা হয়েছিল কোনো এক ম্যাগাজিনে ছাপা ছবি দেখে, পরে বই পড়ে পড়ে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটিতে যোগ দেওয়ার পর ২০০৩ ও ২০০৫ সালে জাপান দূতাবাসের সহযোগিতায় বনসাইয়ের ওপর দুবার প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ হয়। ওই দুই বছরের প্রতিবারই টানা দুই দিন হাতে–কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন সুসুমু নাকামুরা নামের এক জাপানি প্রশিক্ষক। পাশাপাশি তিন দিনের প্রদর্শনী চলত, তিনি প্রদর্শনী ঘুরে ঘুরে গাছের ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে দিতেন। ২০০৫ সালে আমার ছাদবাগানে এসে প্রতিটা গাছ ধরে ধরে কোন গাছের কী কী করা প্রয়োজন, সরাসরি বুঝিয়েছেন। তখন থেকেই ল্যান্ডস্কেপসহ বনসাইয়ের দক্ষতা বাড়ে।’

প্রথমবারের মতো যাঁরা বনসাই করতে চাইছেন, বনসাইয়ের মৌলিক বিষয়গুলো জেনে নেবেন। কিছু গাছকে বনসাইতে রূপ দিতে বেশি সময় লাগে, আবার কিছু গাছকে ১-২ বছরেই বনসাইয়ে রূপান্তরিত করা সম্ভব। প্রেমনা তেমনই একটি গাছ, যাকে খুব কম সময়ে বনসাই করা যায়। চারপেয়ে লম্বাটে টেবিলের ওপর মাটির টবে রাখা একটি প্রেমনাগাছের পাতা ও ডালপালা কাঁচি দিয়ে ছাঁটতে ছাঁটতে আমাদের বনসাইয়ের পরিচর্যা সম্পর্কে ধারণা দিতে থাকলেন আনিসুল হক।

বনসাইকে এমন জায়গায় রাখতে হবে, যেখানে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সূর্যের আলো পড়ে
ছবি: কবির হোসেন

রাখার জায়গা

বনসাইকে এমন জায়গায় রাখতে হবে, যেখানে কমপক্ষে ৩-৪ ঘণ্টা সূর্যের আলো পড়ে। সারা দিন রোদ পেলে বনসাইয়ের জন্য আরও ভালো।

পানি

সব গাছের পানির শোষণক্ষমতা সমান নয়। তাই সমানতালে সব গাছে পানি না দিয়ে অন্যান্য গাছের মতোই বনসাইয়ের মাটি শুকিয়ে এলে তবেই পানি দিন। মাটিতে ভেজা ভাব থাকলে পানি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। পানি দিতে হবে সকাল বা সন্ধ্যায়। দুপুরের তপ্ত রোদে কখনোই নয়। যেসব বনসাইয়ের মাটি খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়, প্রয়োজনে সেখানে দুবারও পানি দেওয়া যায়। সপ্তাহে অন্তত একবার স্প্রে করে পুরো গাছকে ধুয়ে দিতে হবে।

আরও পড়ুন
নতুন যে টবে গাছ বসাবেন, তাতে অবশ্যই সহজে পানি সরার মতো ছিদ্র থাকতে হবে।
ছবি: কবির হোসেন

সার

বনসাইয়ের জন্য জৈব সার উত্তম।

৩ ভাগ শর্ষে বা তিলের খৈল ও ১ ভাগ হাড়ের গুঁড়া পরিমাণমতো পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন রেখে পচাতে হবে। মিশ্রিত ঘন তরল সারের ১ কাপ ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে নিতে হবে। বড় বনসাইয়ের জন্য ২ কাপ ও ছোট বনসাইয়ের জন্য ১ কাপ করে দিন। এই সার সাধারণত ২৫-৩০ দিন পরপর বনসাইয়ে প্রয়োগ করা যায়। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি—শীতের এ সময়ে গাছে সার না দেওয়াই ভালো। সবচেয়ে ভালো বর্ষার আগে ও বর্ষার পরে সার প্রয়োগ।

বর্তমানে বাজারে বনসাইয়ের জন্য বিশেষায়িত কিছু জৈব কেক সার পাওয়া যায়। বনসাইয়ের জন্য সবচেয়ে ভালো এই সার, ব্যবহারও সহজ। এই সার বনসাই টবের চারদিকে পুঁতে দিতে হয়। মাসে সাধারণত একবার ব্যবহার করলেই যথেষ্ট।

রাসায়নিক সার বনসাইতে প্রয়োগ না করাই ভালো। তবে প্রয়োজন হলে ১ ভাগ ইউরিয়া (২০ শতাংশ), ২ ভাগ টিএসপি (৪০ শতাংশ) এবং ২ ভাগ পটাশ (৪০ শতাংশ) মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। মিশ্রিত এই সার থেকে ২ চা-চামচ সার দুই লিটার পানিতে মিশিয়ে এক কাপ পরিমাণ সার প্রতিটি বনসাইয়ের গোড়ায় প্রয়োগ করা যাবে।

ছাঁটাই

নিয়মিত প্রুনিং বা ডালপালা ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে বনসাই গাছকে নির্দিষ্ট আকারে ধরে রাখতে হবে। না হলে ধীরে ধীরে নিজেকে ‘বনসাই বলে দাবি করার মতো’ অবয়ব হারিয়ে ফেলবে গাছ।

বনসাইয়ের বিভিন্ন রূপের মধ্যে আছে ফরমাল আপরাইট বা সোজা, ইমফরমাল আপরাইট বা বাঁকানো, কাসকেড, সেমিকাসকেড, রাফ্‌ট।

কাঁচি, সিকেচার, ওয়্যার হোল্ডার, নব কাটার, কনকেভ কাটার ইত্যাদির সাহায্যে বনসাইয়ের প্রুনিং সহজে করা যায়।

বনসাইয়ের জন্য জৈব সার উত্তম
ছবি: কবির হোসেন

টব বদল

বনসাইকে শুরুতেই সরাসরি বনসাইয়ের জন্য বিশেষায়িত টবে প্রতিস্থাপন না করে তুলনামূলক বড় টবে ঠাঁই দেওয়া উচিত। পরে মাঝারি ও সবশেষে বনসাই টবে স্থানান্তর করতে হবে। এক টব থেকে তুলে অন্য টবে স্থানান্তরের সময় খুব সাবধানে মাটির বলসহ বনসাইটি তুলতে হবে। তুলে ধরা মাটির বলটির নিচের একপ্রস্থ মাটি ফেলে সেখানে থাকা শিকড় কেটে ছাঁটাই করতে হবে। তবে বাগানবিলাস, শেওড়া ও রন্ডেলেসিয়ার মতো কিছু গাছের শিকড় খুব সংবেদনশীল। এসব গাছের শিকড় খুব বেশি প্রয়োজন না হলে না ছাঁটাই ভালো।

নতুন যে টবে বসাবেন, তাতে অবশ্যই সহজে পানি সরার মতো ছিদ্র থাকতে হবে। ছিদ্রের ওপর ইটের খোয়া বা মাটির টবের ভাঙা অংশ রেখে ওপরে নতুন করে সার মিশ্রিত মাটি যোগ করুন। তুলে রাখা বনসাইটি ভালোভাবে নতুন টবে বসিয়ে পানি দিন। টব পরিবর্তন করতে না চাইলে টবের কিনারাঘেঁষা কিছু মাটি তুলে ফেলুন। সেখানে জৈব সার মিশ্রিত নতুন মাটি যোগ করা যেতে পারে। নিয়মিত টব বা টবের মাটি পরিবর্তন না করলে শিকড় জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে গাছ মারাও যেতে পারে।

রোগ প্রতিরোধে করণীয়

বনসাইকে সব সময় পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন এবং নিয়মিত সার-পানি দিয়ে পরিচর্যা করে গেলে অধিকাংশ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। বনসাইয়ের মোটা ডাল বা কাণ্ড মাঝেমধ্যে টুথব্রাশ দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করতে পারেন। তাহলে পোকামাকড় বাসা বাঁধবে না কিংবা ছত্রাকের সংক্রমণও হবে না। মাত্রাতিরিক্ত কীটপতঙ্গের আক্রমণ হলে ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানের তৈরি ক্লোরপাইরিফস গ্রুপের ওষুধ ব্যবহার করলেই চলবে। যেমন: ডারসবান, মর্টার, ম্যালাথিয়ান ইত্যাদি। ছত্রাকের সংক্রমণ হলে ডায়াথেন এম-৪৫, রিডোমিল গোল্ড বা ম্যানকোজেব গ্রুপের যেকোনো ছত্রাকনাশক ব্যবহার করলেই সংক্রমণ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

ছত্রাকের সংক্রমণ কিংবা পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রতিরোধে ওষুধ প্রয়োগের আগে মাত্রা দেখে নিন। মাত্রা অনুসারে ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। ভেজা অবস্থায় গাছে ওষুধ প্রয়োগ করতে নেই। ওষুধ প্রয়োগের সাত দিনের মধ্যে গাছের গায়ে কোনো পানি না দেওয়াই ভালো। তবে মাটিতে পানি দেওয়া যাবে। মাটিতে কেঁচো বা পিঁপড়ার উপস্থিতি দেখা গেলে মাটিতেও পানির সঙ্গে ওষুধ মিশিয়ে ব্যবহার করা যাবে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, ওষুধ যত কম ব্যবহার করা যায়, ততই ভালো। অকারণে ওষুধ প্রয়োগ গাছ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

আরও পড়ুন