এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল
মেয়েদের ঈর্ষণীয় ফলের কারণ কী
একনজরে
এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল
• গড় পাসের হার ৮৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।
• মেয়েদের পাসের হার ৮৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
• ছেলেদের পাসের হার ৮১ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
• জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রী ৯৮ হাজার ৭৭৬।
• জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্র ৮৩ হাজার ৩৫৩।
মেয়েদের জন্য শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বেশি। সেই বিনিয়োগের ফল এখন পাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ধানমন্ডি শাখা থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল নুফাইসা এম রহমান। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সে ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ–৫ পেয়েছে। ১২টি বিষয়ের সব কটিতেই পেয়েছে ‘এ+’। মানে প্রতিটি বিষয়েই সে ৮০ থেকে ১০০–এর মধ্যে নম্বর পেয়েছে। এই ভালো ফলের জন্য স্বাভাবিকভাবেই খুশি নুফাইসা।
নুফাইসা একাই কেবল এমন ভালো ফল করেনি। এ বছরের এসএসসি, দাখিল এবং এসএসসি ও দাখিল (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় সারা দেশেই মেয়েরা ভালো করেছে। পাসের হার, জিপিএ-৫—ফলাফলের এই দুই মূল সূচকেই ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে আছে তারা। কয়েক বছর ধরেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। শিক্ষা ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও পড়ছে এর ইতিবাচক প্রভাব।
শিক্ষায় মেয়েদের এগিয়ে থাকার পেছনে কয়েকটি বিষয়ের কথা বললেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রথমত, সরকারি-বেসরকারি নানামুখী উদ্যোগের ফলে এখন অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। এখন পড়াশোনার বিষয়ে সন্তান মেয়ে, না ছেলে সেই পার্থক্যটি দেখা হয় না বললেই চলে। সরকারের উদ্যোগে দেওয়া উপবৃত্তিও এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। আরেকটি বাস্তবতা হলো, ছেলেরা তুলনামূলকভাবে প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়াও ঘরের বাইরে বেশি থাকে। মেয়েদের কিন্তু বিপরীত চিত্র, অপ্রয়োজনে বাইরে তারা খুব কমই থাকে। পড়াশোনার ক্ষেত্রে এগুলোও প্রভাব ফেলছে।
এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে ১২ মে। সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডের ফলাফলের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারী মোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীসংখ্যাও বেশি ছিল। ছাত্রছাত্রী মিলিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল মোট ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৭ জন। তাদের মধ্যে ছাত্রী ছিল ১০ লাখ ২৪ হাজার ৮০৩ জন। তবে শুধু অংশগ্রহণ নয়, পাসের হার ও জিপিএ–৫—উভয় ক্ষেত্রেই এবার এগিয়ে আছে মেয়েরা। মেয়েদের পাসের হার ৮৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর ছেলেদের ৮১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ–৫ পাওয়া মোট ছাত্রী ৯৮ হাজার ৭৭৬ জন। বিপরীতে জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রসংখ্যা ৮৩ হাজার ৩৫৩ জন।
৯টি শিক্ষা বোর্ডেও আলাদাভাবে এসএসসি পরীক্ষায় ঈর্ষণীয় ফল করেছে মেয়েরা। এসএসসি পরীক্ষায় মোট ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ ৪৯ হাজার। পাসের হার ৮৫ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৮৯ হাজার ১৬৮ জন। অন্যদিকে ছাত্র পরীক্ষা দিয়েছিল ৭ লাখ ৫৭ হাজারের বেশি। পাসের হার ৮২ শতাংশের কিছু বেশি। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭৪ হাজার ৬৭৭ জন।
তবে কেবল এসএসসি পরীক্ষায় নয়, শিক্ষার বিভিন্ন স্তরেই ছাত্রীরা তাদের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে সংখ্যার দিক দিয়ে অনেক আগে থেকেই ছেলেদের পেছনে ফেলে দিয়েছে দেশের মেয়েরা। উচ্চমাধ্যমিক কলেজেও অংশগ্রহণের দিক দিয়ে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরাই এগিয়ে। সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র ও ছাত্রীর সংখ্যা সমান হতে চলেছে। এর মধ্যে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীরাই এগিয়ে আছেন। চিকিৎসাশিক্ষায় (মেডিকেল) ছাত্রীদের হার বেশি।
এর মধ্যে এবারও এসএসসি পরীক্ষায় বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় ভালো ফল করল ছাত্রীরা। বিজ্ঞানশিক্ষায়ও মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। যেমন এবার বিজ্ঞানে ছাত্র ছিল ২ লাখ ৮৬ হাজারের বেশি। ছাত্রীও প্রায় কাছাকাছি ২ লাখ ৮০ হাজারের মতো। বিজ্ঞানেও ছাত্রীদের পাসের হার বেশি।
‘বিনিয়োগের ফল পাওয়া যাচ্ছে’
শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেওয়ার কথা বলতে গিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েদের জন্য শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বেশি। সেই বিনিয়োগের ফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। এটা অবশ্যই ভালো দিক। অভিভাবকদের মধ্যেও এখন সচেতনতা বেড়েছে। পৃথিবীব্যাপীই প্রমাণিত হয়েছে, মেয়েরা যদি কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্তও পড়তে পারে, তাহলে তাদের সন্তান নিরক্ষর হয় না। বাংলাদেশেও সেই বিনিয়োগের ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, একটি গবেষণা হতেই পারে যে ছেলেরা কেন পিছিয়ে পড়ছে। অন্তত কারণটা খতিয়ে দেখা দরকার।
এ বিষয়ে শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের সংগঠন বাংলাদেশ আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার জানালেন, সরকারের নির্দেশে এখন পুরো বিষয়টিই গবেষণা করে দেখা হবে। তবে তাঁর ব্যক্তিগত ধারণা ও অভিজ্ঞতা হলো ছেলেরা বেশি বহির্মুখী। বিপরীতে মেয়েরা বেশি ঘরমুখী। ফলে মেয়েরা পড়াশোনায় বেশি সময় দেয়। পড়াশোনায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের নানা উদ্যোগও কাজ করছে। তবে ছেলেরা কেন বেশি পিছিয়ে পড়ছে, সেগুলো নিয়ে যেহেতু এখন সরকারের নির্দেশে গবেষণা হবে, তাই গবেষণার পর প্রকৃত কারণগুলো বোঝা যাবে।