কোন বয়সী শিশুকে কেমন শাসন করবেন

সন্তানকে কোন বয়সে কীভাবে শাসন করা উচিত, অনেক মা-বাবাই ঠিক বুঝতে পারেন না। শিশুর জেদকে কতটা প্রশ্রয় দেওয়া যায়, না রেগেও কীভাবে বোঝাতে হয়, সেটাও অনেকের কাছে পরিষ্কার নয়। বয়স অনুযায়ী শিশুর আচরণ ও করণীয় জেনে নিতে পারেন এখানে।

শিশুকে বোঝানোর আগে জানতে হবে, কেন সে জেদ বা রাগ করছে
ছবি: কবির হোসেন

পাঁচ বছর বয়সী মারুফ ঠিকমতো খেতে চায় না। তবে হাতে মুঠোফোন ধরিয়ে দিলেই মুশকিল আসান। কোনো ঝামেলা করে না। ভিডিও দেখতে দেখতে খাবার খায়। চাকরিজীবী মা-বাবা প্রথম দিকে এতে খুশিই ছিলেন। সন্তানের হাতে মুঠোফোন তুলে দিতেন নির্দ্বিধায়। মা ভেবেছিলেন, সন্তানকে শান্ত রাখার একটা উপায় তো পাওয়া গেল। কিন্তু ধীরে ধীরে হিতে বিপরীত হয়ে গেল। মুঠোফোন দেখতে দেখতে কোনো কাজ করার অভ্যাস এতই বেড়ে গেল যে এখন আর মারুফকে সামলানো যায় না। স্কুল থেকে এসে খাওয়ার আগে ও পরে বা গোসলের আগে সে শর্ত জুড়ে দেয়, ‘ফোন দিলে তারপর করব।’ এতে বাসার সবাই বিরক্ত। মা রেগে গিয়ে প্রায়ই তাকে কঠোর শাসন করেন। প্রচণ্ড বকাঝকা করেন, কখনো মারধরও করে বসেন। কিন্তু এই শাসনে মারুফের উন্নতি তো হচ্ছেই না, উল্টো সে হয়ে উঠছে অতিরিক্ত বদমেজাজি। 

আরিফ (ছদ্মনাম) নামের আরেকজনের কথাও বলা যায়। তিনি এখন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া। তবে তাঁর শৈশবের কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। আরিফের মা আরজু বেগম (ছদ্মনাম) স্কুলশিক্ষক। আরিফ যখন একেবারে ছোট, তখন থেকে আরিফের বয়সী সব শিশুর কাছ থেকে আলাদা করে রাখতে চাইতেন। ক্লাসের দুষ্টু ছেলেদের সঙ্গে মিশে তাঁর ছেলে খারাপ হয়ে যাবে, এটাই ছিল তাঁর ভয়। কিন্তু মায়ের অতিরিক্ত কড়া শাসনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে অচিরেই। বন্ধুরা আরিফকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। ক্লাসে তার সঙ্গে কেউ বসে না, খেলার মাঠে খেলতে নেয় না। ফলে একরকম নিঃসঙ্গভাবেই বেড়ে উঠতে থাকে সে। শৈশব শেষে কৈশোরে পড়ালেখার প্রয়োজনে আরিফ একসময় হোস্টেলে থাকতে শুরু করে। তবে মায়ের চোখের আড়াল হতেই আরিফ হাঁটতে থাকে উল্টো পথে। মা যা বলেন, তার উল্টোটা করতে থাকে সে।

ওপরের দুটি সত্য ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার, সন্তানের লালন–পালন ও শাসন সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। কারণ, নিজের মতো করে শাসনের যেসব পদ্ধতি আমরা প্রয়োগ করি, তা ভালো ফল এনে দেয় না অনেক ক্ষেত্রে। আবার শিশুর বয়স অনুযায়ী শাসনের ধরনে যে পরিবর্তন দরকার, এটাও আমরা অনেকে জানি না বা বুঝতে চাই না।

