আমিও একজন ড্রপআউট

টুইংকেল খান্না। একসময়ের বলিউড তারকা। এখন পুরোদস্তুর লেখক। উপন্যাস, ছোটগল্পের পাশাপাশি ভারতের প্রথম সারির পত্রিকায় নিয়মিত কলামও লিখছেন। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে ফিকশন রাইটিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর শুরু করলেন তিনি। স্বামী বলিউড তারকা অক্ষয় কুমার এ নিয়ে মজা করে টুইটারে লিখেছেন, ‘যে সময়ে ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিয়ে আসার কথা, সে সময় স্ত্রীকে ক্যাম্পাসে রেখে আসছি।’

টুইংকেল খান্না
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

আজ আমি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে বক্তা হিসেবে আসতে পেরে ভীষণ আনন্দিত। আমার খুব শখ ছিল, একদিন আমিও এখানে পড়তে আসব। আমি একবার এখানকার সামার স্কুলের একটা কোর্সে ভর্তির জন্য আবেদনও করেছিলাম। কিন্তু তাতে ভর্তি হওয়ার জন্য দুটি পূর্বশর্ত ছিল। একটি হলো আমাকে দ্য গ্রেট গ্যাটসবি বইটা পড়তে হবে। যেটা অনেক ছোটবেলাতেই আমার পড়া হয় গিয়েছিল। আমি এক নম্বর শর্ত দেখে মহাখুশি ছিলাম। কিন্তু বিপত্তিটা বাধল দুই নম্বর শর্তে। ওটা ছিল, আমাকে অবশ্যই গ্র্যাজুয়েট হতে হবে। স্টিভ জবস, বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গদের মতো আমিও একজন ড্রপআউট। তাই সে যাত্রায় আমার আর অক্সফোর্ডে পড়া হয়নি। তবে এবার আমি আবার ভর্তির আবেদন করব। এবারের আবেদনে লিখে দেব, ড্রপআউট হওয়া সত্ত্বেও অতিথি বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর পাশাপাশি অক্সফোর্ড যেন আমাকে শিক্ষার্থী হওয়ার সুযোগটাও দেয়।

অঙ্কে পেতাম ৯৭, সাহিত্যেও তাই
আমি সব সময় পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি। আমার পছন্দরে জায়গা ছিল টেবিল-চেয়ার, কাগজ-কলম ছিল প্রিয় সঙ্গী। কিন্তু আমি যে পরিবারে জন্ম নিয়েছি, সেই পরিবার থেকে ‘পাদপ্রদীপ’ এড়ানো কঠিন। তাই খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করলেও আমাকে বাস্তবতা মেনে নিতে হয়েছিল, আর ধীরে ধীরে আমি পাদপ্রদীপের সঙ্গেও সখ্য গড়ে নিয়েছিলাম। বলিউডে নাম লেখানোর ঠিক আগে আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল দুটি। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়া আর লেখক হওয়া। নায়িকা হওয়া কখনোই আমার লক্ষ্যের তালিকায় ছিল না। অঙ্কে আমি ৯৭ নম্বর পেতাম, সাহিত্যেও পেতাম এমনই কিছু একটা। এই গণিত ও সাহিত্যপ্রেম ঘিরেই ছিল আমার যত পরিকল্পনা।
কিন্তু স্কুল পেরোনোর পরপরই আমার কাছে সিনেমার প্রস্তাব আসতে শুরু করে। তখন পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে আর পারিবারিক পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েই সিনেমায় নাম লেখাই। কারণ, ওই সময় আমার মধ্যে একধরনের তাড়না ছিল—যত দ্রুত সম্ভব আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে। আমার মা-বাবা বিরাট বলিউড তারকা হওয়া সত্ত্বেও আমাকে জীবনে অনেক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমি যেমন প্রাসাদের মতো বাড়িতে থেকেছি, গাড়ির বহর থেকে গাড়ি বাছাই করে নিয়ে স্কুলে গেছি, তেমনি সংকটটাও আমাকে দেখতে হয়েছে। মা-বাবার বিচ্ছেদের পর আমাকে আমার নানির বাড়ির মেঝেতে চাদর বিছিয়েও ঘুমাতে হয়েছে। মা আমাকে সচ্ছলভাবেই একা হাতে বড় করেছেন, একই সঙ্গে আমার মামা-খালাদের দায়িত্বও ছিল তাঁর ওপর। তাই রাতদিন মা পরিশ্রম করতেন, আমরা দেখতাম। তাই খুব অল্প বয়স থেকেই চাইতাম অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে। কারণ, আমার লক্ষ্যে আমি তখনই পৌঁছাতে পারব, যখন আমি আমার নিজের অবস্থান শক্ত করতে পারব। এটা ছিল আমার বাস্তবতা। তাই পেশাজীবনের ওই শুরুর সময়টায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি অভিনয়ে নাম লেখাই।

সন্তানেরা আমাদের দেখে শেখে
আমি বিশ্বাস করি, বাবা-মায়েরা শত বলেকয়েও সন্তানকে আদর্শ, নীতি, নৈতিকতা, সততা—এসব শেখাতে পারবে না। এসব শিক্ষার কথা বলতে থাকলে তারা মা-বাবাকে অনেকটা ‘মিউট’ করা টেলিভিশনের মতো মনে করে। অর্থাৎ মা-বাবার মুখ ঠিকই নড়ে, কিন্তু সন্তানেরা কোনো কথাই কানে তোলে না। আমিও ছেলেবেলায় এসব কথা এভাবেই নিতাম। তাই আমার মনে হয়, যে শিক্ষা আমরা আমাদের সন্তানদের দিতে চাই, সেটা আগে আমাদের নিজেদের চর্চা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুনে নয়, সন্তানেরা আমাদের দেখে শেখে। শেখানোর জন্য নয়, তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে আলাপ করার জন্য। নিষিদ্ধ বিষয় নিয়েও তাদের সঙ্গে আলাপ করা জরুরি। যেন তারা তাদের সীমারেখা নিজেরাই ঠিক করতে পারে। আমি যেমন আমার ছেলের সঙ্গে সব ধরনের বিষয় নিয়ে আলাপ করি। যেন প্রয়োজনের সময় কোনো বিষয়েই আমার সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করতে সংকোচ বোধ না করে আমার ছেলে। সন্তানের সামনে নিজে উদাহরণ না হলে, অন্যকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে কোনো লাভ হয় না।

টুইংকেলের রোল মডেল
ব্যর্থতা আমার রোল মডেল। যতবার জীবনে ব্যর্থ হয়েছি, ততবার আমার ব্যর্থতাকে খুব মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি। যতবার জীবনে কোনো প্রতিবন্ধকতা এসেছে, ততবার ওই প্রতিবন্ধকতাকে গভীরভাবে নিরীক্ষা করেছি। বরাবরই চেষ্টা করেছি আমার প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে, প্রতিটি প্রতিবন্ধকতা থেকে এমন কিছু খুঁজে বের করতে, যা এত দিন আমার চোখে পড়েনি। এই চেষ্টার কারণে প্রতিবারই নিজের ব্যাপারে, নিজের পারিপার্শ্বিকতার ব্যাপারে নতুন অনেক কিছু আবিষ্কার করেছি, যা আমাকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করেছে।
সফল ব্যক্তিদের দেখলে মনে রেখো, তাঁরা এক রাতের চেষ্টাতেই কিন্তু সফলতা পাননি। নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে, সফল হওয়ার আগে, বারবার তাঁদের হোঁচট খেতে হয়েছে, ব্যর্থ হতে হয়েছে, তবেই তাঁরা সফলতা পেয়েছেন।

ইংরেজি থেকে বাংলা অনূদিত
সূত্র: অক্সফোর্ড ইউনিয়ন, মিডডে ইন্ডিয়া ও টুইক ইন্ডিয়া অবলম্বনে