১৫ বছর পর হাতে শক্তি ফিরে পেয়ে আবার শোপিস বানাতে শুরু করেছেন ফজলে রাব্বি

শরীরের ভারে একদিন বুকের সব হাড় ভেঙে যাবে, ছোটবেলায় তাঁকে নিয়ে এমন শঙ্কা প্রকাশ করেছিল ডাক্তার। ঘরবন্দী জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে শোপিস তৈরি করতে শুরু করেন একদিন। মাঝখানে শয্যাশায়ী হয়ে কেটে যায় ১৫ বছর। হাতে শক্তি ফিরে পেয়ে আবার কাজটা শুরু করেছেন ফজলে রাব্বি। রাজশাহীর চারঘাটে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

ফজলে রাব্বি আবার হাতে তুলে নিয়েছেন শিল্পসামগ্রীছবি: প্রথম আলো

ফজলে রাব্বির বয়স এখন ৪০ বছর। ছোটবেলাতেই তাঁর শরীরে যে ক্যালসিয়াম–ঘাটতি দেখা দিয়েছিল, কখনোই আর তা পূরণ হয়নি। এ জন্য হাড় শক্ত হয়নি। হাঁটতে পারেন না। খেতে গেলে দাঁত ভেঙে যায়। হাত দুটিও ভাঙতে ভাঙতে প্রায় অচল। ক্যালসিয়ামশূন্যতায় ২০১০ সালের পর একেবারে অচল হয়ে পড়েন। ১৫ বছর পর সম্প্রতি তাঁর ক্যালসিয়াম–ঘাটতি খানিকটা পূরণ হওয়ায় হাত দুটি সচল হয়েছে। আবার হাতে তুলে নিয়েছেন শিল্পসামগ্রী।

তাঁর বাসায় গিয়ে দেখা গেল, একটা ধানের গোলা, একটি পালকি, একটি গরুর গাড়ি ও একটি রিকশার ফিনিশিং দিচ্ছেন। ধানের গোলার চালাটি ধান দিয়েই তৈরি করেছেন। গমের নাড়া, সুপারিগাছের ডাল, টুথপিক ও দড়ি দিয়ে তৈরি করেছেন বডি। একনজরে বোঝাই যাবে না, কী দিয়ে কী তৈরি হয়েছে এই গোলা। ধানের গোলা থেকে নামার মইও রয়েছে। চমৎকার একটা শোপিস। সুইচ দিলেই বিভিন্ন অংশে জ্বলে ওঠে নানা রঙের আলো। দেখে মনে হবে, একই অঙ্গে এত রূপ! তাঁর সব শিল্পকর্মই এ রকম নান্দনিক।

ফজলে রাব্বির বানানো শোপিস
ছবি: প্রথম আলো

দীর্ঘদিন ফটোগ্রাফির ব্যবসা করে এখন অন্য কাজ করেন ফজলে রাব্বির বাবা আয়ুব আলী। ফজলে রাব্বির ধারণা, বাবা ছিলেন শিল্পী, সেই ধারা তাঁর ওপরও বর্তেছে। এ কাজের জন্য বাড়িতে তাঁকে আলাদা একটি ঘর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পরিবারের লোকজনই তাঁর কাজের উপকরণ জোগাড় করে দেন। পরিবারের সদস্যরা শুধু চান, কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকুক ফজলে রাব্বি, ভুলে থাকুক তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধিতা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদর্শনী

বুদ্ধি হওয়ার পরই হাসপাতালের বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করেন ফজলে রাব্বি। চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর অসুখটার নাম রিকেটস। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিজনিত এই রোগে শরীরের হাড় নরম হয়ে যায়। এভাবে এমন একটা সময় আসতে পারে, যখন নিজের শরীরের ভারেই বুকের সব হাড় ভেঙে যাবে। চিকিৎসকেরা তাঁকে থাইল্যান্ডে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। দরিদ্র বাবার পক্ষে সেটি করা আর সম্ভব হয়নি।

হুইলচেয়ারে বসেই কাজ করেন ফজলে রাব্বি
ছবি: প্রথম আলো

ছোটবেলায় প্রায়ই তাঁকে ঢাকার পিজি (বর্তমান বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালে নিতে হতো। রাজশাহীর চারঘাট থেকে এত ঘন ঘন যাওয়া–আসা করতে সমস্যা হতো। এ জন্য গাজীপুরে মামার বাড়িতে থাকা শুরু করেন রাব্বি। সেখানে বসে থেকে থেকে অলস সময় আর কাটতে চাইত না। অন্য শিশুরা যখন খেলত, অসহায় দৃষ্টিতে খালি দেখত। কিন্তু উঠে দাঁড়িয়ে আর তাদের দলে যোগ দিতে পারত না। এটা আঁচ করেই একদিন তাঁর হাতে শিল্প তৈরির নানা উপকরণ তুলে দেন তাঁর মামি গাউসিয়া আলম। এভাবেই চারপাশের চেনা সব উপকরণ ব্যবহার করে গড়ে তোলেন সৃষ্টির নতুন এক ভুবন। বটের ঝুরি, ধান, ডিমের খোসা, নারকেলের খোল, সুপারিগাছের ডাল, মোম, গমের নাড়া—আশপাশে যা পান, তা–ই ব্যবহার করেন।

এ রকম অর্ধশতাধিক শোপিস নিয়ে ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রদর্শনী করেন ফজলে রাব্বি। আর সেগুলো বিক্রির সব টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন প্রতিবন্ধীর হাতে তুলে দেন।

এইচএসসি পাস করে সরদহ সরকারি মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রাব্বি। কিন্তু অসুস্থতার কারণে গত ১৫ বছরেও আর স্নাতক শেষ করতে পারেননি।

অনেক কিছুই করতে চান রাব্বি। কিন্তু শরীরে কুলোয় না। হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন। টানা কাজ করতে পারেন না। তাঁর স্বপ্ন, ‘আহা, কোনো একটা প্রতিষ্ঠান যদি একটা চাকরি দিত, মাথাভর্তি আইডিয়াগুলো রেখে যেতে পারতাম!’

আরও পড়ুন