মনোবিদ কী বলেন

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রেজওয়ানা হাবীবা মনে করেন, বয়স অনুযায়ী শিশুরা যেভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠে, একইভাবে শাসনেও কিছুটা ভিন্নতা আছে। আদতে শিশুদের শেখানো একটা চলমান প্রক্রিয়া। এখানে মা-বাবা এবং পরিবারের অন্যান্য অভিভাবকের ভূমিকাই বেশি। মনে রাখতে হবে, শিশুকে কোনো নিয়মকানুন শেখানোর পরই আসে সেই নিয়ম মানা বা না মানার বিষয়টি।

উদাহরণ দিয়ে এই মনোবিদ বলেন, শিশুকে ‘টডলার’ বয়স, অর্থাৎ ১-৩ বছর থেকেই শেখাতে হবে যে ডাস্টবিন বা ময়লার ঝুড়িতে ময়লা ফেলতে হয়। যখন সে ফেলবে, হাততালি বা আদর দিয়ে তাকে উৎসাহিত করতে হবে। যদি সে না করে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাজটি করাতে হবে। এভাবে এক কাজের মাধ্যমেই শিশুকে উৎসাহ এবং করণীয়, দুটোই শেখানো হয়ে যায়। তবে এই প্রথম শেখানোর দায়িত্ব কিন্তু মা-বাবারই।

শাসন মানেই কি শাস্তি

আমাদের অনেক অভিভাবকের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে শাসন মানেই শাস্তি। ফলে অনেকেই শাসন ও শাস্তিকে গুলিয়ে ফেলেন। আদতে কী তা-ই? 

ডা. রেজওয়ানা হাবীবা বলেন, ‘সন্তানকে বড় করা মানে শুধু খাওয়া-পরা নিশ্চিত করা নয়; তার সুষ্ঠু বিকাশের জন্য সুরক্ষা এবং যত্ন নিশ্চিত করাও এই প্রক্রিয়ার অন্যতম অংশ। এ জন্য শুধুই ভালোবাসা বা শুধুই শাসন, কোনোটাই হওয়া উচিত নয়। সোজা কথায় প্যারেন্টিং হচ্ছে সন্তান লালন–পালনে ভারসাম্য বজায় রাখা। আদতে শাসন ও শাস্তি একেবারেই আলাদা দুটি বিষয়। এসবের ব্যাপ্তিও আলাদা। সন্তান পালনে শাসন কিংবা নিয়মকানুন মানানোর বিষয় থাকে। এতে শাস্তি যত কম থাকবে, তত ভালো।’

শাসন ও শাস্তি একেবারেই আলাদা দুটি বিষয়
ছবি: প্রথম আলো

তবে জীবনে পরিকল্পনামতো সব ঘটে না। সব সঠিক প্রক্রিয়া মেনে চললেও সন্তান কিছুটা বিশৃঙ্খল হতে পারে। থাকতে পারে নিয়ম না মানার বাতিক। অনেক সময় মাত্রাতিরিক্ত জেদ ও বেয়াদবি সীমা অতিক্রম করে। তখন করণীয় কী?

ডা. রেজওয়ানা হাবীবার মতে, ‘সন্তান অতিরিক্ত জেদ, রাগ বা দুষ্টামি করতে পারে। তাকে বোঝানোর আগে জানতে হবে, কেন সে জেদ বা রাগ করছে। পারিপার্শ্বিক কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমস্যা বা ব্যক্তিগত কারণেও এমনটা হতে পারে। সেসবের সমাধান করলে এই সমস্যাও কেটে যাবে।’

তবে কারণ ছাড়াই অতিরিক্ত রাগ বা জেদ করলে স্পষ্ট করে সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। চাইলেই বা জেদ দেখালেই যে সব পাওয়া যায় না কিংবা পেতে হলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে, এসব ব্যাপার সন্তানকে শান্ত কণ্ঠে, স্পষ্ট ভাষায় জানাতে হবে। এসব ক্ষেত্রে চিৎকার-চেঁচামেচি ও মারধর করলে শিশুর রাগ-জেদ কমবে না বরং বাড়বে।

এ ছাড়া সন্তানকে আগেই তার করণীয় বোঝাতে ও জানাতে হবে। এই কাজ না করলে তার সমস্যা হবে কিংবা শাস্তি পেতে পারে, সে সম্পর্কেও ধারণা দিতে হবে। তবে শাস্তির মতো অবস্থায় গেলেও আগে সাবধান করা উচিত। শাসন করার ক্ষেত্রেও অভিভাবকদের সামঞ্জস্য রাখা দরকার। যেমন লেখাপড়া না করায় এক দিন কিছু বলেননি অথচ পর দিন পিটুনি দিলেন। এতে শিশু সঠিক বার্তা পাবে না।

আরও পড়ুন

সন্তানকে এখন প্রযুক্তি থেকে শতভাগ দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কাজের ক্ষেত্রেও তাদের প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হয়। তবে নির্ধারণ করা যায় সীমা। যেমন পড়াশোনা শেষে কিংবা ভালো কাজ করলে সে আধা ঘণ্টা মুঠোফোন হাতে পেতে পারে বা সপ্তাহে এক ঘণ্টা। তবে শিশু মুঠোফোন, ট্যাব বা ল্যাপটপে কী দেখছে, সেটা খেয়াল রাখা জরুরি।

শাসনের পাশাপাশি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ডা. রেজওয়ানা হাবীবার পরামর্শের প্রথমেই আছে ‘পজিটিভ প্যারেন্টিং’। আর এটির মূল ব্যাপারই হলো ধৈর্য। এ ছাড়া শাসনের ধরনে ধারাবাহিকতা, অভিভাবক নিজে নিয়মানুবর্তী হয়ে সন্তানকে শেখানো ও উৎসাহ দেওয়া, সন্তানের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটানো, সন্তানের মতামতের গুরুত্ব দিয়ে অতিরিক্ত বোঝা না চাপানো এবং চাওয়া-পাওয়ার সীমাবদ্ধতার বিষয়ে ধারণা দেওয়া ইত্যাদি বিষয় অভিভাবককে গুরুত্বের সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

'পজিটিভ প্যারেন্টিং’–এর মূল ব্যাপারই হলো ধৈর্য
ছবি: কবির হোসেন

শিশুর কোন বয়সে কেমন শাসন

শিশুকে শাসন করা কিংবা জীবনের স্বাভাবিক শৃঙ্খলার শিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শাসন করতে গিয়ে প্রথমে আমাদের মাথায় আসে ‘কঠোর অভিভাবক’ শব্দ দুটি। কিন্তু সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেকে কঠোর হতে চান না বা অনেকে পারেন না। বরং সব সময় আদরের মধ্যে রাখা, ছোট ছোট ভুল না শুধরে দিয়ে উপভোগ করা ইত্যাদিতেই আমরা অভ্যস্ত। এর উল্টো চিত্রও আছে। অতিরিক্ত কড়া শাসন কখনো শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠাকেই বাধাগ্রস্ত করে।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, শিশুর মানসিক সুস্থতার জন্য মা-বাবার দৃঢ়তা এবং সুশাসনের ধরনে ধারাবাহিকতা জরুরি। শিশু চাইলেই সব পেয়ে যাবে, এমনটা অনেক ক্ষেত্রেই ভালো ফল দেয় না। বরং সন্তানকে শাসন বা শৃঙ্খলাবদ্ধ না করলে, তার দুষ্টুমি বেড়ে যেতে পারে, যা ভবিষ্যতে হতে পারে বড় সমস্যার কারণ।

সন্তানকে কোন বয়সে কীভাবে শাসন করা উচিত, অনেক মা-বাবাই ঠিক বুঝতে পারেন না। শিশুর জেদকে কতটা প্রশ্রয় দেওয়া যায়, না রেগেও কীভাবে বোঝাতে হয়, সেটাও অনেকের কাছে পরিষ্কার নয়। বয়স অনুযায়ী শিশুর আচরণ ও করণীয় জেনে নিতে পারেন এখানে।

বয়স যখন এক বছর

এক বছরের শিশুরা কৌতূহলী ও সক্রিয় হয়। এ বয়সে তারা আশপাশের মানুষের ভাষা বুঝতে শুরু করে। চেষ্টা করে কথার প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে। তবে ‘না’ শব্দের ব্যবহার ঠিক পরিষ্কার হয় না। অর্থাৎ গতকাল যে কাজটা করতে নিষেধ করা হয়েছে, সেটা যে আজও প্রযোজ্য, এটা শিশুর মস্তিষ্কে তখনো স্থায়ী হয় না। স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর সাধারণ নিয়মকানুন সম্পর্কেও সে অবগত নয়। যেমন একটা কাচের গ্লাস পড়ে গেলে ভাঙবে, সেটা সে বোঝে না। এ ছাড়া আত্মনিয়ন্ত্রণ না থাকায় তার পক্ষে ধৈর্য ধরা বা অপেক্ষা করা কঠিন। তাদের মনোভাব থাকে এমন—যখন যা চায়, তখনই সেটা দিতে হবে।

অভিভাবক যা করবেন

  • বয়সের কথা মাথায় রেখে সন্তানের কাছ থেকে প্রত্যাশা করুন। অনেক শব্দ শিখতে হবে, ছড়া পারতেই হবে, এ বয়সে এ রকম প্রত্যাশা করা অনুচিত। শিশুর সামনে স্বাভাবিক ও সঠিক আচরণই আপনাকে করে যেতে হবে। তবে শিশুকেও সেটি করতে জোর করবেন না। মনে রাখবেন, আপনার কণ্ঠ এবং মুখের অভিব্যক্তি থেকেই শিশু ভালো শেখে। তাই ইতিবাচক থাকুন। অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানোরও প্রয়োজন নেই।

  • ঘরকে শিশুবান্ধব করুন। যেমন ভাঙতে পারে, এমন জিনিস শিশুর হাতে নাগাল থেকে সরান। কাচের জিনিস, মাটির জিনিসপত্র ইত্যাদি।

  • শিশু রাগ করলে বা বিরক্ত হলে সান্ত্বনা দিয়ে বোঝান। ধরুন, সে গাড়ির সিটে বসতে চাইছে না বা বিরক্ত হচ্ছে। আপনি বলুন যে তার এই অসুবিধা আপনি বোঝেন। কিন্তু তবু এটা করতে হবে। এরপর সিটে বসিয়ে তার মনোযোগ অন্যদিকে সরান।

বয়স যখন দুই বছর

শিশুর এ বয়সটি আবেগকেন্দ্রিক। প্রথমবারের মতো সে নিজের অনুভূতিকে বুঝতে চেষ্টা করে। আশপাশের অবস্থা থেকে প্রতিক্রিয়া চায়, পর্যবেক্ষণ করে। যেমন, সে ভাবে আমি যদি না খেতে চাই, তাহলে কী ঘটবে? এটা সে পরীক্ষা করে দেখে। তবে আবেগকে বুঝতে এবং সেটা জায়গামতো ব্যবহার করতে এ বয়সীদের কিছুটা সমস্যা হয়। তারা এটাও বোঝে, চাইলেই সে সবকিছু পাবে না। ফলে প্রায়ই মেজাজ হারাতে পারে।

অভিভাবক যা করবেন

  • শিশুর সঙ্গে চিৎকার না করে আপনি যা চান, পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলুন। সহজ কিছু বিষয় থেকে ওকে পছন্দ অনুযায়ী কাজ বেছে নিতে বলতে পারেন। তবে সামর্থ্যের বাইরে কিছু করতে বলা উচিত নয়। আপনার কথা শুনে কিছু করলে সন্তানের জন্য ছোট পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখতে পারেন।

  • আবেগ সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শিশুকে সাহায্য করুন। হয়তো সে কারও শরীরে আঘাত করল। তাকে শেখান যে কথা দিয়েও এই রাগ প্রকাশ করা সম্ভব। আর মারামারি করা খারাপ কাজ। এতে অন্যজন কষ্ট পায়, এ ব্যাপারটিও তাকে জানানো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আড়াই বছর থেকেই শিশু সহানুভূতি বা সহমর্মিতা শিখতে শুরু করে।

  • শিশু রাগ করলে বা মেজাজ হারালে অনেক অভিভাবক বলেন, ‘যাও, তোমার সঙ্গে আর কথা বলব না।’ মা অন্য ঘরে চলে যান। এটা করা ঠিক নয়। বরং রাগ না কমা পর্যন্ত সন্তানের সঙ্গে থাকুন। গল্প করুন বা মজার কথা বলুন। শাস্তি না দিয়ে তাকে হয়তো পাশের ঘরের দাদুর কাছে নিয়ে গেলেন। অর্থাৎ পরিস্থিতি পাল্টে শিশুকে শান্ত হতে সহায়তা করতে পারেন।

আরও পড়ুন

বয়স যখন তিন বছর

তিন বছর পেরোনো শিশুর কাছে নিজে নিজে স্বাধীনভাবে কাজ করা বেশ গর্বের বিষয়, যা পারে, সেটা সে নিজেই করতে চায়। যেমন খাওয়ার আগে বেসিনে হাত ধোয়া, চিনি গুলিয়ে শরবত বানানো ইত্যাদি। তবে সব সময় যে এসব করবে, এমন কোনো কথা নেই। নিয়ম ভাঙলে সেটার পরিণতি আছে, শিশু এ বয়সে প্রথম বুঝতে শেখে। মুখ গোমড়া করা, ঘ্যান ঘ্যান করা বা ঘন ঘন অভিযোগ করার ঘটনাও ঘটে। তবে হতাশা বা মন খারাপ হলে তা সামলানোর ব্যাপারে তাদের উন্নতি ঘটতে শুরু করে।

অভিভাবক যা করবেন

  • নির্দিষ্ট কাজ না করার জন্য শিশুকে সরাসরি শাস্তি দেওয়া উচিত নয়। আগে সহজভাবে তাকে বোঝান। এরপর ওই কাজ শুরু করতে সাহায্য করুন। গুরুত্বপূর্ণ হলো ওদের চেষ্টাকে মূল্যায়ন করা।

  • শিশুকে ভালো ব্যবহারের অনুশীলন করাতে পারেন। খেলতে পারেন গেমসও। যেমন, একটি গান চালু করে বলুন, গান শেষ করার আগেই নিজের সব খেলনা গুছিয়ে ফেলো। এতে সে আনন্দ নিয়ে সময়মতো কাজ করতে শিখবে।

  • এই বয়সী শিশুরা কোনো কাজ নিষেধ করার পরও করতে থাকলে বিরতি আরোপ করতে পারেন। অর্থাৎ ‘টাইম আউট’ জারি করতে পারেন। এ বয়সের শিশুরা এই টাইম আউট নিতে পারে ৩ মিনিটের মতো। শিশু যখনই অবাধ্য হবে, তখনই এই নিয়ম প্রয়োগ করতে পারেন। এতে সে খারাপ ব্যবহার এবং সেটার ফলাফলের মধ্যে যে সম্পর্ক আছে, সেটা বুঝতে শিখবে এবং ধীরে ধীরে নিজেকে শুধরে নেবে।

বয়স যখন চার বছর

চার বছর বয়সে শিশুর সামাজিক দক্ষতা বিকশিত হয়। এ বয়সেই খেলায় বা কাজে তারা বেশি মনোযোগ দিতে পারে। সে জন্যই খেলাধুলা বা আনন্দের সময়ে সেই স্থান থেকে তাকে সরানো কঠিন হয়। আবার এই বয়সে শিশুর অভিযোগ করার প্রবণতা আরও বাড়তে পারে। এর কারণ হলো, কোনটা সে পায়নি আর কোনটা সে চায়, এ বিষয়ে তখন সে ভালোভাবে বোঝে। মজার ব্যাপার হলো, এ সময় শিশুরা সত্যকে নিজের মতো করে পরিবর্তন বা ঘুরিয়ে বলতে পারে; সহজ করে বললে মিথ্যাও বলতে শেখে। কিন্তু এটা যে ভুল, তা সে বোঝে না। 

অভিভাবক যা করবেন

  • দুটি কাজের মাঝখানের সময়ে শিশুকে যথেষ্ট সময় দিন। মাথায় রাখতে হবে, এ বয়সে ওদের সময়জ্ঞান খুব একটা থাকে না। ধরুন, আপনারা ঘুরতে বের হবেন। আপনার সন্তানকে বললেন, ‘আমরা ১০ মিনিটের মধ্যে বের হবো।’ এই ১০ মিনিট কতটুকু, সেটা সে বুঝতে পারে না। এর চেয়ে ‘কার্টুন শেষ হলেই আমরা বের হবো’—এমন বাক্যই তার কাছে বেশি অর্থবোধক। আবার সে যদি একটু বেশি সময় চেয়ে অনুরোধ করে, সম্ভব হলে সেটি রাখুন। শিশু রেগে গেলে বলতে পারেন, ‘তুমি শান্ত হলে তারপর আমরা কথা বলব।’

  • আপনার সন্তান অভিযোগ বা ঘ্যান ঘ্যান করে কথা বললে এড়িয়ে যান। তাকে বলুন, এভাবে কথা বললে আপনি শুনবেন না। পরে স্বাভাবিকভাবে কথা বললে শিশুর প্রশংসা করুন।

  • এ বয়সে মিথ্যা বলা বা অসততার আশ্রয় নেওয়া অস্বাভাবিক নয়। এ রকম পরিস্থিতি সামলাতে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। শেখাতে হবে সততার গুরুত্ব। ধরুন, আপনার চার বছরের সন্তান গরম দুধের গ্লাস হাত থেকে ফেলে ভেঙেছে। আপনি দূর থেকে দেখেছেন। অথচ আপনার সামনে সে পুরো ঘটনা অস্বীকার করছে। এ সময়ে রাগ করা যাবে না। বরং তাকে শান্তভাবে বলুন, ‘গরম গ্লাস হাত থেকে পড়তেই পারে। তুমি গ্লাস ভেঙেছ, এ জন্য রাগ করিনি। তবে তুমি মিথ্যা কথা বলছ, এটা ঠিক নয়।’ এরপর নিরাপদ মনে করলে তাকেই ঘর পরিষ্কার করতে বলুন বা প্রয়োজনে আপনিও সাহায্য করুন। এতে সে নিজের ভুল বুঝবে এবং সত্য বলতে ভয় পাবে না।  

ভাল কাজের পুরস্কার স্বরূপ সন্তানকে ঘুরতে নিয়ে যেতে পারেন
ছবি: কবির হোসেন

বয়স যখন পাঁচ বছর

এ বয়সের শিশুরা নিজের কাজের সত্যিকারের পরিণতি বা ফলাফল উপলব্ধি করতে শেখে। কাজ করে নিজের বিবেক খাটিয়ে। অন্যের অবস্থানে থেকে কীভাবে ভাবতে হয়, সেই বোধও তৈরি হয়। এমনকি নিয়ম মেনে চলার জন্য এটা যথেষ্ট পরিণত বয়স। এ ছাড়া তারা নিজে থেকেই টুকটাক কিছু কাজ করে। কিন্তু সময়ে সময়ে অতিরিক্ত দুষ্টামিও করে। এটা অভিভাবক হিসেবে আপনার জন্য পরীক্ষা বটে। অসম্পূর্ণ হলেও শিশু এ বসয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণও শিখতে শুরু করে। তবে নিজের ইচ্ছেমতো না হলে আপনার সন্তান রাগ করে দরজা বন্ধ করে বা আঘাত করে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে।

অভিভাবক যা করবেন

  • শিশুকে বড় পরিসরে ভাবতে শেখান। ধরুন, সে ইচ্ছা করে তার বন্ধুর খেলনা ভেঙে ফেলেছে। তাকে প্রশ্ন করুন, ‘তোমার বন্ধু তোমার সঙ্গে এটা করলে কী ভালো লাগত?’ প্রতিটি আচরণে অন্যের ওপর কী প্রভাব পড়ে, তা বুঝিয়ে বলুন।

  • সন্তানের ওপর আচরণ-ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখতে পারেন। যেমন, আপনি হয়তো একটা চার্ট বানালেন। সেখানে কিছু কাজ লেখা থাকবে। ভাইবোনের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করা, তাদের বিছানা গুছিয়ে দেওয়া, সময়মতো স্কুলের পড়া শেষ করা ইত্যাদি। একটা কাজ করলে, সে একটা স্টিকার বা চকলেট পাবে। অনেকগুলো স্টিকার জমা হলে আপনি তাকে ঘুরতে নিয়ে যাবেন। একইভাবে মারামারি বা অতিরিক্ত খারাপ ব্যবহার করলে কী ফল হবে, সেটাও তাকে জানাবেন।

  • নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে কিছু নিয়ম শেখাতে পারেন। আপনার সন্তান হয়তো একনাগাড়ে চিৎকার করছে। বলুন, দুই মিনিটের মধ্যে না থামলে সে শাস্তি পাবে। 

আরও পড়ুন

বয়স যখন ছয়-সাত বছর

এ পর্যায়ে শিশুর দুনিয়া বড় হতে থাকে। নতুন মানুষের সঙ্গে মেশে, স্কুলে অনেক বন্ধু হয়। ফলে নতুন কোনো কিছু বা পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে তারা মানিয়ে নিতে শেখে। সামলে নেয় পড়াশোনার চাপও। এ সময় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা আরও তারা ভালোভাবে প্রকাশ করে। যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলগত কাজ করা, শিক্ষকের প্রশ্নে চিৎকার না করে হাত তুলে উত্তর দেওয়া, শান্তভাবে ক্লাস করা ইত্যাদি। তবে লম্বা সময় ধরে কাজের পর পুরস্কার না পাওয়াকে তারা অপছন্দ করে। একই কারণে নিয়মিত পুরস্কার বা উৎসাহ পেলে কাজ করতে আরও আগ্রহী হয়। ছয়-সাত বছরের শিশুরা দায়িত্ব পালন করতে শেখে। ফলে তারা চায়, বড়দের মতো করেই তাদের মূল্যায়ন করা হোক। এটাও সত্য, লক্ষ্যে পৌঁছাতে এ বয়সেও আপনার সাহায্য তাদের প্রয়োজন। 

অভিভাবক যা করবেন

  • সন্তান নিজের বুদ্ধিতে কোনো সমস্যার সমাধান করলে সেই দক্ষতাকে উৎসাহিত করুন। তাদের ভুল সরাসরি শুধরে দেওয়ার চেয়ে তাকে শেখান, কী করলে এমন ভুল হয় না। গল্প বা ঘটনা দিয়েও বোঝাতে পারেন। আপনি হয়তো বললেন, ‘আমি বাজে কথা বলেছি; কারণ, মাহিন আমাকে খেলায় নেয়নি। তবে একটু পরই বুঝেছি...।’ এই শূন্যস্থান শিশুকে পূরণ করতে বলুন। সময় নিয়ে ভালো সমাধান ভাবতে সাহায্য করুন।

  • আপনার সন্তান হয়তো প্রতিদিন সকালে নিজের ঘর গোছায়। এ জন্য তাকে মাস বা সপ্তাহের শেষে পুরস্কার না দিয়ে প্রতিদিন ছোট পুরস্কার দিতে পারেন। এতে সে আরও উৎসাহিত হবে। তবে ভদ্র আচরণ, বড়দের শ্রদ্ধা ইত্যাদি বিষয় নিয়মিতই তাদের বলতে হবে।    

  • কোনো কাজে সাহায্য করলে তার নগদ প্রশংসা করুন। এ বয়সী শিশুকে টুকটাক কাজ করতে অভ্যস্ত করুন। কাজ শেষে বাহবা দিন। এটা ওদের আত্মসম্মানবোধ বাড়াতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া ভালো ব্যবহারকে সব সময় গুরুত্ব দিন। যদি কোনো কাজে শাস্তি দিতে হয়, সেটার সঙ্গে যেন ভুল কাজের সম্পর্ক থাকে, তা নিশ্চিত করুন।

