চারপাশের মানুষ অনেকবার বলেছে, আমার নাকি রাজকপাল
রাজধানীর খিলক্ষেত রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় গত ২৮ নভেম্বর সকালে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান নূর-এ-আলম তৈমুর। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনে ‘সংযোগ’ প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন এই তরুণ। ফেসবুক প্রোফাইলে ‘সে ছিল এক রূপকথার সময়’ শিরোনামে স্মৃতিচারণা লিখতে শুরু করেছিলেন। তিনটি পর্ব লেখার পরই থেমে গেল সেই ধারাবাহিক। প্রথম পর্বে লিখেছিলেন থিয়েটারে নাম লেখানোর গল্প।
চারপাশের মানুষ অনেকবার বলেছে, আমার নাকি রাজকপাল! আমার কপালে ঘষে নিতে পারলে অজস্র সাফল্য এমনি এমনি নাকি হাতে এসে পড়ে। আসলেই কি তাই? কে জানে, হয়তো আমি অভিযোগ করি না সবার কাছে আমার কঠিন দিনগুলো নিয়ে, আমার ব্যর্থতাগুলো নিয়ে...বারবার বলি না, কোন কোন বিরূপ সময় পার করে আমাকে একেকটা সিঁড়ি উঠতে হয়েছে, তাই বোধ হয় সবার কাছে মনে হয়, ‘কী সহজেই না সুখ পেয়ে গেল ব্যাটা!’
তবে এটা আমিও মানি, আমার রাজকপাল। আর সেই কপালটা আমার মানুষ পাওয়ার বেলায়। ছোটবেলা থেকেই যাদের সঙ্গে মিশেছি, তারা কেউ পারফেক্ট নয়। কিন্তু তাদের কেউ কেউ কোনো না কোনো ক্ষেত্রে অসাধারণ। আমার কৃতিত্ব এটুকুই যে তাদের খারাপ অংশটুকু উপেক্ষা করে শুধু ভালোটুকু আমি আমার ভেতরে ধারণ করার চেষ্টা করেছি। যখন পেরেছি, তাদের ভালোবেসেছি। হিসাব করে দেখলে, আমার পেশাগত আর ব্যক্তিগত জীবন মিলিয়ে চার–পাঁচটা জিনিস বাদে আমি সবকিছুতেই খুব খারাপ। কিন্তু যেগুলো আমি পারি, সেগুলো আমার দেখায় আমার চেয়ে ভালো খুব কম মানুষ পারে। আর এই চার–পাঁচটা বৈশিষ্ট্যের প্রায় সবটাই আমি টুকে নিয়েছি চারপাশের সেই দারুণ মানুষগুলো থেকে। পছন্দের বিষয় শিখতে আমার ভালো লাগে।
সব শিখতে চাওয়ার এই দুরন্ত সময়টায় আমি রাজশাহীতে ছিলাম। নিজেকে ভেঙে নতুন করে তৈরি করার এই সময়টায় পদ্মাপাড়ের এই ছোট্ট শহরটা আমার ছিল। আমি বলব না, এই শহর না থাকলে আমি নিজেকে তৈরি করতে পারতাম না। ভার্সিটির প্রথম বছরেই ঘাড়ভাঙা প্রেমে পড়েছিলাম, অন্ধের মতো ছুটেছিলাম। কিন্তু যা হওয়ার নয়, সে পথ থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল দ্বিতীয় বছরেই। মন ভাঙার পরে ভেসে যাওয়াটা সহজ ছিল। কিন্তু সেই যে আমার রাজকপাল, প্রিয় মানুষের দেয়াল পাশেই ছিল!
থিয়েটার করব, এ রকম ভাবনা মাথায় ছিল না কখনো। তত দিনে আমার রাজশাহীতে আসার প্রায় মাস দুয়েক হয়ে গিয়েছিল। এই সময়ের ভেতরেই ১৫–২০ জনের একটা বিরাট দলে ভিড়ে গিয়ে বেশ কিছুদিন বন্ধু বন্ধু খেলে ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডায় একেকজনকে একেক দিকে ছিটকে যেতে দেখলাম, মজার এক গুটিবাজিতে একদিন আমাকেও দলছুট আবিষ্কার করলাম। এর কিছুদিন আগে বা পরে ডিপার্টমেন্টের পিকনিকে দিন শেষে ফেরার পথে খুব হতাশ মুখে আশিক ইশতিয়াক বাসের সিটে হেলান দিয়ে বলেছিল, ‘অনেক চেষ্টা করেও আমি ওদের একজন হয়ে উঠতে পারলাম না রে!’ এখন আমি জানি, এই আক্ষেপ আশিকের বেশি দিন ছিল না। সবাই নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছিল কোনো না কোনোভাবে।
দলছুট সেই সময়ে শীত শেষ হওয়া এক বিকেলে আমতলায় বসে চা খাচ্ছিলাম। চিল ভাইব নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ডিপার্টমেন্টের রোমেল ভাই গিটারটা হাতে নিয়ে এসে বসেছে একটু আগেই। গিটারের টুং টাং শুনে গলা মিলিয়ে গান গাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি; এমন সময় রোমেল ভাই বলল, ‘অ্যাই, একটা মজার জায়গায় যাবি?’
মজার জায়গাটায় গিয়ে দেখলাম, সেটা মমতাজউদ্দীন কলাভবনের নিচের ফ্লোরের কমন স্পেস। সেখানে দোতলার সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে একজন লাফ দেবে বলে দাঁড়িয়ে আছে, আর নিচে সারি বেঁধে দুই পাশে দুজন করে মোট চারজন দাঁড়িয়ে আছে। নিচের মানুষগুলো পড়ে যাওয়া মানুষটাকে ধরে নেবে, এই বিশ্বাস করে ওপরের জনকে কাঠের পুতুলের মতো ল্যান্ডিং থেকে পড়ে যেতে হবে হাত–পা একটুও না বাঁকিয়ে। এটা নাকি ট্রাস্ট গেম। একজন গাট্টাগোট্টা, লম্বা, কালোমতো লোককে দেখলাম, বাজখাই গলায় চিৎকার দিয়ে কী যেন নির্দেশনা দিচ্ছে। মানুষটা একসময় লাফ দিল ওপর থেকে, আমি শ্বাস বন্ধ করা নিস্তব্ধতায় দেখছিলাম শুধু। অদ্ভুত সেই সন্ধ্যায় শুরু হলো আমার থিয়েটার–জীবন। (ঈষৎ সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত)