স্তন ক্যানসার নিয়ে লজ্জা-শঙ্কা-ভয় দূর করতে হবে

ছবি: প্রথম আলো গ্রাফিক্স

বাংলাদেশে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে স্তন ক্যানসারের অবস্থান দ্বিতীয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীদেরই স্তন ক্যানসার হয়। তবে পুরুষদের হওয়াও অসম্ভব নয়। প্রাচীন ধারণামতে, নারীস্বাস্থ্য মানেই লজ্জা, শঙ্কা ও ভয়। তাই রোগটি সম্পর্কে প্রথম থেকেই সচেতন থাকলে কমানো যায় ভোগান্তি ও মৃত্যুর হার। এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড আয়োজিত ‘স্তন ক্যানসার সচেতনতায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় উঠে আসে এসব মতামত। অনুষ্ঠানটি গত সোমবার সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

অনুষ্ঠানের আলোচক ছিলেন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মাসুদ করিম এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ক্লিনিক্যাল অনকোলজিস্ট ডা. আলী আসগর চৌধুরী। সঞ্চালনা করেন মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাগরিকা শারমীন।

অনুষ্ঠানে শুরুতেই বক্তব্য দেন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মাসুদ করিম। কখন একজন নারী বুঝবেন যে তাঁর স্তন ক্যানসার হয়েছে? এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘স্তন ক্যানসার আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৯৯ জনই নারী। অনেক নারীই নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে সংকোচ ও অবহেলা করেন। তাই নারীরা যাতে বুঝতে পারেন যে তাঁর চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সময় হয়েছে, তার জন্য আমি স্তন ক্যানসারের লক্ষণগুলো বলছি। স্তন ক্যানসারের প্রধান লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—স্তনের কোনো অংশ চাকা চাকা হয়ে যাওয়া অথবা কোনো গোটা দেখা দেওয়া, স্তনের আকার বা আকৃতির পরিবর্তন, স্তন বৃন্তের আকারে পরিবর্তন, স্তনের বোঁটা থেকে রক্ত বা তরল পদার্থ বের হওয়া, বোঁটার আশপাশে ফুসকুড়ি দেখতে পাওয়া, বগল ফুলে যাওয়া বা চাকা দেখা দেওয়া, স্তনের ভেতরে গোটা ওঠা বা শক্ত হয়ে যাওয়া। এই লক্ষণগুলো দেখা দিলেই জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’

স্তন ক্যানসার নির্ণয় হলে চিকিৎসার জন্য অনেকের মধ্যেই দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এর কারণ কী? সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মাসুদ করিম বলেন, ক্যানসার চিকিৎসায় বাংলাদেশ বর্তমানে অনেক এগিয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে এর চিকিৎসাব্যবস্থা রয়েছে। আর বিদেশে চিকিৎসা এবং চিকিৎসা-পরবর্তী ফলোআপে যে ওষুধসামগ্রী প্রয়োজন, তা ব্যয়বহুল। বরং বাংলাদেশে সাধ্যমতো একজন রোগী এই চিকিৎসা নিতে পারেন। ওষুধের দামও তুলনামূলক কম।

ক্যানসার রোগের চিকিৎসার ধাপগুলো নিয়ে কথা বলেন ডা. আলী আসগর চৌধুরী। তিনি বলেন, চিকিৎসার প্রথম ধাপে বিশেষজ্ঞরা রোগীর ইতিহাস নিয়ে থাকেন। শারীরিক পরীক্ষা করেন। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে স্তন ক্যানসার শনাক্ত করা হয়। রোগীর বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বিশেষজ্ঞরা তা দিয়ে থাকেন। যেমন ম্যামোগ্রাফি, আলট্রাসনোগ্রাফি, এমআরআই, চাকা, বায়োপসি ইত্যাদি। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ রোগী সুস্থ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেন। এ ক্যানসারের চিকিৎসা প্রধানত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত, যেমন সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, হরমোনথেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি ইত্যাদি।

সার্জারির বিষয়ে ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলেন, স্তন ক্যানসারের যেকোনো পর্যায়েই রোগীর সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। সার্জারি করা যাবে কি না বা কী ধরনের সার্জারি হবে শুরুতেই তা আলোচনা করে নেওয়া হয়। অনেক সময় শুধু টিউমার কেটে ফেলা হয়। অনেক সময় পুরো স্তনই ফেলে দেওয়ার প্রয়োজন হয়।

কেমোথেরাপির বিষয়ে ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলেন, প্রায় সব রোগীকেই কেমোথেরাপি নিতে হয়। সার্জারির আগে বা পরে এমনকি রোগ শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়লেও কেমোথেরাপি কাজ করে। যদিও কেমোথেরাপিতে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে, তবুও রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য কেমোথেরাপির বিকল্প নেই। রোগীর শারীরিক অবস্থা, কেমোথেরাপির কার্যকারিতা, রোগীর আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনায় রেখেই বিশেষজ্ঞরা উপযুক্ত পরামর্শ দেন।

যখন কোনো নারী বুঝতে পারেন তাঁর স্তনে অস্বাভাবিক কিছু রয়েছে, তখন পরিবারের সদস্যদের কাছে জানালে তাঁরা নানাবিধ অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা শুরু করান—সঞ্চালক ডা. সাগরিকা শারমীনের এমন মন্তব্যে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মাসুদ করিম বলেন, ‘শুধু ক্যানসার নয়, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো যেকোনো রোগেই প্রথম ভরসা কবিরাজ। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও নেন অনেকে। কিন্তু কাছেই থাকা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা সরকারি মেডিকেল কলেজে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বিনা মূল্যে উন্নত চিকিৎসা প্রদান করেন। আমি বলব, স্তনের যেকোনো সমস্যায় দেরি না করে সবাই যেন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। প্রাথমিক অবস্থায় থাকলে রোগ নির্মূল সহজ হয়।’

অক্টোবর মাস ‘স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাস’। তাই অনুষ্ঠানের আলোচকেরা এ মাসেই সচেতন হতে জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন আনার ব্যাপারে পরামর্শ দেন। এখন মানুষ শারীরিক পরিশ্রম কম করেন এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খান, ফলে স্থূলকায় হয়ে যান। অতিরিক্ত স্থূলতা এ রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। তাই এ বিষয়েও বিশেষভাবে সচেতন থাকতে পরামর্শ দেন তাঁরা।