ছয়-সাত বছরের শিশুরা দায়িত্ব পালন করতে শেখে
ছবি: প্রথম আলো

বয়স যখন ৮-১০ বছর

এ বয়সের শিশুরা দল ও সামাজিকতা শিখতে শুরু করে। কোন জায়গায় বা কাদের সঙ্গে তাকে মানায়, সেটা সে বোঝে। আবার প্রত্যাশার চাপ মাথায় রাখার জন্যও এটা যথেষ্ট বয়স। শিশুর সঙ্গে অন্য একজনের তুলনা করা আমাদের সমাজে খুবই স্বাভাবিক। এ বয়সেই প্রথম তারা এ বিষয়ে সচেতন হয়। এ জন্য তাদের কাজের মানেও তারতম্য ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে এই শিশুরা নিজে থেকেই সহযোগিতা করবে, হঠাৎই আবার কিছুই করবে না, গোঁ ধরে বসে থাকবে। এমনকি কৈশোরপূর্ব বয়সীদের মতো আচরণও করতে পারে। অর্থাৎ সাধারণ কথায়ও মন খারাপ করা বা ভালো কথাকে নেতিবাচকভাবে নিতে পারে। তেরচা প্রত্যুত্তর, তর্ক বা বিদ্রূপ করে উত্তর দেওয়ার ঘটনাও ঘটতে পারে। এ বয়সের শিশুরা ভালো-মন্দের মৌলিক পার্থক্য বোঝে। কীভাবে সে এই পার্থক্যকে জীবনে কাজে লাগাবে, সেটা সে তার মা-বাবার কাছে শিখতে চায়। তাদের কাজকে অনুসরণ করতে চায়।   

অভিভাবক যা করবেন

  • শিশুর সঙ্গে যথেষ্ট কথা বলুন। সময় নিয়ে সমস্যা শুনুন। ধরুন, তার খারাপ আচরণ মাত্রা ছাড়িয়েছে। আগেও তাকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। এবার তাহলে শাস্তি দিন। সমস্যা নতুন হলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করুন। কী হয়েছে, কেন হয়েছে, তা নিয়ে বন্ধুর মতো খোলামেলা কথা বলুন। এরপর আবারও একই কাজ করলে কী শাস্তি পাবে, সেটাও জানিয়ে দিন।  

  • বড় কারও সঙ্গে কথা বলছেন, এমনভাবে কথা বলারও চেষ্টা করতে পারেন। ৮-১০ বছর বয়সে এসে তারা বিকল্প উপায় পেতে পছন্দ করে। যেমন আপনার সন্তান হয়তো সহশিক্ষা কার্যক্রমে অনেক ভালো। বাসায়ও অনেক কাজ করে। কিন্তু এসব করতে গিয়ে সে পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে তাকে ডেকে বলুন, ‘তুমি এসব কাজ করো, এসব কাজ বাদ দাও।’ এতে তারা শিখবে, অনেক বিকল্প থেকে একটি অপেক্ষাকৃত সঠিক সিদ্ধান্ত বেছে নেওয়াই হলো জীবন। আর ভালো আচরণের মাধ্যমে এই সুযোগ পাওয়া যায়।

  • স্বাভাবিকভাবেই নিজের কাজের ওপর নির্ভর করেই ফলাফল আসে, তা সন্তানকে বোঝান। সংশোধনের ব্যাপারেও ধারণা দিন। ধরুন, সে তার আধোয়া কাপড় ঝুড়িতে না রেখে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রেখেছে। তাহলে সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত তার কাপড় ধুয়ে দেবেন না। কেবল আপনার কথা শুনলেই কাপড় ধুয়ে দেবেন। আপনার সন্তান তার বন্ধুর খেলনা হারিয়ে ফেললে সেটা কিনে ফেরত দেওয়ার আদেশ দিন। কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে দুঃখ প্রকাশ করতে জোর করুন। এসবের মাধ্যমে আপনার সন্তান আপনার মূল্যবোধের ধারণা পায়। শেখে দায়িত্বশীলতার পাঠ ।

সূত্র: প্যারেন্টস ডটকম

আরও পড়ুন